ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ১৭:৩৩:০৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া ট্রেনে ঈদযাত্রা: ৭ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু গাজায় নিহত বেড়ে ৩২ হাজার ৪৯০ অ্যানেস্থেসিয়ার ওষুধ বদলানোর নির্দেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঈদ কেনাকাটায় ক্রেতা বাড়ছে ব্র্যান্ড শপে বাঁচানো গেল না সোনিয়াকেও, শেষ হয়ে গেল পুরো পরিবার

সামাজিক প্রতিষ্ঠানে বুলিং বন্ধ হওয়া জরুরী

সোমা দেব | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৭:২৮ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার

সোমা দেব:  সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সোমা দেব:  সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

কেসস্টাডি ১: মুমুর (ছদ্মনাম) গায়ের রঙ কালো। আর দেহের ওজন ওর বয়সী ছেলেমেয়েদের তুলনায় বেশি। মুমুর থেকে এক বছরের বড় ভাই মিশু (ছদ্মনাম) খুব ফর্সা। বাড়িতে কোন  আত্মীয় বা মেহমান এলে মুমুর সামনেই মুমুর মাকে বলতে থাকেন, ‘মেয়েটা কার মতো হলো বলতো? ভাই এত ফর্সা, সুন্দর স্লিম! এই মেয়েকে বিয়ে দেবে কী করে? অনেক টাকা যৌতুক নিয়ে তৈরি থেকো।’ মুমুর ফুফুও ওর জন্য দেশের বাইরে থেকে ভালো সাবান এনে দেন মেখে ফর্সা হওয়ার জন্য। সারাক্ষণই কম খেয়ে চিকন হতে বলেন মা আর ফুফু। পনের বছর বয়সী মুমুর বাড়তি ও পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন হয় এসময়। তাছাড়া মুমু ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। কিন্তু স্বাভাবিক পরিমাণ খাবার খেতে দেয়া হয় না ওকে।    
কেসস্টাডি ২: বেবি (ছদ্মনাম) কয়েকদিন ধরে স্কুলে যাচ্ছে না। মনমরা হয়ে বসে থাকে। বেবির মা জিজ্ঞেস করলে সে কিছু বলে না। অনেক পীড়াপীড়ির পর সে জানায়, স্কুলের একটা প্রোগ্রামের জন্য কয়েকজন বান্ধবী টাকা চেয়েছিল। সে দিতে পারেনি বলে বান্ধবীরা ওর ব্যাগ ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। তাকে ‘কিপটে’, ‘ছোটলোক’, ‘চামার’ বলেছে সেই বান্ধবীরা। আর ওর সাথে মিশবে না, স্কুলে এলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবেও বলেছে। এমনকি ক্লাস টিচারকে তারা নালিশও করেছে। সেই শিক্ষকও বলেছেন, ‘টাকা দিতে পারবে না, স্কুলে পাঠায় কেন’?   

কেসস্টাডি ৩: সীমা (ছদ্মনাম) একটি স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। ওদের পাশের বাড়ির সায়হাম ওকে প্রায়ই উত্যক্ত করে। সীমা এর কোন প্রতিউত্তর দেয় না। একদিন সীমা স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ভীষণ কান্নাকাটি করে। ওর বাবা-মা অনেক চেষ্টা করে জানতে পারেন, সীমাদের বাথরুমে গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিল সায়হাম। সীমার গোসলের ছবি ভিডিও করে সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে সায়হাম। আর ইতিমধ্যে অনেককে সে এই ভিডিও দেখিয়েছে। সীমা আত্মহত্যা করবে বলে কান্নাকাটি করছে। 

এই বিষয়গুলো অনেকেই খুব সহজ, স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখেন। অনেকেই ভাবেন নিশ্চয়ই মেয়েটার দোষ, নাহলে ওর সাথেই এমন ঘটে কেন? এই সহজ ঘটনাগুলোই মূলত বুলিংয়ের একেকটি উদাহরণ। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবার থেকেই প্রথমত বুলিংয়ের সূচনা হয়। এই বিষয়টি এতটাই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে এগুলো হয়ত আমরা খেয়ালও করি না। পারিবারিক এই বুলিংয়ের শিকার হয়ে অনেক প্রতিভা, মেধা হারিয়ে যায় চিরতরে। অভিভাবকরা অনেকেই সেই বুলিংকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন নিজের অজান্তে। বর্তমান সময়ে বুলিং নিয়ে যতটা আলোচনা আমরা শুনতে পারছি, জানতে পারছি, এর নেতিবাচক পরিণতি সম্পর্কে জেনে ভীত হচ্ছি, কয়েক বছর আগেও বুলিং নিয়ে কোন ধরনের সচেতনতা ছিল না। কন্যাশিশুদের নানাভাবে হেয় করা হবে এটাই যেন নিয়ম ছিল। তার অক্ষমতা নিয়ে উপহাস, ব্যঙ্গ করা হবে এটাই যেন চরম সত্য। কিন্তু সেই কন্যাশিশুরা ঠিক সেই ঘটনার জন্য কতটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে সেই খবর রাখতো না কেউই। এমনকি পরিবার, উল্টে পরিবারের সদস্যরাই বুলিংকে নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। 

সরকারি খসড়া নীতিমালায় স্কুল বুলিংয়ের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, ‘বিদ্যালয় চলাকালীন সময় বা শুরু হওয়ার আগে বা পরে, শ্রেণিকক্ষে বা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বা বাইরে কোনো শিক্ষার্থী কর্তৃক (এককভাবে বা দলগতভাবে) অন্য কোন শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে আঘাত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, অশালীন বা অপমানজনক নামে ডাকা, অসৌজন্যমূলক আচরণ করা, কোনো বিশেষ শব্দ বারবার ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করাকে স্কুল বুলিং হিসেবে গণ্য হবে।’ 

সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, বুলিং হলো অপ্রত্যাশিত এবং আক্রমণাত্মক আচরণ, যা স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের মধ্যে সাধারণত দেখা যায়। এ আচরণের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে ক্ষমতার অসামঞ্জস্য প্রকাশ পায়। এই আচরণ আক্রান্ত শিশু বা কিশোরের ওপর ক্রমাগত চলতে থাকে। তবে এ আচরণ সাধারণত স্কুলে যাওয়া শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেখা গেলেও যে কোনো বয়সের ব্যক্তির মধ্যেও দেখা যেতে পারে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বা অফিসের সহকর্মীদের মধ্যেও এমন আচরণ দেখা যায়। 

ন্যাশনাল বুলিং প্রিভেনশন সেন্টারের মতে, কিছু বুলিং শারীরিকভাবে সনাক্ত করা গেলেও এটি কখনো কখনো নীরবে বা মানসিকভাবেও চলতে পারে। যেমন, কোনো গুজব বা ইন্টারনেটে কোনো মিথ্যা কথা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বুলিং হওয়া ব্যক্তির মানসিকভাবে ক্ষতি করা। বুলিং আচরণের অন্যতম প্রধান বিষয় হলো, এই আচরণের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (প্রথম আলো অনলাইন: ১ ডিসেম্বর ২০১৯)

সামাজিক যে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা সমাজের সদস্য হয়ে উঠি, সেসব সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিবাহ, রাষ্ট্র ইত্যাদি কন্যাশিশুদের সমাজে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে, কাঠামোতে বেড়ে উঠতে শেখায়, একটি নির্দিষ্ট গন্ডি, সামাজিক শৃঙ্খলের মধ্যে তাকে জীবনযাপন করতে শেখায় যেখানে কন্যাশিশুর নিজের পছন্দমতো, তার মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে বেড়ে উঠার উপায়গুলো খুব সীমিত। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সেই নির্দিষ্ট ঘেরাটোপের ভেতর তাকে বড় হয়ে উঠতে হয়। কিন্তু কখনোই সেই কন্যাশিশুটিকে শিশু অবস্থা থেকে সেই শৃঙ্খলতার আগল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার, বুলিং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার, বুলিং এর বিরুদ্ধে লড়াই করার উপায়গুলো শেখানো হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।

নারী বা কন্যাশিশুরা সেই ছাঁচে বাধা একটা নির্দিষ্ট ধারণার বাইরে এলেই তাকে নিয়ে উপহাস, ব্যঙ্গ এতটাই জোরালো হয়ে উঠে যে, যেন সেই বুলিং করাটাই ন্যায়সঙ্গত কোন কাজ। সেক্ষেত্রে আমরা পরিবারের সদস্যরাই সেই কাজকে উৎসাহিত করে থাকি। যেমন, একটি কন্যাশিশু কালো বা মোটা শরীরের হলে তাকে বিয়ে দেওয়া যাবে না এমন ধারণা পোষণ করেন অনেকেই। যেন বিয়ে দিতে পারাটাই কন্যাশিশুর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাকে ঘষেমেজে বিয়ের জন্য তৈরি করেন পরিবারের সদস্যরাই। যেন তার জন্মই হয়েছে বিয়ে করে সংসার সামলানোর জন্য, সন্তান জন্মদানের জন্য। কোন নারী ফর্সা এজন্য সেই মেয়েকে কোন যৌতুক ছাড়া পাত্রপক্ষ বিয়ে করিয়ে নিয়ে গেছেন, এই মেয়েকেই পাত্রপক্ষের চাই এরকম বাবা-মায়ের ‘গর্বিত’ মুখও আমাদের চোখে পড়ে হামেশাই। বিয়ের বাইরে বহির্বিশ্বের সাথে সেই নারীর পরিচয় করিয়ে দেয়া, তাকে উচ্চ শিক্ষিত করার শিক্ষা বা স্বপ্ন আমরা খুব কমই দেখাতে পারি। সেই কন্যাশিশুটিকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা, বুলিং এর বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তোলা এসব বিষয় শেখাতে হবে পরিবার থেকে এর ধারণাও আমরা পোষণ করি না। যে কারণে দিনের পর দিন একটি কন্যাশিশু কম আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠে। সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এমনকি বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি, এমনকি কর্মক্ষেত্র, সাইবার ক্ষেত্রে কোথাও বুলিংয়ের শিকার হলে এর প্রতিবাদ করতে পারে না। কারণ কন্যাশিশু থাকাকালীনই সে সেই বুলিংকে হজম করতে শিখেছে। শেষ পর্যন্ত সেই কন্যাকেই ভিকটিম হয়ে থাকতে হয়, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয় সেই কন্যা। 

ইউনিসেফের ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাইবার বুলিংয়ে শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ মানুষের বয়স ১০ থেকে ১৩ বছর; ৩৬ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ১৫ বছর এবং ২৫ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর। ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের উপর চালানো জরিপের বরাত দিয়ে ২০১৭ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব দেশে সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে এবং নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে বুলিংয়ের। ( দৈনিক যুগান্তর অনলাইন: ২১ জুন, ২০২১) 

এছাড়া ২০২০ সালে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা আর্টিকেল ১৯ আয়োজিত ‘সেইফ সাইবার স্পেস ফর উইমেন’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ডিভিশনের অতিরিক্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার নাজমুল আলম জানান, বাংলাদেশে সাইবার বুলিংয়ের হার অত্যন্ত বেশি এবং এর মধ্যে ৮০ শতাংশ বুলিংয়ের শিকার হয় ১৪ থেকে ২২ বছর বয়সী কন্যাশিশু এবং নারীরা (The Daily Star Online: 10 December, 2020)।

এই পরিসংখ্যানগুলো খুব উদ্বেগজনক। কারণ এই অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী তথা কন্যাশিশুদের বুলিং সম্পর্কে কোন জ্ঞান বা তাকে যথাযথ শিক্ষা আমরা পরিবার থেকে দিতে পারিনি। শুধু তাকে বুলিং করলে সেটা সহ্য করে নেওয়ার শিক্ষাই দিয়েছি। 

সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের ‘সাইবার বুলিং অ্যাগেইনস্ট গার্লস অ্যান্ড উইমেন ওভার সোশ্যাল মিডিয়া’ শীর্ষক জরিপ বলছে, যৌন হয়রানিমূলক ভিডিও, বার্তা ও ছবির মাধ্যমে গ্রামে ৩৩ শতাংশ এবং শহরের ৬৪ শতাংশ মেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে। ২০১৯ সালের শুরুতে জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ ‘বাংলাদেশের শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা’ শীর্ষক জরিপ বলছে, দেশের ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইনে সহিংসতা, ভয়ভীতি ও উৎপীড়নের শিকার হয়েছে। এই জরিপ অনুযায়ী এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে। (প্রথম আলো অনলাইন: ২০ জুন, ২০২১) 

এই কন্যাশিশুদের পরিবার থেকেই বুলিংয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তাকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী, পছন্দমতো, সুস্থ মানসিক অবস্থার মধ্যে বাঁচতে দিতে হবে। কন্যাশিশু মানেই শৃঙ্খলতার আগল নয়, ঘেরাটোপে বন্দীত্বের জীবন কাটানো নয়। সমাজের চাহিদা মতো তাকে ফর্সা, স্লিম, ঘরের কাজে পারদর্শী, অন্যের সেবাদাসী হয়ে জীবন কাটানো নয়। অন্যের চাহিদামতো নিজেকে তৈরি করা নয়। সেরকম নাহলেই তাকে নানাভাবে বুলিং করা হবে এবং এই বুলিং বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে হবে-এই ধারণা পরিবর্তন হওয়া খুব জরুরী। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ২২ আগস্ট ২০২১ হাইকোর্ট রুল দিয়েছে। তার সাথে বিদ্যালয়ে বুলিং রোধে নীতিমালা বা গাইডলাইন তৈরি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। (দৈনিক প্রথম আলো: ২৩ আগস্ট, ২০২১) 

‘মোটা বলে সহপাঠী ও শিক্ষকের লাঞ্ছনার শিকার মৃত কিশোরের পরিবার যা বলছে’ শিরোনামে গত ৮ জুলাই বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন যুক্ত করে এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ ১৬ আগস্ট ওই রিট করেন। 

বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী অ্যানোরেক্সিয়া এবং বুলিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর তার পরিবার অভিযোগ করে সেই শিক্ষার্থীর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের বুলিং এর শিকার হয়। যার ফলে সে ইন্টারনেট থেকে একটি জনপ্রিয় ডায়েট ফলো করে অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সে সবসময় স্কুলে সহপাঠীরা ক্ষেপাবে, এই ভয়ে থাকতো (বিবিসি বাংলা, ঢাকা: ৮ জুলাই, ২০২১)। 

সবচেয়ে জরুরী বিষয় হলো, এই বুলিং করছে কারা? একটি শিশুকে ক্ষেপানোর ভয়ে, মানসিক পীড়নের ভয়ে ভীত করছে কারা? আমরা যে সমাজে বাস করছি, যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানে বাস করছি সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। সেই ক্ষেত্রেগুলোতেই মানসিকতার বদল খুব জরুরি। চিন্তার বদল না ঘটাতে পারলে আইন করে সত্যি কিছু হয় না। আইনে শাস্তির ব্যবস্থা আছে কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ সবক্ষেত্রে কি আমরা ঘটতে দেখি? পরিবারের সদস্যরা যখন বুলিং করে, আত্মীয়রা যখন বুলিং করে সেখানে আইন কতটা প্রয়োগ করা যাবে? সেখানেই পরিবর্তন প্রয়োজন, যারা বুলিং করছে, শুরু থেকেই সেখানে চিন্তা, মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিবারের সব ছেলেশিশুদেরও নিজেকে ‘সুপিরিয়র’ আর কন্যাশিশুদের ‘ইনফিরিয়র’ ভাবার চিন্তা থেকে বের হয়ে আসার মানসিকতা বদলাতে হবে। ছেলেদের যতদিন নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবা, নারীদের হেয় করা ভাবা বন্ধ না হবে, বিয়ে করার সময় ‘সুন্দরী’, ‘ফর্সা’, ‘স্লিম’, ‘রাজকুমারী’ পাত্রী খোঁজার মানসিকতা থেকে বের হতে না পারবে ততদিন কন্যাশিশুরাও সবসময় হেয় হতেই থাকবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সর্বক্ষেত্রে কন্যাশিশুরা বুলিং শিকার হতেই থাকবে। আর নিজেকে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপযোগী করে তুলতে গিয়ে ‘সুন্দরী’, ‘ফর্সা’, ‘স্লিম’ হতে গিয়ে নিজের জীবনের সমস্ত সময়, শক্তি, শ্রম খরচ করে নিজের মেধার, যোগ্যতার চর্চা করা থেকে দূরে সরে আসতে থাকবে। 

কন্যাশিশুদের নিয়ে বুলিং রোধ করতে প্রথমতই পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার আগে পরিবারে ঘটতে থাকা বুলিংয়ের বিরুদ্ধে অভিভাবকদেরই সচেতন হতে হবে। একটি কন্যাশিশুকে আত্মবিশ্বাসী ও প্রচলিত নেতিবাচক ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করা খুব জরুরি। একজন কন্যাশিশুকে আত্মবিশ্বাসী, নিজের মেধার স্ফুরণ ঘটানো, নিজের সমস্যার কথা খুলে বলার জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা এবং মানসিকভাবে অসহায় বোধ করলে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি ছেলেশিশুকেও একজন কন্যাশিশুর প্রতি সম্মান দেখানোর শিক্ষা পরিবারকেই দিতে হবে। 

কন্যাশিশুদের নিয়ে বুলিং এর ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে তার ‘আধেয়’-এর মধ্য দিয়ে। একটি ভারতীয় হেয়ারকেয়ার অয়েলের বিজ্ঞাপনে ‘স্কুলে সবাই আমাকে ছুটকি বলে ক্ষেপায়’ বলে মায়ের কাছে অভিযোগ করা ছোট্ট কন্যাশিশুটিকে মায়ের ‘তুমি কোথায় ছুটকি’ বলে মেয়ের চুল দেখিয়ে ‘তুমি তো এত বড় আর স্ট্রং ও বলে’ সান্তনা দেয়ার আধেয় এটাই প্রমাণ করে যে, এসব বুলিং হজম করার মতো স্ট্রং হতে হবে সেই ছোট্ট মেয়েটিকে। কিন্তু তাকে সেই বুলিং বা ক্ষেপানোর জন্য প্রতিবাদ করা শেখানো হয় না। গণমাধ্যমের আধেয় সেটা বিজ্ঞাপন বা ছোট শিশুদের নিয়ে তৈরি অনুষ্ঠানের আধেয়তেও বুলিং এর বিরুদ্ধে সাহসী, প্রতিবাদী হওয়ার মতো আধেয় রাখা অত্যন্ত জরুরী।

বুলিং প্রতিরোধে প্রতিটি কন্যাশিশুকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। যাতে সে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে, নিজের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে, পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ছুড়ে মারা বুলিংয়ের যোগ্য প্রতিরোধ করতে পারে। একটি কন্যাশিশুও যেন  নিজেকে অসহায় না ভাবে এবং নিজের অবস্থানের সাথে যুদ্ধ করে হেরে গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে না নেয়। এজন্য প্রয়োজন পরিবারসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সদস্যের মানসিকতার পরিবর্তন। কন্যাশিশুদের নিয়ে নেতিবাচক ধ্যানধারণার পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই বুলিং প্রতিরোধ সম্ভব হবে। প্রতিটি কন্যাশিশু একেকজন যোগ্য মানুষ হিসেবে পরিণত হতে পারবে। 

তথ্য সহায়িকা: 
১। ফারজানা শারমিন, ‘কতটা জানি: কম বয়সে পীড়ন বা বুলিং’, প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ: ১ ডিসেম্বর ২০১৯

২।  তানভীর মাহতাব আবীর, ‘সাইবার বুলিং: আমরা কতটা সচেতন?’, দৈনিক যুগান্তর অনলাইন সংস্করণ: ২১ জুন, ২০২১

৩। ‘80% of cyberbullying victims are women: Cyber Crime Division of DMP: Majority of the cybercriminals  16-17 year old’, The Daily Star Online: 10 December, 2020

৪। মানসুরা হোসাইন, ‘সাইবার বুলিং নিয়ে হোক প্রতিবাদ’,  প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ: ২০ জুন, ২০২১

৫। ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং রোধে নীতিমালা কেন নয়: হাইকোর্ট, দৈনিক প্রথম আলো’, ৩য় পাতা: ২৩ আগস্ট, ২০২১

৬। সাইয়েদা আক্তার, ‘মোটা বলে সহপাঠী ও শিক্ষকের লাঞ্ছনার শিকার মৃত কিশোরের পরিবার যা বলছে’, বিবিসি বাংলা, ঢাকা।

# সোমা দেব:  সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।