ঢাকা, রবিবার ২১, ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:৫৯:৪৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
তুমি আমাদের বুকের ভেতরে আছো: প্রধান উপদেষ্টা সংসদ নির্বাচনের তফসিল সংশোধন ইসির আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অ্যাপ ব্যবহার করবে ইসি খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ঘিরে পরিকল্পিত গুজব ৬ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর সামরিক মর্যাদায় দাফন আজ

খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ঘিরে পরিকল্পিত গুজব

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:১৯ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ রবিবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিকল্পিত গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে দেশে যখন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, ঠিক সেই সংবেদনশীল এ পরিস্থিতিকে পুঁজি করে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর সব তথ্য ছড়িয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে সক্রিয় রয়েছে একটি চক্র। মনিটাইজেশন ও ভিউ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সংগঠিতভাবে অপতথ্য ছড়াচ্ছে অন্তত শতাধিক ফেসবুক প্রোফাইল, পেজ ও গ্রুপ। মানুষের আবেগকে উসকে দিয়ে গুজবকে পণ্য বানানো এবং সমাজে বিভ্রান্তি ও উত্তেজনা ছড়ানোই তাদের উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এএফপির ফ্যাক্ট চেক সম্পাদক ইয়ামিন সাজিদ বলেন, সাধারণত ভিউ বাণিজ্য বা আর্থিক সুবিধা অর্জনের জন্যই অপ-তথ্য ও ভুয়া কনটেন্ট ছড়ানো হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গুজব ছড়ানোর লক্ষ্য শুধু আর্থিক নয়; এটি এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে, একাধিক রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থকরা অন্য দলের নেতাদের স্বাস্থ্য, চরিত্র ও সম্পদসংক্রান্ত অপতথ্য ছড়াচ্ছেন। এসব কৌশল ব্যবহার করে অপতথ্য বিস্তারকারীরা নির্দিষ্ট দলের ভোটব্যাংককে প্রভাবিত করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের সমর্থকদের বিভ্রান্ত ও মানসিকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছড়ানো এসব কনটেন্টের অধিকাংশই খালেদা জিয়ার মৃত্যুর গুজব কেন্দ্র করে তৈরি। পোস্টগুলোর ভাষা, গ্রাফিক্স, ভিডিও ক্লিপ এবং প্রকাশের সময় প্রায় একই রকম, যা সংগঠিত অপতথ্য প্রচারের ইঙ্গিত দেয়। আইডি বা পেজগুলোর বেশির ভাগই এই ১৫ দিনের মধ্যে খোলা হয়েছে এবং উদ্দেশ্যও একই, গুজব ছড়ানো।

এসব পোস্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৫০টির বেশি পোস্টে সরাসরি খালেদা জিয়ার মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি পোস্টে বলা হয়েছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়া হয়েছে। ৩০টি পোস্টে ছিল খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য; আর প্রায় ১১টি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে মৃত্যুর খবর গোপন রাখা হয়েছে।

‘মাই বাংলা টিভি’ নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হয়। ৭ ডিসেম্বর ওই পেজে একটি ফটোকার্ড পোস্ট করে লেখা হয়-‘আর নেই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।’ একই ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয় ৯ ডিসেম্বর ‘শারিন তমা রিলস’ নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে। সেখানে দাবি করা হয়, খালেদা জিয়ার মৃত্যুর রহস্য নিয়েও রাজনীতি চলছে এবং তিনি নাকি ২৮ নভেম্বর রাত ১০টা ৩০ মিনিটে মারা গেছেন।

এ ছাড়া ‘জীবন বাংলা নিউজ’ নামে আরেকটি ফেসবুক পেজ থেকেও একই ধরনের গুজব ছড়ানো হয়। সেখানে ফটোকার্ডে লেখা হয়, ‘চলে গেলেন না ফেরার দেশে বেগম খালেদা জিয়া।’ শুধু খালেদা জিয়াকে নিয়েই নয়, কখনো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা, কখনো তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে ঘিরেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রোপাগান্ডামূলক পোস্ট ছড়ানো হচ্ছে।

সম্প্রতি ‘আজ বাংলা অনলাইন’ নামে একটি পেজ থেকে ডিবিসি নিউজের আদলে হুবহু একটি ভুয়া ফটোকার্ড তৈরি করা হয়। সেখানে লেখা হয়, দেশে চিকিৎসা নিতে আগ্রহের কথা পুত্রবধূ জোবাইদা রহমানকে জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। অথচ পোস্টের ক্যাপশনে ব্যঙ্গ করে লেখা হয়, ‘ভেন্টিলেটরে থাকা রোগী কথা কয় কেমনে? খালেদা জিয়া দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন।’ পুরো ফটোকার্ডটিই ছিল ভুয়া।

বুধবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অসুস্থ হওয়ার পুরোনো একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ২২ সেকেন্ডের ভিডিও মুহূর্তেই ছড়িয়ে দেওয়া হয় ফেসবুকের বিভিন্ন আইডি ও পেজ থেকে। সেখানে দাবি করা হয়-‘বিজয় দিবসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে বক্তব্য দেওয়ার সময় মির্জা ফখরুল হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন।’ তবে ফ্যাক্ট চেক করে দেখা গেছে, ভিডিওটি এক বছর আগের। অথচ মির্জা ফখরুল এবার বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাননি।

এমনকি দেশের জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভির লোগো নকল করেও ফটোকার্ড তৈরি করে এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ‘যানোনা টিভি’ নামে একটি পেজ থেকে ছড়ানো পোস্টে তারেক রহমানের উদ্ধৃতি দেখিয়ে বলা হয়, ‘দেশনেত্রী আর নেই, আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না।’ যার কোনো সত্যতা নেই।

যদিও এসব পোস্টে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র বা প্রমাণ থাকে না, তবুও সেগুলো দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক তৈরি করে।

এএফপির ফ্যাক্ট চেক সম্পাদক ইয়ামিন সাজিদ বলেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে যেসব তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে, তার বড় একটি অংশই সম্পূর্ণ ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর। এসব অপতথ্যের হাত থেকে নিজেকে এবং সমাজকে বাঁচাতে হলে জনগণকে নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যম থেকে তথ্য জানার চেষ্টা বাড়াতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে কোনো সেনসিটিভ তথ্য দেখলে সেটা বিশ্বাস করার আগে অবশ্যই যাচাই করে দেখতে হবে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপতথ্য প্রচারকারীরা কথিত ‘ব্রেকিং নিউজ’ টেম্পলেট ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তথ্যকে সহজে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে সেগুলো ভাইরাল করা হচ্ছে। এসব পোস্টে খালেদা জিয়া ও হাসপাতালের নাম ব্যবহার করে ভুয়া ছবি, ভিডিও ক্লিপ এবং গ্রাফিক্স সংযুক্ত করা হয়, যা দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, চেহারায় খানিকটা মিল আছে, এমন ব্যক্তিদের কিংবা কাছাকাছি সময়ে হাসপাতালে ভর্তি বা অসুস্থ থাকা বিভিন্ন রোগীর ছবি ব্যবহার করে সেগুলোকে খালেদা জিয়ার ছবি বলে প্রচার করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ছবি নতুন ঘটনার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ‘ব্রেকিং’ আকারে উপস্থাপন করা হয়। এই কৌশলের মাধ্যমে আবেগ উসকে দিয়ে দ্রুত শেয়ার বাড়ানো এবং মনিটাইজেশন থেকে আর্থিক লাভ করাই অপতথ্য ছড়ানো চক্রের মূল লক্ষ্য বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একযোগে অপতথ্য ছড়ানোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ঘিরে মৃত্যুর গুজব ও অসুস্থতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে একই ধরনের কনটেন্ট, ভাষা ও টেম্পলেট ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো থেকে স্পষ্ট হয়, এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এই অপতথ্য প্রচার মানুষের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ওপর আস্থা নষ্ট করছে এবং দায়িত্বশীল গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ডিজিটাল মিডিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, একযোগে অপতথ্য ছড়ানোর নেপথ্যে আছে সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করা। তাই জনগণকে সচেতন করা এবং সঠিক তথ্য প্রদান করা এখন একটি বিশেষ দায়িত্ব। এই কঠিন সময়ে গণমাধ্যমকে একটু বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক একেএম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, খালেদা জিয়াকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে মৃত্যুগুজব ছড়ানো হয়েছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পরিকল্পিত। কয়েকটি নির্দিষ্ট পেজ ও আইডি থেকে এই অপপ্রচার চালানো হয়েছে, যার এলাইনমেন্ট একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলছে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এখনো পর্যন্ত সরকার, আইসিটি মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব পেজ ও আইডির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের গুজব আরও বাড়তে পারে, যা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, অতীতেও অপরাধ আড়াল করতে সামাজিক মাধ্যমে বিএনপির বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে। এসব অপতথ্য ছড়ানোকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, দলের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে নিয়মিতভাবে দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য তথ্য জানানো হচ্ছে। এরপরও যারা মৃত্যুর গুজব বা অসত্য তথ্য ছড়াচ্ছে, তারা মূলত অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে।