ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:১২:১১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
আজ আসছে না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা পেছাল খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে জুবাইদা রহমান ‘শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের ইতিবাচক সাড়া নেই’ বেশির ভাগ সবজিই ৬০-৮০ টাকার ওপরে বন্যায় সহায়তা: বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী

‘গলার কাঁটা’ খেলাপি ঋণ

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৬:৪৫ পিএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বুধবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

চরম এক সংকটময় পরিস্থিতি অতিক্রম করছে দেশের ব্যাংকখাত। পতিত সরকারের সময়ে ব্যাংক থেকে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এর প্রভাব পড়েছে সাধারণ আমানতকারী ও দেশের ব্যাংকিং খাত তথা দেশের পুরো অর্থনীতির ওপর। অর্থনীতির বুকে দীর্ঘদিন ধরে চেপে বসে থাকা এক অদৃশ্য বোঝা হয়ে উঠেছে খেলাপি ঋণ।

সংকটকালে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের নানান পদক্ষেপেও এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ ঘটছে না। খেলাপি ঋণ রয়ে গেছে গলার কাঁটার মতো, যা দেশের আর্থিক কাঠামোকে করে তুলেছে নাজুক ও অনিরাপদ।

চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি ঋণ আদায়যোগ্য নয় বলে চিহ্নিত হয়েছে। অথচ পাঁচ বছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা— যা দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য এক ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরি করেছে।

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ৫ বছরের চিত্র

২০২১ সালের ডিসেম্বর: ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি (মোট ঋণের ৭.৯৩%); ২০২২ সালের ডিসেম্বর: ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি (৮.১৬%); ২০২৩ সালের ডিসেম্বর: ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি (৯%); ২০২৪ সালের ডিসেম্বর: ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি (২০.২%); ২০২৫ সালের জুন: ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি (২৭.০৯%)। এ থেকে স্পষ্ট, মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে (২০২২ থেকে ২০২৫) খেলাপি ঋণ বেড়েছে চারগুণেরও বেশি।

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিশ্লেষণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কিছু কারণ চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো—ভুয়া ও নামহীন প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণ অনুমোদন; রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ পাওয়া ও আদায় না করা; ঋণ নবায়নের নামে দায় এড়ানো; বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অর্থপাচার; আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা প্রদান।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, একাধিক ব্যাংক- বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।

লুকানো খেলাপির চিত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে আরও ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হিসেবে দেখানো যাচ্ছে না। ১ হাজার ৮৬ জন ঋণগ্রহীতার ২৭ হাজারেরও বেশি ঋণ নিয়মিত দেখাতে হচ্ছে, সেগুলো আদায়ও হচ্ছে না। এই অর্থকেও যদি খেলাপি ধরা হয়, তাহলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ ৯৩ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা— যা ব্যাংকখাতের মোট ঋণের প্রায় ৩৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বলেছেন, খেলাপি ঋণের কোনো তথ্য আর লুকিয়ে রাখা হবে না। এটা আদায় জোরদারের মাধ্যমে কমানো হবে। নতুন করে বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয় সেজন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনা হচ্ছে। মূলত বিগত সময়ে কয়েকটি গ্রুপ ঋণের নামে বিপুল অর্থ বের করে নিয়েছে। যাদের বেশিরভাগই এখন পলাতক।

সংকটে ব্যাংকখাতের ভবিষ্যৎ

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, খেলাপি ঋণ যদি এভাবে বাড়তেই থাকে তবে আমানতকারীরা ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারাবে। এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম. হেলাল আহমেদ জনি বলেন, ‘প্রভিশন ঘাটতি বাড়ায় ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা হুমকিতে পড়বে। নতুন ঋণ বিতরণেও ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিতে চাইবে না, ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। অর্থনীতি জুড়ে তারল্য সংকট তৈরি হতে পারে।’

জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়ালো

খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধিতে দেশের ব্যাংকখাত আজ এক গভীর সংকটে। ৫ বছরে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি শুধু অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকেই নয়, বরং আমানতকারীদের আস্থাকেও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এ সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, লুকানো তথ্য এখন বেরিয়ে আসছে, বর্তমানে খেলাপি হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘দেশের ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতো না (আগে), এখন ঋণ খেলাপির সঠিক চিত্র বেরিয়ে আসছে। আবার দেশের সম্পদ ও বাইরে পাচার হওয়া সম্পদ ফেরাতেও কাজ চলমান। পাচার অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিকভাবে আইনজীবী নিয়োগসহ নানান কাজ হচ্ছে। আশা করতেই পারি ভালো কিছু হবে।’

পাচার অর্থ ফেরত আনায় জটিলতা

বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগ করেছে। তবে অর্থ ফেরানোর পথ সহজ নয়।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যে দেশে টাকা গেছে, সেই দেশের সরকার সহযোগিতা করলে ফেরত পাওয়া সম্ভব। না হলে প্রায় অসম্ভব। তবে পাচারকারীর সম্পদ জব্দ করা গেলে একটা শক্ত বার্তা যাবে যে এসব করে কেউ লাভবান হতে পারবে না।’

সমাধান কোন পথে?

অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ঋণ পুনঃতফসিলের নামে দায় এড়ানোর পথ বন্ধ করতে হবে। পাচার অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। সরকারি ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।’