ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:১২:০৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
আজ আসছে না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা পেছাল খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে জুবাইদা রহমান ‘শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের ইতিবাচক সাড়া নেই’ বেশির ভাগ সবজিই ৬০-৮০ টাকার ওপরে বন্যায় সহায়তা: বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী

ইরানে বিয়ের আগেই কুমারীত্ব প্রমাণ করতে হয় মেয়েদের!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:২৮ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২২ শনিবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ইরানে বিয়ের আগে নারী এবং তার পরিবারের জন্য সতীত্ব বা কুমারীত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এখনও অনেক পুরুষ বিয়ের আগে কনের সতীত্বের সার্টিফিকেট বা সনদ চায়, যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে দিয়েছে, এমন পরীক্ষার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং এটি নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন।
গত কয়েক বছর ধরে ইরানে বিয়ের আগে নারীদের সতীত্ব প্রমাণের এই পুরনো প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, প্রচারণা বাড়ছে। 'তুমি কুমারীত্ব হারিয়েছিলে বলেই আমাকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করেছো। তোমার আসলটা জানলে কেউই তোমাকে বিয়ে করতো না।' বিয়ের পর প্রথম যৌনমিলনের পর মরিয়ামের স্বামী তাকে এই কথাই বলেছিল।

মারিয়াম তার স্বামীকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে যে তার যোনিপথ দিয়ে রক্ত না বের হলেও বিয়ের আগে কখনই কারো সঙ্গেই তার কোনো যৌনমিলন হয়নি। তবে স্বামী তাকে বিশ্বাস করেনি এবং প্রমাণ দেখাতে তাকে সতীত্বের সার্টিফিকেট আনতে বলে। ইরানে এ ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাগদানের পর অনেক নারী ডাক্তারের কাছে গিয়ে কুমারীত্বের পরীক্ষা করায় যেন স্বামী কাছে প্রমাণ করতে পারে যে বিয়ের আগে তার কোনো যৌনমিলন হয়নি।

ডব্লিউএইচও বলে, এ ধরনের কুমারীত্ব পরীক্ষার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ পরীক্ষা দিয়ে যৌনমিলন নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছুই প্রমাণ করা সম্ভব নয়। মারিয়ামের সতীত্বের সনদে লেখা ছিল যে তার হাইমেন বা যোনিপথের পর্দা অনেকটা ইলাস্টিকের মতো। ফলে, যৌনমিলনের পরও তা ফেটে রক্তপাত হয়নি। 'পুরো বিষয়টি আমার সম্মানে খুব লাগে। আমি কোনো অন্যায় করিনি, কিন্তু আমার স্বামী আমাকে দিনের পর দিন অপমান করেছে,' বলেন মারিয়াম। 'এক পর্যায়ে আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। একদিন ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করি।' সময়মতো হাসাপাতালে নেয়ায় তার প্রাণ রক্ষা পায়। ঐ অন্ধকার দিনগুলোর কথা কখনোই ভোলা যাবেনা। কদিনে ওজন ২০ কেজি কমে গিয়েছিল।

মারিয়ামের এই কাহিনী ইরানের আর বহু নারীর মতোই। অনেক নারী এবং তাদের পরিবারের জন্য বিয়ের আগে কুমারীত্ব প্রমাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই রীতির শেঁকড় সেদেশের রক্ষণশীল সংস্কৃতির অনেক গভীরে প্রোথিত। তবে সম্প্রতি হাওয়া ধীরে হলেও বদলাতে শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক নারী ও পুরুষ এ ধরনের সতীত্বের পরীক্ষা এবং সার্টিফিকেট নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন। ২০২১ সালের নভেম্বরে অনলাইনে সতীত্ব পরীক্ষা নিষিদ্ধের একটি পিটিশনে এক মাসের মধ্যে ২৫ হাজার লোক সমর্থন জানায়। এই প্রথম ইরানে এতো মানুষ এ ধরনের রীতি খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করলো। এই রীতি একজন নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং তার মর্যাদার লঙ্ঘন, বলেন নেদা।

তেহরানে তিনি যখন ১৭ বছরের ছাত্রী তখন এক ছেলে বন্ধুর সঙ্গে তার প্রথম যৌনমিলন হয়। পরপরই তার ওপর আতংক ভর করে। পরিবার জানতে পারলে কী হবে এই ভেবে ভয়ে সিঁটকে গিয়েছিলাম। সুতরাং, নেদা অপারেশন করে তার যোনী-পর্দা জোড়া লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। যদিও এ ধরনের অপরেশন ইরানে নিষিদ্ধ নয়, তবে জানাজানি হলে তার ঝক্কির কথা ভেবে কোনো হাসপাতাল তা করতে রাজী হয়নি। শেষে একটি বেসরকারি ক্লিনিক প্রচুর পয়সার বিনিময়ে গোপনে যোনী পর্দা জোড়া দেওয়ার ঐ অপারেশন করতে রাজী হয়।

তিনি বলেন, 'আমি আমার সব জমানো পয়সা খরচ করলাম। ল্যাপটপ বিক্রি করলাম। মোবাইল ফোন, গহনা সব বিক্রি করলাম'। অপারেশনে কোনো ঝামেলা হলে তার সব দায় নেয়ার একটি মুচলেকায় সইও করেন নেদা। একজন ধাত্রী ৪০ মিনিট ধরে অপারেশন করেন। সুস্থা হতে কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল তার। এত ব্যথা হতো যে আমি পা নাড়াতে পারতাম না। পুরো ঘটনা পরিবারের কাছ থেকে গোপন রাখে সে। খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতাম। তবে বাবা-মা স্বজনরা জানলে কী হবে এই ভয়ে ব্যথ্যা সহ্য করতাম। কিন্তু এত কষ্ট দুর্ভোগের ফল সে পায়নি। 

এক বছর পর এক ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় হয় যে তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়। কিন্তু প্রথম যৌনমিলনের পর তার কোনো রক্তক্ষরণ হয়নি কারণ, যোনী-পর্দা জোড়া দেওয়ার অপারেশনে কাজ হয়নি। ঐ পুরুষ বন্ধু তাকে দোষারোপ করলো যে সে তাকে ঠকাতে চেয়েছি। সে তাকে মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দিয়ে ছেড়ে চলে গেল।' 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে দিয়েছে এ ধরনের সতীত্বের পরীক্ষা শুধু যে অনৈতিক তা নয়, এটি বৈজ্ঞানিকভাবেও ভিত্তিহীন। তারপরও ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ইরান এবং তুরস্কসহ অনেক দেশে এমন পরীক্ষা এখনও প্রচলিত। ইরানের চিকিৎসকদের সমিতি বলছে, মামলা বা ধর্ষণের অভিযোগের মতো কিছু বিষয়ে তারা এ ধরনের পরীক্ষা করে। তবে কুমারীত্ব পরীক্ষা করে সার্টিফিকেটের চাহিদা আসে প্রধানত বিয়ের আগে দম্পতিদের কাছ থেকে। মেয়েরা সাধারণত তাদের মায়েদের নিয়ে ক্লিনিকে হাজির হয়। তারপর একজন গাইনির চিকিৎসক বা অনেক সময় একজন ধাত্রী নার্স যোনীপথ পরীক্ষা করে সনদ ইস্যু করেন। সনদে ঐ মেয়ের নাম, তার বাবার নাম এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের বিস্তারিত থাকে। কখনো কখনো ছবিও থাকে। সনদে তার যোনীপথের পর্দার অবস্থা বর্ণনা করে শেষ লেখা হয়,'খুব সম্ভবত এই নারী এখনো কুমারী।' অতি রক্ষণশীল পরিবারের বেলায় এই সনদে দুইজন স্বাক্ষীর সই থাকে। সাধারণত পাত্রের মা ও পাত্রীর মা।

গত বেশ কয়বছর ধরে এ ধরনের কুমারীত্বের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন ডা. ফারিবা। তিনি স্বীকার করেন একজন নারীর জন্য এই পরীক্ষা মর্যাদাহানীকর, কিন্তু একইসঙ্গে তিনি মনে করেন এই পরীক্ষা করে অনেক নারীতে তিনি সাহায্য করছেন। মেয়েরা তাদের পরিবারের কাছ থেকে খুবই চাপের মধ্যে থাকে। ডা. ফারিবা বলেন, আমি অনেক সময় মিথ্যা বলি। বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক করেছে বুঝেও আমি দুই পরিবারকে বলি মেয়ে কুমারী। কিন্তু ইরানে অনেক পুরুষ এখনো কুমারী বা সতী নারী ছাড়া বিয়ের কথা ভাবতেই পারেনা। এ ব্যাপারে তারা আপোষহীন। যে নারী বিয়ের আগে সতীত্ব খুইয়েছে তাতে বিশ্বাস করা যায়না। সে তার স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যেতে পারে, 'বলেন ৩৪ বছরের আলী, সিরাজ শহরের একজন বিদ্যুৎ মিস্ত্রি।

তিনি স্বীকার করেন যে ১০টি নারীর সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক হয়েছে। তিনি নিজেকে সামলাতে পারেনি। আলী স্বীকার করেন ইরানের সমাজে এ ধরনের নৈতিকতা একপেশে এবং গলদে ভর্তী, কিন্তু তিনি এই প্রচলিত প্রথা ভাঙতে নারাজ। তার কথা - 'সমাজই নারীর চেয়ে পুরুষকে বেশি স্বাধীনতা দিয়েছে। এটাই সমাজের প্রথা।' ইরানে বহু মানুষই আলীর মতো ভাবেন, বিশেষ করে রক্ষণশীল গ্রামীণ সমাজে। যদিও বিয়ের আগে সতীত্ব পরীক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে, কিন্তু বিতর্কিত এই রীতি ইরানের সংস্কৃতির এতো গভীরে প্রোথিত যে কেউই বিশ্বাস করেন না খুব সহসা সরকার বা পার্লামেন্ট আইন করে তা নিষিদ্ধ করবে।

চার বছর ধরে স্বামীর গঞ্জনা-নির্যাতন সহ্য করার পর এবং আত্মহত্যা করতে গিয়ে প্রাণে বাঁচার পর মারিয়াম অবশেষে আইনি প্রক্রিয়ায় তালাক পেয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। ভবিষ্যতে কেনো পুরুষকে বিশ্বাস করা আমার জন্য কঠিন হবে। বলেন তিনি, 'অদূর ভবিষ্যতে আবারো বিয়ে কথা তিনি ভাবতেই পারিনা।' অনলাইনে এ ধরনের সতীত্ব পরীক্ষা এবং সনদের প্রচলিত রীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে যে সব পিটিশন এখন হচ্ছে তাতে হাজার হাজার ইরানি নারীর মতো তিনিও সই করেছেন। যদিও মারিয়াম বিশ্বাস করেন না তার জীবদ্দশায় এই রীতি বন্ধ হবে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন ইরানের নারীরা আরো অধিকার পাবে। আমি নিশ্চিত একদিন এটা হবে। আমি আশা করি আমি যে দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেয়েদের যেন তা ভোগ করতে না হয়। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য রিপোর্টে ব্যবহৃত নামগুলোর সবই ছদ্মনাম।

সূত্র: বিবিসি