ঢাকা, শুক্রবার ১৯, এপ্রিল ২০২৪ ২১:২৭:৩৩ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ পুড়ে ছাই, রক্ষা পেল ৭ শিশু সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম সারা দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি শিশু হাসপাতালের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে

একাত্তর থেকে বর্তমান: লড়াকু বিবিজান

অধরা শ্রেয়সী অথৈ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি) | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:২৭ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০১৯ মঙ্গলবার

বিবিজান।  ছবি : অধরা শ্রেয়সী অথৈ, উইমেননিউজ২৪.কম

বিবিজান। ছবি : অধরা শ্রেয়সী অথৈ, উইমেননিউজ২৪.কম

রাজশাহীর পিএন স্কুল সংলগ্ন রাস্তাটিতে মাঝেমধ্যেই শোনা যেত তার চিৎকার, কথার তুবড়ি ছুটিয়ে তুমুল ঝগড়া। ভদ্রলোকেরা বিরক্ত হতেন। আবার, এই ভদ্র সমাজের প্রতিনিধিরাই সকাল-বিকেল নানা উপায়ে বিরক্ত করতেন তাকে। সেই মানুষটার অবশ্য এসবে কিছু যায় আসত না। তার পরিষ্কার কথা, 'আমি দুই হাজার টাকা বেতন পাই। প্রতিদিন খিচুড়ি কিনে খাই। আমার মনে চাইলে বিরিয়ানিও খাই!’

বিবিজান। তার অনেক পরিচয়। রাজশাহী শহরের মিয়াপাড়ার পিএন স্কুলের সাথে লাগোয়া রাস্তাটিতে ঝাড়ুদারের দায়িত্ব ছিল তার। সেই দায়িত্বে তাকে কখনোই অবহেলা করতে দেখা যায়নি। প্রতিদিন নিয়ম করে রাস্তা ঝাড়ু দিতেন তিনি। মাঝেমাঝে নিয়মের বাইরে গিয়ে দিনে একাধিকবারও ঝাড়ু দিতেন। তাতে কিছু মনে করত না কেউ, পাগল মানুষ! কখনো বদমেজাজি পাগল, কখনো ঝাড়ুদার পরিচয়ে রাজশাহী শহর তাকে বুকের ভেতর আশ্রয় দিয়েছিল।

তার বসবাসের জায়গাটি আরও অদ্ভুত। পিএন স্কুলের পাশের একটি বাণিজ্যিক ভবনের এক কোণায় এক টুকরো জায়গা ছিল ইলেকট্রিক তার, বৈদ্যুতিক মিটার ইত্যাদির জন্য। ওইটুকু জায়গাতেই একটি পর্দা টানিয়ে থাকতেন তিনি। সম্পদ বলতে তার ছিল একটি মোবাইল ফোন। আর নেশা বলতে ছিল গান শোনা। ঝাড়ু দেয়ার কাজ শেষ করে, ভদ্রলোকেদের অত্যাচার মোকাবেলা করে বাকীটা সময় তাকে মোবাইল ফোনে গান ছেড়ে দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যেত।

বিবিজানের আরো একটি পরিচয় তার হাজার পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যায়, তিনি একজন যোদ্ধা। সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নয়, যেসব মানুষের যুদ্ধ একাত্তরের যুদ্ধের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়নি, তেমনই এক যোদ্ধা তিনি। বরং, যুদ্ধোত্তর সমাজ তাকে এমন এক নতুন যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যা আজও লড়ে যাচ্ছেন তিনি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিবিজানের জীবনে অপূরণীয় একটা প্রভাব ফেলে গেছে। বিবিজানের ভাষ্যমতে, তার বাপ-ভাই যুদ্ধের সময়ে মারা যায়, পাক আর্মির গুলি খেয়ে। ‘আমি একাই এপারে ছিলাম’ বলেন বিবিজান।

অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে নিজের ত্যাগ ও মহিমার বয়ান দেবার মত অবস্থায় না থাকায় এ নিয়ে অনেক মত-দ্বিমত রয়েছে। মিয়াপাড়াতেই গৃহপরিচারিকার কাজ করা আঞ্জুরা খাতুন জানান, 'মুক্তিযুদ্ধে ওনার পরিবারের সবাই মারা গেছে। উনি নিজেও নাকি যুদ্ধ করেছেন শুনি। একারণেই তারে কেউ ঘাঁটায় না, নিজের মত থাকে।'

অনেকেই আবার মনে করেন, বিবিজান হয়তো ধর্ষিত হয়েছিলেন যুদ্ধের সময়।

একাত্তরে বিবিজানের যুদ্ধের স্বরূপ কেমন ছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও একাত্তরই যে তার সবটা কেড়ে নিয়ে তাকে এক নিয়ত যুদ্ধের জীবন উপহার দিয়েছে, সে বিষয়ে আর কোনো দ্বিমত থাকে না। যুদ্ধের আগে হয়তো তার আরো কোনো পরিচয় ছিল। যুদ্ধের কঠিন জীবন ও বাস্তবতা সেই পরিচয় থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে এই বৃদ্ধাকে। একটি স্বাধীন দেশের জন্য কত মানুষকে কতভাবে মূল্য চুকোতে হয়, তার এক উদাহরণ হয়ে আছেন বিবিজান।

মাঝখানে হঠাৎ আমরা বিবিজানকে হারিয়ে ফেলি। টানা দেড়মাস বিবিজান কোথাও নেই। তার থাকার খুপরিটিও ফাঁকা। দেড়মাস পর, সেই আগের চেনা রাস্তায় বসে আছেন বিবিজান, হাতে মোবাইল। কোথায় ছিলেন জিজ্ঞেস করতেই ভাঙা গলায় জিহ্বার জড়ানো উচ্চারণে বললেন, 'আমার মাথায় একটা টিউমার হইছিল। রিকশার সাথে ধাক্কা খেয়ে ফেটে যায়। হাসপাতালে ছিলাম।'

বিবিজান এখন সুস্থ। কিন্তু আগের মত আর রাস্তা ঝাড়ু দিতে পারেন না তিনি। রাস্তার পাশে একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের বারান্দায় বসে থাকেন সারাদিন।

ওই কার্যালয়ের পাশেই দীর্ঘদিনের পুরনো এক চায়ের দোকানের মালিক হারান চন্দ্র সরকার জানান, 'প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ওনাকে এখানে দেখি। এখানকার লোকজনই তাকে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ ধরে দিয়েছিল। কিছু টাকাও দেয় সিটি কর্পোরেশন প্রতিমাসে।'

এখন তো আর ঝাড়ু দিতে পারেন না, কীভাবে তার চলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনও তাকে প্রতি মাসে প্রায় আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এখানকার মানুষই নেতাদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করে দিয়েছে।'

একথা বলতেই হয়, বাংলাদেশের আর দশটা গৃহহীন নারীর চাইতে অনেক সুখের জীবন তার। একটা সময় পরিশ্রম করে রোজগার করেছেন, সেই টাকায় চলেছেন। এখন আর সেই পরিশ্রম করতে পারেন না, কিন্তু তার আশেপাশের মানুষ তাকে ছেড়ে চলে যায়নি। অন্তত মুখে খাবারটুকু জোগানোর ন্যূনতম ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সুখে দুঃখে, তিক্ততা বা ভালোবাসায় এই শহরের সাথে এক অদ্ভুত মায়ার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বিবিজানের। এ শহর তাকে ছেড়ে চলে যাবে না।

বিবিজান এখন আর তার আগের জায়গাটিতে থাকেন না। মাথায় অপারেশনের পর থেকে শরীর আরো ভেঙে গেছে। মিয়াপাড়াতেই ওই রাজনৈতিক কার্যালয়ের বারান্দায় থাকেন সারাদিন, রাতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েন।

নিজের জীবন নিয়ে তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই, কখনোই ছিল না। বোঝা যায়, যখন এভাবে বাইরে ঘুমাতে কষ্ট হয় কিনা জানতে চাইলে সহজ গলায় বলেন, কষ্ট তো হয়ই একটু! যেন বলতে চাইলেন কষ্ট তো জীবনেরই অংশ, এত বিচলিত হবার তো কিছু নেই।

ইদুর দৌঁড়ের এই সময়ে বিবিজানের জীবন দর্শন আমাদের ভাবাতে শেখাক নতুন করে।