ঢাকা, বুধবার ২৪, এপ্রিল ২০২৪ ২২:৪১:৪১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ফের কমল স্বর্ণের দাম মক্কা ও মদিনায় তুমুল বৃষ্টির শঙ্কা খালেদার গ্যাটকো মামলায় চার্জগঠনের শুনানি পেছাল কুড়িগ্রামে তাপদাহ: বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা

একাত্তরের অগ্নিকন্যা রোকেয়া সুলতানা

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:০৬ পিএম, ২২ মার্চ ২০২১ সোমবার

একাত্তরের অগ্নিকন্যা রোকেয়া সুলতানা রাকা

একাত্তরের অগ্নিকন্যা রোকেয়া সুলতানা রাকা

একাত্তরের অগ্নিকন্যা কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্য অবদান রেখেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের নারীদের ভূমিকা অপরিসীম। যুদ্ধ শুরুর হওয়ার অনেক আগে থেকেই তাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেন। অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চে ভাষণ দেয়ার পর নারী সমাজ বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
নারী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে সশস্ত্র ছাত্র বিগ্রেড গড়ে তোলা হয়। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্রীদের নেতৃত্বে বিগ্রেড পরিচালিত হতে থাকে। বিগ্রেড পরিচালনায় যে সব মেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা অন্যতম।
১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ। মেয়েরা দলে দলে যোগ দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ডামি রাইফেল নিয়ে (কাঠের) তারা প্রতিদিন সকালে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন। মার্চপাস্ট থেকে শুরু করে রোলিং, রেকি সবই শেখেন তারা। সাধারণ মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য ৮/১০দিন পর ঢাকার রাস্তায় প্রদর্শনীমূলক মার্চপাস্ট করেন এই মেয়েরা। বাংলার দামাল মেয়েদের সশস্ত্র মার্চপাস্টের এই দলে তৎকালীন ছাত্রনেত্রী কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা ছাড়াও আরও ছিলেন ডা. নেলি, আয়শা খানম, তাজিম সুলতানা, কাজী মমতা খানম, রওশন আরা, নাজমা বেগম চুনী, জিয়াউন নাহার রোজী, বেবী মওদুদসহ অনেকেই।
১৯৭১ সালে রোকেয়া সুলতানা রাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী ছিলেন। ১ মার্চ শরীরে প্রচন্ড জ্বর নিয়েও হল থেকে বেড়িয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দেন তিনি। ছেলেদের আগেই রোকেয়া হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে মেয়েরা প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলো।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নারীরা কখনও গেরিলা যুদ্ধে, কখনও সম্মুখযুদ্ধে, কখনও সেবিকা হিসেবে, কখনওবা বার্তাবাহক হিসেবে অমূল্য অবদান রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সূচনালগ্ন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন কাজী রোকেয়া সুলতানা৷ রাজধানী ঢাকা ছাড়াও যুদ্ধের সময় বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেন তিনি৷
১৯৪৮ সালের ১৬ অক্টোবর বর্তমান মাগুরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন কাজী রোকেয়া সুলতানা৷ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী৷ একইসাথে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথেও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি৷ সুবক্তা হিসেবে তার খ্যাতি সেই ছাত্র জীবন থেকেই৷ এছাড়া দেশের বিভিন্ন সংকটময় পরিস্থিতিতে নীতি নির্ধারণী ক্ষেত্রেও তার ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ৷
রোকেয়া এবং তার সহকর্মী ছাত্র নেতারা তাই সত্তরের নির্বাচন পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছাত্রী ও নারী সমাজকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার এবং এই প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন৷ অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে প্রায় প্রতিদিনই তাদের কাটতো মিছিল-সমাবেশ আর আন্দোলনের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে৷ সারাদিনের কর্মসূচি শেষ হতো শহীদ মিনার চত্বরে পরের দিন কি কাজ করার হবে তার নির্দেশনা ঘোষণার মধ্য দিয়ে৷ এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম তথা শরীরচর্চা কেন্দ্রের সামনের মাঠে শুরু হয় মেয়েদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি৷
এ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে কাজী রোকেয়া সুলতানা বলেন, ‘আমরা যখন দেখলাম শতভাগ ছাত্রীরা বলছে, পাকিস্তানি বাহিনী যদি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে আমরাও তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়াবো৷ এসময় সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের অস্ত্র চালনার কোন দক্ষতাই ছিল না৷ তাই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু করলাম৷ প্রাথমিকভাবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় রেঞ্জার ইউনিটের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেই৷ আমাদের হাতে ভারি অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় আমরা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা অভিযানের জন্যই নিজেদের বিশেষভাবে প্রস্তুত করি৷'
তিনি জানান, ২০ মার্চের পর সাধারণ মানুষের বেশে পাকসেনাদের শহরের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল৷ যাতে করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহজ হয় পাকবাহিনীর পক্ষে৷ এ সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে ছাত্রীদের ঢাকায় আত্মীয় স্বজনের বাড়ি অথবা গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়। ছাত্রীদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়৷
২৫ মার্চ ঢাকায় পাকসেনাদের অভিযানের বিরুদ্ধে সহকর্মীদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সেই স্মৃতি স্মরণ করে রোকেয়া সুলতানা জানান, ‘আমার বাড়ি ছিল ধানমন্ডিতে৷ তৎকালীন ইপিআর-এর প্রধান ফটকের কাছে৷ ২৫ মার্চ যখন বেতার সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেল তখন আমার বাড়ির সামনে সবাই এসে জড়ো হলো। তারা জানালো, উত্তর পাড়া থেকে তারা বের হচ্ছে৷ এর অর্থ হচ্ছে সেনানিবাস থেকে তারা বের হচ্ছে৷ আমরা স্পষ্টভাবে পরিচিত শব্দ ব্যবহার করতাম না৷ যাহোক, এসময় সবাইকে বলে দিলাম, এক পাও আমরা পিছু হটবো না৷ বালির বস্তা, ইটের বোঝা, গাছপালা যা কিছু আছে সেগুলো দিয়ে বড়পথগুলোতে ব্যারিকেড তৈরি করতে বলা হলো সবাইকে৷ অল্প সময়ের মধ্যেই ঐ অঞ্চলের প্রায় সবদিকে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হলো৷’
তিনি বলেন, ‘এরপরে আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে দেখতে পেলাম প্রথমে পুলিশ লাইনে, দ্বিতীয়ত তৎকালীন ইপিআর এবং এরপরেই নিলক্ষেতে আগুন জ্বলছে৷ এভাবে রাত ১০টা থেকে প্রায় একটা-দেড়টা পর্যন্ত মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম৷ এরপর মাইকে ঘোষণা শুনতে পেলাম উর্দু ভাষায়৷ সবাইকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিচ্ছিল। বলা হচ্ছিল বাড়ির ছাদ থেকে পতাকা নামিয়ে ফেলতে৷ দেখা গেছে ওই ঘোষণা শুনে যারা পতাকা নামাতে বাড়ির ছাদে উঠেছে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়েছে৷ আমি দেখলাম একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে পতাকা নামাতে ছাদে উঠেছেন৷ সঙ্গে সঙ্গে গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি৷'
২৮ মার্চ আগরতলায় যাওয়ার জন্য সহকর্মীরা তাকে নিতে আসলেও বাবার নির্দেশের কারণে সেসময় যাওয়া হয়নি৷ এরপর ঢাকা থেকে ডেমরায় গিয়ে কিছুদিন এক শ্রমিকের বাড়িতে ছিলেন তিনি৷ সেখানে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় কাজ করেছেন৷ এরপর ১৪ এপ্রিল চলে যান কেরানিগঞ্জ এলাকায়৷
অবশেষ ৪ জুন কলকাতায় পাড়ি জমান রোকেয়া৷ সেখানে গিয়ে পুরোদমে মুক্তিযুদ্ধের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন৷ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেন। ঘুরে ঘুরে ত্রাণ সংগ্রহ করেন৷ তখন থেকেই মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দের সাথে নিয়মিত সমন্বয়ের মাধ্যমে নানা কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন কাজী রোকেয়া সুলতানা৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন কমিউনিস্ট ধারার রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে দেশ গড়ার কাজ করেন মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া সুলতানা৷পরে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষা জগতে প্রবেশ করেন এই বীর যোদ্ধা৷ লালমাটিয়া কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অবসর গ্রহণ করেন৷
কৃতজ্ঞতা : ডয়চে ভেলে