ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ১৩:১৯:১৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতি গর্ব করবে : প্রধান উপদেষ্টা তলবের ১০ মিনিটেই হাজির জেডআই খান পান্না, চাইলেন নিঃশর্ত ক্ষমা ‘পরিবেশ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার’

ঘোষণা দিয়েও আলু কেনেনি সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:৫৭ এএম, ২ নভেম্বর ২০২৫ রবিবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

কৃষকের লোকসান কমাতে ৫০ হাজার টন আলু কেনার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। পাশাপাশি বলা হয়েছিল, হিমাগারের ফটকে আলুর কেজির সর্বনিম্ন দর হবে ২২ টাকা। গত ২৭ আগস্টের কৃষি মন্ত্রণালয় সেই ঘোষণার দুই মাস পার হলেও কেনা হয়নি আলু, কৃষক পাননি ২২ টাকা দর। ফলে হিমাগার ও বাজারে আরও পড়েছে দাম। এতে মৌসুমজুড়ে আলু নিয়ে হাহাকারে থাকা কৃষক আরও গাড্ডায় পড়েছেন।

এখন পাইকারি বাজারে আলুর কেজি কেনাবেচা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকায়, যা খুচরায় ১৫ থেকে ২০ টাকা। মাসখানেক আগেও দাম ছিল ২৫ টাকা। চাহিদার চেয়ে প্রায় ৪০ লাখ টন বেশি উৎপাদন হওয়ায় সরবরাহের স্রোতে বাজারে দর পতন হয়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত এক বছরে আলুর দর কমেছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। 

হিমাগার মালিক সমিতির তথ্য বলছে, দেশের ৩৪০ হিমাগারে এখনও প্রায় ২০ লাখ টন আলু বিক্রি হয়নি। হিমাগারে আলুর দাম নেমে এসেছে কেজিপ্রতি ৯ থেকে ১১ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচই ওঠানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ কৃষকদের। তারা বলছেন, ২২ টাকা দাম ঘোষণার আগে পাইকারিতে ১৬ থেকে ১৭ টাকায় বিক্রি হয়। সরকার দাম বেঁধে দেওয়ার পর উল্টো ৯ থেকে ১১ টাকায় নেমেছে। এ পরিস্থিতিতে কৃষকদের ক্ষতি কমাতে দ্রুত সরকারি ক্রয় কার্যক্রম শুরুর দাবি জানিয়েছে হিমাগার মালিক সমিতি। পাশাপাশি আগামী মৌসুমে চাষির জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সংকটের মূল কারণ বেশি উৎপাদন, রপ্তানি বাজারের সীমাবদ্ধতা এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। গত নভেম্বরে দাম বেশি থাকায় এবার কৃষকরা লাভের আশায় বেশি জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। তবে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত উৎপাদন ও সরকার ঘোষিত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে। 

সব হিমাগারে আলুর স্তূপ

এখন বিভিন্ন অঞ্চলে হিমাগারেই স্তূপ হয়ে আছে আলু। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এই মৌসুমে ৪.৬৭ লাখ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫.২৪ লাখ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টন, যা চাহিদার চেয়ে প্রায় ৪০ লাখ টন বেশি। বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) তথ্য বলছে, দেশের বার্ষিক চাহিদা ৯০ লাখ টন। তবে বিভিন্ন হিমাগারে এখনও প্রায় ২০ লাখ টন আলু মজুত আছে।

রাজশাহীর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহানা আখতার জাহান বলেন, বাজারে দর পতনের মূল কারণ অতিরিক্ত উৎপাদন। আগের বছর দাম বেশি পাওয়ায় এবার কৃষকরা বেশি জমিতে চাষ করেছেন। সরকার ২২ টাকা আলুর দর নির্ধারণ করে দিলেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। রাজশাহীতে গত অর্থবছরের চেয়ে এবার তিন হাজার ৫৪৫ হেক্টর বেশি জমিতে আলু আবাদ হয়েছে, উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯২ হাজার টন।

রাজশাহীর তানোরের চাষি রানা চৌধুরী জানান, তিনি হিমাগারে এক হাজার ২৫০ বস্তা আলু রেখেছেন, তবে এক কেজিও বিক্রি করতে পারেননি। সরকার বলেছিল, ২২ টাকায় আলু কিনবে। এখন ৯ টাকাতেও ক্রেতা নেই।

মুন্সীগঞ্জের চিত্র আরও নাজুক। সেখানে হিমাগারে আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৮ টাকায়, যেখানে উৎপাদন ও সংরক্ষণ খরচ ২৬ থেকে ২৮ টাকা। 

কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি কেজিতে ১৬ থেকে ১৮ টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে। জেলা কৃষি অফিসের হিসাবে, এভাবে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩৫ কোটি টাকা।

মুন্সীগঞ্জের কৃষক সাহারা বেগম বলেন, স্বামী অসুস্থ, তিন ছেলেমেয়ের দায়িত্ব আমার। আলুর পেছনে সাড়ে তিন লাখ টাকা ধার করেছি। এখন সব ঋণ ঘাড়ে চেপে বসেছে।

বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস হিমাগারের ব্যবসায়ী ফজর আলী বলেন, চার দিন আগে ১০ টাকা দরে ছয় হাজার বস্তা আলু কিনেছিলাম। এখন দাম আট টাকায় নেমেছে। চার দিনেই ছয় লাখ টাকা লোকসান।

বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, রংপুর ও লালমনিরহাটের পরিস্থিতিও অভিন্ন। বগুড়ায় সাধারণত এ সময়ের মধ্যে হিমাগারের ৭০ শতাংশ আলু বিক্রি হয়ে যায়, এবার বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ। জয়পুরহাটের ১১ হিমাগারে রাখা আলুর দর পড়ে যাওয়ায় কৃষক-ব্যবসায়ীর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৭৭ কোটি টাকা। নওগাঁয় প্রতি কেজিতে ১০ টাকা লোকসান ধরে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা।

রংপুর অঞ্চলের পরিস্থিতিও জটিল। কৃষক ও ব্যবসায়ীর হিসাবে, এবার হিমায়িত আলুতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ছুঁইছুঁই।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, আলু ক্রয়ের সরকারি ঘোষণা কার্যকর না হওয়ায় কৃষকরা টিকে থাকতে পারছেন না। তাদের দাবি, সরকার দ্রুত ঘোষিত ৫০ হাজার টন আলু কেনার কার্যক্রম শুরু করুক, নয়তো আগামী মৌসুমে অনেকেই আলু চাষ থেকে সরে যাবেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মুন্সীগঞ্জের উপপরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, আলু চাষ মুন্সীগঞ্জের কৃষকের ঐতিহ্য। দাম কমলেও তারা চাষ ছাড়েন না। এবার টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। কৃষকদের বাঁচাতে আলু রপ্তানি ও আলুভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা জরুরি।

তিন মন্ত্রণালয়ে বিসিএসএর চিঠি

চাষিকে দ্রুত প্রণোদনা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। এ অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি সংগঠনটি কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। 

চিঠিতে বলা হয়, এবার আলুর দর পতন হওয়ায় আগামী মৌসুমে বেশির ভাগ কৃষক চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশকসহ অন্যান্য খরচের সংস্থান করতে পারবে না। তাই দেশের চাহিদামতো প্রায় ৯০ লাখ টন আলু উৎপাদন করতে হলে অক্টোবরের মধ্যেই আলুচাষিকে প্রণোদনা দেওয়া জরুরি।

তবে কী ধরনের প্রণোদনা প্রত্যাশা করা হচ্ছে, সেই বিষয়ে বিসিএসএর চিঠিতে স্পষ্ট করা হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিসিএসএর সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, গত আগস্টে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এ বিষয়ক প্রজ্ঞাপনে কী ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। চাষিরা যেহেতু লোকসানে পড়েছেন তাই তারা আর্থিক প্রণোদনাই চান। 

চিঠিতে শঙ্কা প্রকাশ করে হিমাগার মালিকরা বলেন, যদি সরকার ঘোষিত প্রণোদনা পেতে দেরি হয় তবে অনেক কৃষক নিরুপায় হয়ে হিমাগারে সংরক্ষিত তাদের প্রায় ৯ লাখ টন আলুবীজ খাবার আলু হিসেবে বেচে দিতে পারেন। এতে দেশে চাহিদামতো আলু উৎপাদন নাও হতে পারে। ফলে গত বছরের মতো আবারও আলুর কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় ঠেকতে পারে। 

সরকার আলু কিনে টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি করার কথা ছিল। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টিসিবি চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ ফয়সাল আজাদ বলেন, সরকার খুব শিগগির আলু কেনা শুরু করব।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আলুর বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ সময়মতো ও বাস্তবসম্মত না হওয়ায় কৃষকরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ঘোষিত ন্যূনতম দাম কার্যকর হয়নি। ফলে উৎপাদকরা নিরুৎসাহিত হয়েছেন, যা আগামী মৌসুমে চাষ কমিয়ে দিতে পারেন। বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে সরকারকে এখনই পরিকল্পিতভাবে বাফার স্টক গড়ে তোলা, ন্যূনতম দাম বাস্তবায়ন এবং রপ্তানির নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে– নইলে আগামী বছর আবারও আলুর বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে।