ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ১৭:২২:৪২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

মুক্তিবেটি কাঁকন বিবির যুদ্ধকথা

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:৫১ পিএম, ২ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি।  ফাইল ছবি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি। ফাইল ছবি।

খাসিয়াকন্যা কাঁকন বিবি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর সশস্ত্র যোদ্ধা ও গুপ্তচর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাকবাহিনীকে হটাতে ৫ নম্বর সেক্টরের হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন এবং গুপ্তচরের কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে।

কাঁকন বিবির আসল নাম কাঁকাত হেনিনচিতা। তিনি এলাকার মানুষের কাছে মুক্তিবেটি নামে পরিচিত। সুনামগঞ্জ জেলার খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক পরিবারে জন্ম তার। তার মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে।

১৯৭০ সালে দিরাই উপজেলার শহীদ আলীর সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নাম পরিবর্তিত করে রাখা হয় নুরজাহান বেগম। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তিনি একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। মেয়ের নাম রাখা হয় সখিনা বিবি। কিন্তু মেয়ে জন্ম দেয়ায় স্বামীর সাথে তার মনোমালিন্য দেখা দেয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে মৌখিক ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে এপ্রিলে ইপিআর সৈনিক মজিদ খানকে বিয়ে করেন তিনি। মজিদ খান তখন কর্মসূত্রে সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে থাকতেন।

দুই মাস সিলেটে স্বামীর সাথে বসবাস করার পর কাঁকন বিবি সখিনাকে আনতে আগের স্বামীর বাড়িতে যান। মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসার পর দেখেন মজিদ খান বাড়িতে নেই। কয়েকদিন অপেক্ষার পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার স্বামী বদলি হয়েছেন। তিনি দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোনো এক ক্যাম্পে আছেন।

১৯৭১ সালের জুন, পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে মুক্তিবাহিনীর। উত্তাল সারা বাংলা। আর অপেক্ষা না করে কাঁকন বিবি স্বামীকে খুঁজতে বের হন। সীমান্তের কাছে ঝিরাগাঁও গ্রামে শহীদ আলী নামে একজনের আশ্রয়ে মেয়ে সখিনাকে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পের দিকে যান তিনি। এ সময় পাকবাহিনীর কাছে ধরা পড়েন কাঁকন বিবি। কয়েক দিন অমানুষিক নির্যাতনের পর তাকে ছেড়ে দেয় পাকসেনারা।

এই অমানবিক ঘটনার পর কাঁকন বিবি স্বামীকে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন। জুলাই মাসে তার সাথে দেখা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী তার সাথে সেক্টর কমাণ্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকতের সাথে দেখা করিয়ে দেন। তার উপর দায়িত্ব পড়ে গুপ্তচর হিসেবে বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করার। তিনি অসমসাহসিকতার সাথে বিভিন্ন রূপে পাকিস্তানীদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ করতে থাকেন। তার সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সফল আক্রমণ চালান।

গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাক বাহিনীর হাতে আবারও ধরা পড়েন কাঁকন। এবারে একনাগাড়ে ৭ দিন পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকারেরা তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেয়া হয়। একদিন প্রচন্ড নির্যাতনের কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। এক পর্যায়ে মৃত ভেবে অজ্ঞান কাঁকন বিবিকে পাকবাহিনী ফেলে রেখে যায়। কয়েকদিন পরে জ্ঞান ফিরে আসলে তাকে উদ্ধার করে বালাট সাবসেক্টরে নিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধারা। সুস্থ হয়ে তিনি আবারও ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে। এরপর তিনি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একই সঙ্গে আবারও গুপ্তচরের কাজ শুরু করেন।

এরপরে প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন অসীম সাহসী কাঁকন বিবি। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাকসেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। এই যুদ্ধে তার দেহে কয়েকটি গুলি লাগে। উড়ুতে কয়েকটি গুলির চিহ্ন তিনি আজীবন বহন করে গেছেন।

দেশ স্বাধীন হলে কাঁকন বিবি দোয়ারাবাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে এক ব্যক্তির কুঁড়েঘরের বারান্দায় মেয়ে সখিনাসহ আশ্রয় নেন। এরপরের প্রায় ২ যুগ তিনি ছিলেন সবার চোখের অন্তরালে। স্বাধীনতার ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে সাংবাদিক রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু তাকে ভিক্ষারত অবস্থায় খুঁজে পান। এরপর দেশব্যাপী এই বীর নারীকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে এক একর খাস জমি দান করেন। সিলেটের সে সময়ের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান তাকে ওই জায়গায় একটি ছোট কুঁড়েঘর নির্মাণ করে দেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ওই জমিতেই ছোট্ট কুড়ে ঘরে বসবাস করতেন তিনি। একমাত্র মেয়ে সখিনা বিবি ও মেয়ের জামাই রফিক মিয়াকে নিয়েই ছিলো তার সংসার। এরপরের কয়েক বছর মোটামুটি ভাল কাটলেও পরবর্তীতে অর্থাভাবে নিয়মিত চিকিৎসা করাতেও পারেননি তিনি।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী তাকে বীরপ্রতীক উপাধীতে ভূষিত করার ঘোষণা দেন। কিন্তু আজও তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি।

ব্রেন স্ট্রোক করে ২০১৭ সালের ২১ জুলাই ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কাঁকন বিবি। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের ২০ মার্চ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তিনি আবারও ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ২১ মার্চ বুধবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।