ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:০৪:২৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতি গর্ব করবে : প্রধান উপদেষ্টা তলবের ১০ মিনিটেই হাজির জেডআই খান পান্না, চাইলেন নিঃশর্ত ক্ষমা ‘পরিবেশ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার’

স্কুটিতে নতুন গতি পাহাড়ের নারীদের

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:০৫ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০২৫ রবিবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ–সব ক্ষেত্রেই গৌরবময় ইতিহাস চট্টগ্রামের। এই বিভাগে আছে সাগরের বর্ণিল রূপ, পাহাড়ের সতেজতা। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, প্রধান পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জ কিংবা পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত এই বিভাগে। আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈচিত্র্যের সম্ভার। পর্যটনের অপার সম্ভাবনা চট্টগ্রাম বিভাগকে দিয়েছে আলাদা এক পরিচয়

ভৌগোলিক বৈরিতা আর জীবন বাস্তবতায় পাহাড়ের নারীরা প্রতিনিয়তই সংগ্রামমুখর জীবনের মুখোমুখি হন। প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এই জীবনযাপনের রং ও মাত্রা ভিন্ন হলেও বিষয়টি প্রায় একই রকম। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর পাহাড়ের নারীদের জীবনে বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে এনজিওগুলোর তৎপরতা। দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থার নানামুখী কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের বড় একটি জায়গাজুড়ে স্থান করে নেন শিক্ষিত নারীরা। কিন্তু মাঠে-অফিসে, অংশীজনের দুয়ারে, প্রশাসনিক কাজে শহরে হোক আর তৃণমূলে স্থানীয় সরকারে– যেখানেই যাবেন, পথ তো বন্ধুর।

পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে বান্দরবান প্রায় পুরোটাই সুউচ্চ পাহাড়, রাঙামাটির অধিকাংশ পানিপথ আর খাগড়াছড়ি হলো পাহাড়ের মাঝে মাঝে সমতল জনপথ। চলাচলের সুবিধার্থে এই খাগড়াছড়িতেই সবার আগে নারীরা পথে নামান নিজের বাহন স্কুটি। এখন শুধু বাইক হাঁকিয়ে স্বচ্ছন্দে পথচলা নয়, নিজেদের মধ্যে দারুণ যূথবদ্ধতাও তৈরি হয়েছে নারীদের। দুটি অনলাইন গ্রুপ গড়ে তোলে দূরদূরান্তে ভ্রমণের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমও পরিচালনা করছেন তারা। 

খাগড়াছড়ি শহরের জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী ও স্কুলশিক্ষক সুচরিতা রোয়াজা প্রথম বাজাজের একটি ৫০ সিসির স্কুটি কেনেন। তিনি এই বাহনে হাটবাজারে, অফিস-আদালতে দাপিয়ে বেড়ানো শুরু করলে তা সবার দৃষ্টি কাড়ে। তাঁর পথ ধরে খাগড়াছড়িতে বড় এনজিওগুলো আগ্রহী নারীকর্মী ও কর্মকর্তাদের বাহন হিসেবে স্কুটি সরবরাহ করতে থাকে। এখন খাগড়াছড়ি জেলার যে প্রান্তেই যাওয়া যায়, পাকা-আধাপাকা সড়ক–এমনকি প্রত্যন্ত মেঠোপথেও স্কুটি আরোহী নানা বয়সের নানা পেশার নারীর দেখা মেলে।

খাগড়াছড়ির প্রথম লেডি বাইকার সুচরিতা রোয়াজা এখন ফ্রান্সপ্রবাসী। শহরে প্রথম স্কুটি চালানোর অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পেশায় শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন পরিচিত নৃত্যশিল্পী হওয়ার পরও স্কুটি চালিয়ে কোথাও গেলে আশপাশ থেকে নানা বিরূপ মন্তব্য এবং তির্যক চাহনির শিকার হতে হতো। আমি এসব এড়িয়ে টানা অর্ধযুগ বাইক চালিয়েছি।’

এখন খাগড়াছড়ি জেলাজুড়ে এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ছয় লাখ টাকা দামের দুইশরও বেশি স্কুটির চাকা ঘোরাচ্ছেন নারীরা। জাতীয় নারী ফুটবলের সাবেক সদস্য আনুচিং মারমাসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মোটরসাইকেলও ব্যবহার করেন। আনুচিং বলেন, ‘দেশে-বিদেশে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছি। তাই সাহস করেই মোটরসাইকেল চালাই। প্রথম দিকে মানুষজন আড়চোখে তাকালেও এখন আর কিছু বলে না।’ 

বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠক ও গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সব ক’টিই মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃপ্রধান। অথচ এ ধরনের সমাজের মধ্যেও নারীরা বাইক চালাতে খুব বেশি স্বস্তিবোধ করেন না। আমরা আমাদের বিভিন্ন প্রকল্পে নারীকর্মীদের বাইক দিতে চাই। অনেকে তা সহজে গ্রহণ করতে চান না।’ কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, বাইক চালানোর বিষয়টি সমাজ-পরিবার এখনও ইতিবাচকভাবে নিতে পারছে না।

খাগড়াছড়ির হোন্ডা মোটরসাইকেলের শোরুমের মালিক মো. ঈসমাইল জানান, তিনি গত পাঁচ বছরে রাঙামাটি আর খাগড়াছড়িতে কমপক্ষে ১০০টি লেডি বাইক বিক্রি করেছেন। এখনও মাসে গড়ে কমপক্ষে তিনটি বাইক বিক্রি করছেন।  

টিভিএস শোরুমের মালিক মো. আলাউদ্দিন বলেন, ২০১৮ সাল থেকে লেডি বাইক বা স্কুটির বাজার খাগড়াছড়িতে বাড়তে থাকে। এখন জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। আমরা মাসে গড়ে চার-পাঁচটি লেডিস বাইক বিক্রি করি।

ঘোরাঘুরি আর সমাজসেবা

খাগড়াছড়িতে নারী বাইকারদের দুটি সংগঠনও গড়ে উঠেছে। এরই একটি কেজিসি লেডি বাইকার গ্রুপের অ্যাডমিন নুর আয়েশা বেগম জানান, কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতসহ বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়া ও দৈনন্দিন কাজের জন্য নারীকে গণপরিবহনে যেতে হলে অনেক সময় নষ্ট হয়। নিজের বাহনে সময়-অর্থ এবং শ্রম দুটোই 
সাশ্রয় হয়।

২০২১ সালের ১১ আগস্ট কেলি চৌধুরী এই গ্রুপ তৈরি করেন। এরপর খাগড়াছড়ির নারী বাইকাররা মহালছড়ি-সিন্দুকছড়ি পর্যন্ত একটি গ্রুপ ট্যুর আয়োজন করেন, যা পরে একটি বড় কমিউনিটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গ্রুপের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে বান্দরবান, রাঙামাটি, চট্টগ্রামে গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে গ্রুপ ট্যুর করে নিজেদের জীবনে অ্যাডভেঞ্চার ও আনন্দের নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।

২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয় খাগড়াছড়ি ফিমেল রাইডারস গ্রুপ। এটির অ্যাডমিন হেলি চাকমা জানান, ৩০-৪০ জন সদস্য আছেন এই গ্রুপে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজও করা হয় এ গ্রুপের মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘আজ আমি স্কুটি চালাতে পারি বলে কর্মস্থল যেতে পারি স্বাধীনভাবে। আগে আমার স্বামীর ওপর নির্ভর করতে হতো।’

খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের সামনের একটি মোটরসাইকেল সার্ভিসিং প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আরফাদুল ইসলাম জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে মাসে কমপক্ষে ৩০ জন নারী স্কুটি নিয়ে বিভিন্ন সেবা নিতে আসেন। তিনি জানান, খাগড়াছড়িতে কমপক্ষে দুইশ নারী বাইক চালান। তারা দুর্ঘটনায়ও কম পড়েন। 
খাগড়াছড়ি বিআরটিএর সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী মো. মুছা জানান, ২০২৪ সালে তাঁর অফিস থেকে ৫৬ জন নারী ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং ২৪ জন নারী বাইকের রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন।  

২০১৪ সাল থেকে খাগড়াছড়িতে হিরো মোটরসাইকেলের শোরুম পরিচালনা করছেন সুদর্শন দত্ত। তিনি খাগড়াছড়ি চেম্বারেরও পরিচালক। তিনি জানান, খাগড়াছড়ি জেলাতে সড়ক নেটওয়ার্ক অন্য দুই পার্বত্য জেলার চেয়ে অনেক বেশি। এখানে প্রতিনিয়ত নারী বাইকারের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি অর্থনীতিতেও এটির একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

খাগড়াছড়ির নবাগত জেলা প্রশাসক আনোয়ার সাদাত জানান, সমতলে জীবনের গতির সঙ্গে বাইকের একটি অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। এখন পাহাড়েও নারীর বাইকযাত্রার গল্প বড় হচ্ছে। নারীর এই অগ্রযাত্রায় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের পক্ষ সৃজনশীল কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা, তা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে ঠিক করা হবে।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা বলেন, ‘জেলা পরিষদের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আমি কর্মজীবী এবং দক্ষ ও শিক্ষিত নারীদের কর্মতৎপরতায় যুক্ত করতে সচেষ্ট আছি। আমার এই উদ্যোগের বড় অংশজুড়ে এখন থেকে প্রাধান্য পাবে নারী বাইকাররা।’