ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ১৩:১০:২৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতি গর্ব করবে : প্রধান উপদেষ্টা তলবের ১০ মিনিটেই হাজির জেডআই খান পান্না, চাইলেন নিঃশর্ত ক্ষমা ‘পরিবেশ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার’

ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ৩০ বছর

তৌহিদা ইসলাম চুমকি | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:১৬ পিএম, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সোমবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট। মা–এর মুখ দেখার জন্য ঢাকাগামী বাসে উঠে দিনাজপুরে ফিরছিলেন কিশোরী ইয়াসমিন। বয়স তখন মাত্র ১৪। গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করলেও হৃদয়ে ছিল মায়ের স্নেহ পাওয়ার অপার আকাঙ্ক্ষা। পরদিন ভোররাতে দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে নেমে আসেন তিনি। বাসের সুপারভাইজার স্থানীয়দের হাতে তাকে তুলে দিলেও ভাগ্যে অপেক্ষা করছিল এক ভয়াল পরিণতি।

সেই রাতেই কোতোয়ালি থানার একটি টহল পুলিশ ভ্যান এসে ইয়াসমিনকে শহরে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে গাড়িতে তোলে। এরপর যা ঘটে, তা কেবল ইয়াসমিন নয়—বাংলাদেশের নারীর ইতিহাসে এক বিভীষিকাময় অধ্যায় হয়ে আছে। গাড়ির ভেতরে তিন পুলিশ সদস্য ইয়াসমিনকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করে। তার নিথর দেহ রাস্তার পাশে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় তারা।

ক্ষোভের আগুনে জ্বলেছিল দিনাজপুর

সকালে খবর ছড়িয়ে পড়তেই ক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে আসে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মিছিল, স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে শহর। অথচ পুলিশ প্রশাসন প্রথমে সত্য গোপনের চেষ্টা করে ইয়াসমিনকে “যৌনকর্মী” আখ্যা দিতে চায়। কিন্তু প্রতিবাদ থামেনি। ২৭ আগস্ট দিনাজপুরে আন্দোলন দমনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন কাদের, সামু, সিরাজসহ সাতজন। ইতিহাসের পাতায় কালো অক্ষরে লেখা হয়ে থাকে এই বর্বরতা।

এদিকে, বিচারকাজ দীর্ঘসূত্রিতার পর ১৯৯৭ সালে রংপুর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২০০৪ সালে কার্যকর হয় ফাঁসি। এএসআই ময়নুল ইসলাম, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার এবং চালক অমৃত লালের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও প্রশ্ন রয়ে গেছে—এটা কি শেষ? নাকি কেবল প্রতীকী বিচার?

কারণ ইয়াসমিন শুধু একজন কিশোরীর নাম নয়, তিনি নারী নির্যাতন প্রতিরোধের প্রতীক। তাঁর স্মরণে ২৪ আগস্টকে ঘোষণা করা হয় ‘ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’। তবু ৩০ বছর পরও নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, বৈষম্য যেন কমেনি, বরং নতুন রূপে বিস্তার লাভ করেছে।

তিন দশকের হিসাব: কতটা বদলাল সমাজ?

১৯৯৫ থেকে ২০২৫—দীর্ঘ ৩০ বছরে বাংলাদেশে নারীর অবস্থান কতটা বদলেছে? এ প্রশ্ন আজও তীব্রভাবে সামনে আসে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের এক গবেষণা ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে: ১৮–৪৯ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ স্বীকার করেছে, তারা জীবনে একবার হলেও নারীকে ধর্ষণ করেছে। দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ কখনও কোনো শাস্তির মুখোমুখি হয়নি।

আজও গণমাধ্যমে প্রতিদিন শিরোনাম হয় ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, খুন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতনের ভিডিও। দোষীদের বদলে অনেক সময় ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা হয়। পুলিশের বক্তব্য কিংবা প্রশাসনের ভাষ্যে উঠে আসে নারীর পোশাক, আচরণ কিংবা সময়ের প্রসঙ্গ—যেন অপরাধীর দায়কে আড়াল করার প্রচেষ্টা।

পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা: মূল কারণ

ধর্ষণের পেছনে অন্যতম কারণ হলো গভীরভাবে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। পরিবারে ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের একধরনের প্রশ্রয় দেওয়া হয়—যেন তারা জন্মগতভাবেই নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এ ধারণা থেকেই বড় হতে হতে তারা ভিন্ন লিঙ্গকে অবদমিত করার মনোভাব অর্জন করে।

একজন ছেলে যদি শিখেই বড় হয় যে নারী দুর্বল, নারী নিম্নশ্রেণির, তবে তার চোখে নারী কখনও সমান মর্যাদা পাবে না। সেই মানসিক বিকৃতি পরিণত হয় যৌন সহিংসতায়।

প্রতিরোধ কোথায়?

ইয়াসমিনের ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়—প্রতিরোধ ছাড়া মুক্তি নেই। পরিবার থেকে শুরু করতে হবে পরিবর্তন। মা–বাবাকে শেখাতে হবে ছেলেকে মানুষ হিসেবে বড় করে তোলা, নারীকে সমান মর্যাদা দেওয়া। শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে সেক্স এডুকেশন—যেখানে শিশুরা বুঝবে শরীর, স্পর্শের ভালো-মন্দ, এবং সম্মানের গুরুত্ব।

সমাজে এ নিয়ে জোরালো জনমত গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষণকে কেবল আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে না দেখে সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তর করতে হবে। নারীর নিরাপত্তা, মর্যাদা, সম্মান নিশ্চিত করতে হলে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভাঙতেই হবে।

গণমাধ্যমের ভূমিকা

১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন হত্যার পর গণমাধ্যম সাহসিকতার সঙ্গে বিষয়টি সামনে এনেছিল। আজ ৩০ বছর পর সেই সাহস কি যথেষ্ট আছে? গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ, নৈতিক অবস্থান দুর্বল। অথচ সমাজের পরিবর্তনে সাংবাদিকতার ভূমিকা অপরিসীম।

যদি সত্য প্রকাশ না পায়, যদি প্রতিবাদ স্তব্ধ হয়, তবে ইয়াসমিনের আত্মাহুতির শিক্ষা বৃথা হয়ে যাবে।

ইয়াসমিনের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার আড়ালেই কখনও কখনও ঘটে নারীর ওপর ভয়াবহতম সহিংসতা। আজও বাস্তবতা বদলায়নি। ধর্ষণ থামেনি, বরং ভয়াবহতায় বেড়েছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিরোধের চর্চা না থাকলে আগামী দিনের ইয়াসমিনেরা আরও অরক্ষিত থেকে যাবে।

এখনও সময় আছে। ইয়াসমিনের আত্মাহুতিকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে প্রতিরোধের আন্দোলন জোরদার করতে হবে। নয়তো আমরা সেই তিমিরেই থেকে যাব, যেখান থেকে তিন দশক আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল।