ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৮, ডিসেম্বর ২০২৫ ২৩:১৮:০১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
‘ভারতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে টানাপড়েন আছে’ বাংলাদেশ হাইকমিশনারকে তলব করে যা জানিয়েছে ভারত মা-মেয়ে হত্যা : সেই গৃহকর্মীর দোষ স্বীকার যুগ্ম সচিবকে জিম্মি করে ৬ লাখ টাকা চাঁদা দাবি চালকের অমর একুশে বইমেলা শুরু ২০ ফেব্রুয়ারি

রোনালদোর দেশে যাচ্ছেন ময়মনসিংহের ৩ ফুটবলকন্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০১:০৬ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০২২ বৃহস্পতিবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিদপ্তরের উদ্যোগে বঙ্গমাতা নারী ফুটবলের সেরা ৪০ খেলোয়াড়কে নিয়ে বিকেএসপিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ করে। তাদের মধ্য থেকে ১৬ জনের একটি দল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দেশ পর্তুগালে যাবে। এর মধ্যে ৫ জন অতিরিক্ত এবং ১১ জন খেলবে মূল দলে। সেখানে গিয়ে তারা ফুটবল খেলার উপর প্রশিক্ষণ নেবে। ওই এগারো জনের দু’জন হচ্ছে শিখা, ঝিলি। আর তানিশা রয়েছে অপেক্ষমাণ ৫ জনের কাতারে। 

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে-২০১৮ সালে রানার আপ ও পরের বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়া নান্দাইলের পাঁচরুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টিমের সদস্য ছিল ওই তিনকন্যা। বর্তমানে ওই তিনকন্য নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। পর্তুগালে যাওয়ার জন্য তিনকন্যার নাম চূড়ান্ত হওয়ায় ইতোমধ্যে পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাজ গুছানো শুরু হয়েছে। বাড়িতেও নিজেদের জিনিসপত্র গুছগাছ শুরু হয়েছে ওদের। ফুটবলের শুরুতে গ্রামের মানুষের নানা কটুকথা শোনা তিনকন্যাকে নিয়েই গ্রামের মানুষের মধ্যে এখন আনন্দের জোয়ার বইছে। অথচ অর্থের অভাবে গ্রামের তিনকন্যা নান্দাইল সদরে ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য যেতে পারেনি ঠিক মতো। বাড়ির উঠানেই অনেক সময় করতে হতো অনুশীলন।

শিখার বাড়ি উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের রাজাবাড়িয়া গ্রামে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মারা যায় তার মা। এরপর টমটম চালক বাবা বিপ্লব মিয়া দ্বিতীয় সংসার পাতেন। সেই সংসারে আর থাকা হয়নি শিখাদের তিন বোন ও এক ভাইয়ের। হঠাৎই বিধবা নানী হালিমার খাতুনের কাঁধে আসে মেয়ের সন্তানদের। দ্বিতীয় সংসার নিয়ে দিনমজুর বাবা অন্যত্র থাকলেও শিখার খোঁজখবর নেন নিয়মিত। তবে সাধ্যমতো তেমন কিছু করতে পারেন না। নানার বাড়িতে সামান্য ভিটায় একটি জরাজীর্ণ ঘর ছাড়া আর কিছুই নেই। হাঁস-মুরগি লালন-পালন করে শিখার খরচের ব্যয় মেটান নানি হালিমা। এখান থেকেই পাশের পাঁচরুখি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে শিখা। সে খেলে লেফট উইং পজিশনে।  

নাতনি বিদেশ যাচ্ছে এই খবরে খুশীতে আত্মহারা বাবা-নানী। তাদের চাওয়া, মেয়ে দেশের বাইরে যাবে, দেশের নাম উজ্জ্বল করবে। শিখার নিজেও খুশি ধরে রাখতে পারছেন না। বলেন, ‘আমি একজন স্ট্রাইকার, আর যাচ্ছি রোলানদোর দেশে। আমার যে কত খুশি লাগছে তা বলে বোঝাতে পারব না। ভবিষ্যতে জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন আমার।’


তবে পথটা মোটেও সহজ ছিল না জানিয়ে শিখা বলে, আমার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। এমনও সময় কাটে আমাদের বাড়িতে তিন বেলা রান্না হয় না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে বল খেলতে গেছি মাঠে। অনুশীলনের পর কিছু খাবো সেই সামর্থ্যও ছিলো না, এখনও নাই। এতো কষ্ট করে এমন একটা পর্যায়ে আসলাম, পর্তুগালে যাব প্রশিক্ষণের জন্য এতে অনেক ভালো লাগছে। 

শুরুর গল্প জানতে চাইলে শিখা আরও বলেন, মা মারা যাওয়ার পর নানু অনেক কষ্ট করে এতটুকু বড় করেছে। বাড়ি থেকে প্র্যাক্টিসের জন্য যেতে প্রতিদিন ৭০ টাকা তার ভাড়া গুণতে হতো। যখন প্রাথমিকে পড়তাম তখন স্কুলের স্যারদের খেলাধুলা করাতো। তখন এমনিতেই বল নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতাম। তা দেখে স্যার উপজেলা নিয়ে খেলার সুযোগ দেয়। ময়মনসিংহ থেকে মগবুল স্যার ট্রেনিং করিয়ে ভালো দেখার কারণে তাকে বাছাই করেছে। তারপর অনেক জায়গায় খেলার সুযোগ পাই।

স্বপ্না আক্তার ঝেলি বাড়ি একই ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা ইলাশপুর। সে একজন গোলরক্ষক। তার গল্পটাও অনেকটা শিখার মতোই। কৃষিকাজ সংসার চালান বাবা ফয়জুদ্দিন ফকির। তিনভাই ও চার বোনের মধ্যে স্বপ্না সবার ছোট। ভাই-বোনেরা গার্মেন্টসে শ্রমিকের কাজ করে। ঝেলি বর্তমানে নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। 

ঝিলি জানায়, প্রতিদিন যখন অনুশীলনে যেতে তখন ৮০ টাকা ভাড়া লাগতো। বাবা মাঝে মাঝে দিতে পারতো না, অনেক কষ্ট করে যেতে হতো। অন্যদের কাছে টাকা ধার করেও যেতাম। আব্বু-আম্মু অনেক কষ্ট করে টাকা দিতেন। কষ্ট করতে করতেই এই পর্যন্ত এগিয়েছি। 

ঝিলি বলে চলেন, যখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম, তখন দেখতাম স্কুলের মেয়েরা প্র্যাক্টিস করতো, তা দেখে অনেক ভালো লাগতো। পরে নিজের ইচ্ছা স্যারকে জানানোর পর আমাকেও নিয়ে যায় প্র্যাক্টিসে। এখন প্রশিক্ষণের জন্য পর্তুগাল যাচ্ছি, অনেক আনন্দ লাগছে। বাংলাদেশের হয়ে যেন বাহিরে খেলতে পারি, জাতীয় পর্যায়ে যেনো খেলতে পারি এবং দেশের সুনাম যেনো বয়ে আনতে পারি এটিই আমার লক্ষ্য।  

তিনি বলেন, প্রাক্টিস করতে যাওয়ার জন্য বৃষ্টির দিন অনেক কষ্ট করতে হতো। দুই কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে ও ১২ কিলো রাস্তা গাড়ি দিয়ে যেতে হতো। মানুষও অনেক খারাপ কথা বলতো, কিন্তু আমি ওসব কানে নেইনি। কারণ আমি ফুটবলকে অনেক ভালোবাসি। মানুষ বলতো তুমি মেয়ে হয়ে ছেলেদের মতো খেলাধুলা করো এটা তো ঠিক না। তখন প্রতিবাদ করতাম। 

বাবা ফয়জুদ্দিন ফকির বলেন, ছেরির পিছে বহু টাকা গেছে। ভালো খেলে দেইখ্যা প্রত্যেক সপ্তাহে চন্ডীপাশা মাঠে মেয়ের খেলা দেখতে যাইতাম । আমার ছেরি উপরবায় উঠুক দোয়া করি।’ 

মা সুরাইয়া ইয়াসমিন বলেন, মেয়ে কোনোদিন খেয়ে গেছে, কোনো দিন না খেয়েও গেছে। টাকা পয়সা মিলাইতে পারছি না। ধার কইর‌্যাও দিছি, কোনো দিন দিতে পারিনি। বাড়িতে প্র্যাক্টিস করাইছি। মানুষ আগে মন্দচারি কইছে মেয়ে খেলার জন্য। এখন মেয়ে বাহিরে যাইবো এতেই খুশি।
উপজেলার মোয়াজ্জেমপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ কুতুবপুর গ্রামে বাড়ি তানিয়া আক্তার তানিশার। সে নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। দলের রক্ষণভাগ সামলানোর দায়িত্ব থাকে তার উপর। পিতা দুলাল মিয়ার একজন দিনমজুর। অন্যের বাড়িতে কাজ দিয়ে সংসার চালান। নিজের ছনের একটি ঘর বহুবছর আগে ঝড়ে উড়িয়ে নেওয়ার পর থেকে ছোটভাইয়ের ঘরে মেয়েকে রাখেন। নিজে থাকে তির্পল টানিয়ে। যে টিনের ঘরটিতে তারা আশ্রিত সেটিও জীর্ণ, পানি পড়ে বৃষ্টিতে। 

তানিশা বলেন, যখন স্কুলে পড়তাম তখন বড় আপুরা খেলতো দেখে আমারও ইচ্ছা হয়। তখন আম্মুকে এসে খেলার কথা বলার পর আমাকে প্রথম নিয়ে যায়। পরে অনেকদিন খেলা শিখছি। ২০১৮ সালে বঙ্গমাতা খেলায় ঢাকায় গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই, তখন ভালো খেলেছিলাম। পর্তুগালে গিয়ে অনেক কিছু শিখে আসতে পারবো এবং জাতীয় দলে খেলতে পারবো। 

তানিশার মা মজিদা খাতুন বলেন, আমার টাকা-পয়সা ছিলো না, ডিম বিক্রি করে, মাইনষ্যের এইনো কাম কইর‌্যা, আবার মানুষও অনেক সহায়তা করছে কারণে এই পর্যন্ত আইছে তানিশা। সে এখন সকলের দোয়ায় বাইরে খেলতে যাইবো। 

এই তিন নারী ফুটবলার ছাড়াও নান্দাইলের ১৫ সদস্যের একটি ফুটবল টিমকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন প্রশিক্ষক মকবুল হোসেন। তিনি জানান, তার প্রশিক্ষণেই মেয়েরা এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। পর্তুগাল গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর শিখা, স্বপ্না ও তানিশা একদিন দেশ সেরা খেলোয়াড় হবে এটাই তার প্রত্যাশা।

নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল খালেক বলেন, আমার বিদ্যালয়ে অনেক কৃতি খেলোয়াড় আছে এবং তাদেরকে আমি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করি। তিন ছাত্রী বিদেশে যাচ্ছে জেনে খুব খুশি হয়েছি। তারা একদিন জাতীয় দলে খেলে দেশের মুখ উজ্জল করবে।