ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ১৩:২২:৫৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতি গর্ব করবে : প্রধান উপদেষ্টা তলবের ১০ মিনিটেই হাজির জেডআই খান পান্না, চাইলেন নিঃশর্ত ক্ষমা ‘পরিবেশ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার’

আজ আপনার জন্মদিন, কবি আহসান হাবীব

খালেদ হোসাইন  | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:২৫ পিএম, ১০ জুলাই ২০২৫ বৃহস্পতিবার

আহসান হাবীব

আহসান হাবীব

আহসান হাবীব বিশ শতকের চল্লিশের দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কবি। চিন্তা-চেতনায় প্রাগ্রসর মানসিকতার পরিচয় দিতে যাঁরা সমর্থ হয়েছিলেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সমকালীন এবং সর্বকালীন যুগ-সংবেদনাসম্মত তাঁর প্রথম কাব্য ‘রাত্রি শেষ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। প্রকাশক ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। প্রচ্ছেদ করেছিলেন জয়নুল আবেদীন। বিচিত্র শিল্পক্ষেত্রের তিন জগতের এমন অসাধারণ তিন ব্যক্তিত্বের সম্মিলন এক অসাধারণ ঘটনা। কবি হিসেবে তিনি অসাধারণ মৌলিকত্ব এবং স্বকীয়তার পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন। আবহমান বাংলার আবেগ-আবহ, সমকালীন সামাজিক দায়বোধ, শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা, ব্যক্তিগত রোম্যান্টিকতা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বোপার্জিত কাব্যভাষার ক্রমরূপান্তর তাঁকে সব সময় সমকাল-সংলগ্ন এবং ভবিষ্যতস্পর্শী করে রেখেছে। 
শৈশবে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে আহসান হাবীবের সঙ্গে সম্পর্কের সূচনা, পরে কাব্যগত নানান কারণে, সেই সংশ্লেষ বৃদ্ধি পেয়েছে, সংগত কারণেই। মুগ্ধতা বৃদ্ধি পেয়েছে কাব্যপরম্পরায়। তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার আগ্রহ তীব্র হয়ে উঠেছে। গ্রন্থসূত্রে কবির সঙ্গে নৈকট্য সৃষ্টি করা যত সহজ, বাস্তব ক্ষেত্রে ততটা নয়। তার ওপরে, কবি হিসেবে তিনি যেমন মনোরম, সহজ ও চিত্তলগ্ন, সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবে মোটেও তা নন। বরং বিপরীত। ভয়ংকরও বলা যেতে পারে। এমনই একটা মিথ তাঁকে নিয়ে সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠিত ছিল। কবিতা নিয়ে হাজির হলে, তা পড়ে, পছন্দ না হলে, জানতে চাইতেন তা ছিঁড়ে ফেলতে পারবে কি না। পরে আরো জেনেছি, যেমন সেলিম আল দীন (আমার শিক্ষক) তাঁর কাছে গিয়েছিলেন একটি কবিতা নিয়ে। সেই কবিতা পড়ে,  আহসান হাবীব তাঁকে বলেছিলেন, আন্তন চেখভের একটি গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে নিয়ে আসতে। সেলিম স্যার তা করেছিলেন। সুন্দরভাবে তা ছাপিয়েওছিলেন। তা না হলে বাংলা সাহিত্যে নাট্যক্ষেত্রে এমন এক বৈপ্লবিক নাট্যকারকে পেতো কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। 
আহসান হাবীব তরুণ লেখকদের প্রতিভা প্রবণতা শনাক্ত করতে পারতেন। সম্ভাবনাময় লেখকদের দিয়ে বিচিত্র বিষয়ে লিখিয়ে নিতেন। যাঁরা এমন সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা পরে সে-ক্ষেত্রে বিশেষ সফল হয়ে উঠেছেন। 
‘দৈনিক বাংলা’য় যেতাম, ৪তলায় ‘সাতভাইচম্পা’র সম্পাদক আফলাতুন ভাইয়ের কাছে, তাঁর আগের ছোট কিন্তু মহিমাময় রুমটি সাহিত্য-সম্পাদক আহসান হাবীবের। পাশেই ছিল, ভুল না হলে, মাফরুহা চৌধুরীর রুম, আকেটা রুমে সৈয়দ লঙফুল হক-অলকেশ ঘোষ বসতেন। ছোট্ট একটা পরিসরে ছিল চা খাবার ব্যবস্থা। অনেকদিন আগের কথা, আমার স্মরণশক্তি তত ভালোও নয়, তবু মনে হচ্ছে, সেই চায়ের কারখানাটা চালাতেন কালাম ভাই।
চারতলায় ওঠার সিঁড়ি তো ছিলই, সিঁড়িঘরের পাশে যথারীতি লিফটের রুম। তার কোলাপসিবল গেট। বেশ পুরনো। চলন্ত অবস্থায় কাঁপাকাঁপি করে। আহসান হাবীব তার শ্বেত-শ্রভ্র চুলসম্ভার নিয়ে সেই লিফটেই ওঠা-নামা করতেন। আমি তো বটেই, দেখেছি, আমাদের কাছাকাছি বয়সের অনেকেই, ‘হাবীব-ভাইয়ে’র সঙ্গে সেই লিফটে উঠতে বা নামতে পারলে খুব খুশি হতো।  
বেশ-ক’টি সাপ্তাহিক পত্রিকা তখন তৈরি হয়েছে, দৈনিকের সাহিত্য-পাতাগুলো তো ছিলই। সাহিত্য-সম্পাদকরা দক্ষ, অভিজ্ঞ ও অমায়িক, কিন্তু হাবীব ভাইয়ের পাতায় লেখা ছাপা হওয়াটা ছিল একটা সম্মানজনক স্বীকৃতি,। একটা সনদ। খানিকটা জাতে-ওঠার মতো ব্যাপার। 
কলেজে পড়ি তখন, একদিন একটা কবিতা নিয়ে ঢুকে গেলাম হাবীব ভাইয়ের রুমে, বুকে অনেক সাহস নিয়ে, আর যে-কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে। তিনি বসতে বললেন। 
আমি বললাম, ‘আমি একটা কবিতা নিয়ে এসেছি।’
তিনি বললেন, ‘পড়েন।’ 
লেখা যায়। পড়া তো খুব কঠিন কাজ। নিজের লেখা তো আরো কঠিন! আমি তবু পড়লাম। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে থাকেন তিনি। শুনলেন। বললেন, ‘ওই অংশটা আবার পড়েন তো, জলভারানত…’ কী লিখেছেন।’
আমি পড়লাম, 
 ‘জলভারানত কত সন্দেহের মেঘ
মনের আকাশে তুমি করেছ যে জমা!’  
বুক ধুকপুক করছে। এর জন্য প্রস্তুতিও ছিল। 
তিনি বললেন, ‘লেখাটা রেখে যান। এই পাতার জন্য লেখাটা একটু হালকা।’
আমি বললাম, ‘জি।’
‘তিন মাস দেখেন। তিন মাসের মধ্যে ছাপা না হলে,...’
আমি বললাম, ‘জি।’
রোববার না শুক্রবার, মনে নেই, ‘সুধীজন পাঠাগারে’ গিয়েছি। পত্র-পত্রিকা ঘাঁটছি। কোনো একটি বই ফেরত দিয়ে অন্য-কোনো বই নিয়ে আসবো। দেখি, কবি মুজিবুল হক কবীর। আমি সালাম দিলাম। তিনি বললেন, ‘আরে! এইমাত্র আপনার কবিতা পড়লাম, ‘দৈনিক বাংলা’য়।
আমি বললাম, ‘না, ‘ইত্তেফাকে। 
ইত্তেফাকে সেইদিন ‘অলকানন্দা’ নামে একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল।’ 
(পরদিন লিও ক্লাবের একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে, শিল্পকলা একাডেমি’তে,  একটা খাবারের প্যাকেট নিয়ে কবি আল মাহমুদের রুমে গেলে তিনি নিজ থেকেই বলেছিলেন, পৌরাণিক বিষয় নিয়ে লেখা, সোমরস সম্বন্ধে আমারও আগ্রহ প্রচুর। ভালো লিখেছ।)
কবীর স্যার বললেন, ‘নাহ্! দৈনিক বাংলা’য়। চলেন দেখি।’
দেখলাম, কথা সত্য। দৈনিক বাংলার সাহিত্য-পাতা ছিল তখন একপৃষ্ঠার। তাতে ডানদিকে দুই কলাম জুড়ে ছাপা হয়েছে কবিতা, ‘মুখোমুখি বসো’। সৈয়দ লুৎফুল হকের তুলিতে আঁকা শিরোনাম, মূলত লেটারিং। সে আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। 
তিনি কবি ছিলেন, মানুষও ছিলেন। ফেরেশতা নন। মানবিক ত্রুটি-বিচ্যুতির ঊর্ধে কোনো মানুষ হয় না, বিশ্বাস করি। তাঁর পক্ষেও হয়তো তা এড়ানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু তা কখনো এমন হয়ে ‍ওঠেনি, যা তাঁর কৃতি ও কীর্তিকে ম্লান করে দিতে পারে। 
দেশভাগের আগে তিনি কোলকাতায় ছিলেন। ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় কাজ করতেন। রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) ছিলেন তাঁর সহকর্মী। দাদাভাই শেষ বয়সে এসেও গল্পে গল্পে  আমাকে বলেছেন, আহসান হাবীরে সৌজন্য, সহানুভুতি ও ঔদার্যের কথা। বিশেষভাবে সম্পদনা-জ্ঞানের সমৃদ্ধির কথা। পাইকা টাইপের সেই দিনগুলোতে পাতার সৌন্দর্য সৃষ্টি, বিশেষভাবে ‘আই রিলেফে’র বিষয়ে তাঁর প্রাজ্ঞতার কথা।
হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ যখন প্রথম পৃষ্ঠায়, সংবাদের পাশ থেকে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতায় প্রবেশ করছিলেন, আহসান হাবীব তখন কবি নাসির আহমদকে ছুটি নিতে বলেছিলেন, নিজেও ছুটিতে ছিলেন, কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকের কবিতা তিনি ছাপেননি তাঁর পাতায়।  
আজ সেই মহান মানুষটির জন্মদিন। আমি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। 
 

আমি কোনো আগন্তুক নই
আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালেস্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা–
সারা দেশে।
আমি কোনো আগন্তুক নই। এই
খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির, সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া
অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার
আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন। আমি
জমিলার মা’র
শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
সে আমাকে চেনে
হাত রাখো বৈঠায় লাঙ্গলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর। দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।
আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই।
দু’পাশে ধানের ক্ষেত
সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক।

– আহসান হাবীব 

আত্মপ্রশংসার দায় মাথায় নিয়ে আমার সংশ্লিষ্ট কবিতা দুটি রাখলাম এখানে : 
 

মুখোমুখি বসো
পাশে নয় আপাতত মুখোমুখি বসো। 
আমাকে দেখতে দাও তোমার সুষমা 
জলভারনত কত সন্দেহের মেঘ 
মনের আকাশে তুমি করেছ যে জমা।
চোখের মণিতে কেন উজ্জ্বলতা আর 
আনন্দ আনন্দ বলে ডাকে না আমাকে 
কোন ভণ্ড চিত্রকর সেই দীপ্ত পটে 
এখন বিষাদ চিত্র শুধু এঁকে রাখে।
অধরে অস্বস্তি কেন, কেন মনস্তাপ, 
গহীন বেদনা কেন চিবুকে তোমার 
গ্রীবার লাবণ্য কই, মন-মাতানিয়া 
অমল অপাঙ্গে কেন অসভ্য আঁধার?
পাশে নয় আপাতত মুখোমুখি বসো 
আমাকে মেটাতে হবে এই কৌতূহল 
না হলে অমৃত আমি নেবো না নেবো না 
আকণ্ঠ করবো পান নিখাদ গরল।

 

অলকানন্দা
দুহাতে পাথর চেপে নিঙড়ে এনেছো সোমরস 
মেষের চামড়ায় ছেঁকে নিজ হাতে মিশিয়েছো দুধ
সোনার বাটিতে সেই সঞ্জীবনী সুধা–
আমি তা করেছি পান পরিপূর্ণ সুখে 
অমল পানীয় শাদা সামান্য অনুস্বাদ মাদকতাময়।
আমি কি গন্ধর্ব তবে? দেবতার উৎসবে 
আমি কি গেয়েছি গান? বাজিয়েছি
 নানা বাদ্য, তুমি কি নেচেছো? 
রক্ত কেন নেচে ওঠে শিরা-উপশিরাময় 
তোমার গায়ের ঘ্রাণে
 আনন্দের বেদনায়?
গান্ধর্ব নিয়মে বিয়ে হয়েছিল তোমার-আমার
 একান্ত নিজস্ব পাপে দেবতার অভিশাপে 
থেকেছি প্রস্তরীভূত বহুকাল
 আরাধনা শেষে তুমি আমাকে পেয়েছো পুনরায়
কাহিনী এমন নাকি? কুবেরের রাজধানী 
বারবার কেন দুলে ওঠে? 
স্বপ্ন নয় সত্য নয় মিথ্যেও নয় হয়তোবা
 অমল পানীয় শাদা সামান্য অম্লস্বাদ মাদকতাময় সোমরস
 আমি তা করেছি পান পরিপূর্ণ সুখে 
অলকানন্দা নদী-তীরে, অলকায়।

লেখক পরিচিতি: খালেদ হোসাইন, কবি ও শিশুসাহিত্যিক, অধ্যাপক-বাংলা বিভাগ. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।