ঢাকা, মঙ্গলবার ১৬, এপ্রিল ২০২৪ ১৩:১৪:২৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
রাজধানীতে ফিরেছেন ২১ লাখেরও বেশি সিমধারী ভাসানটেকে আগুন: মায়ের পর মারা গেলেন মেয়েও ফরিদপুরে বাস ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত ১১ রাজধানীতে ফিরছে মানুষ লক্ষ্মীপুরে ঘরে ঢুকে নারীকে কুপিয়ে হত্যা ইন্দোনেশিয়ায় ভূমিধসে ১৫ জনের মৃত্যু

উমোজা: নারীদের এই গ্রামে পুরুষদের নো এন্ট্রি

ফিচার ডেস্ক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:১০ পিএম, ৮ জানুয়ারি ২০২১ শুক্রবার

উমোজা: নারীদের এই গ্রামে পুরুষদের নো এন্ট্রি

উমোজা: নারীদের এই গ্রামে পুরুষদের নো এন্ট্রি

পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। কেনিয়ার পাহাড়ী সবুজ-শ্যামল-সুন্দর পরিবেশে গড়ে উঠেছে এক গ্রাম ‘উমোজা’। আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী যে রূপ দেখা যায়, ঠিক তেমন রঙিন বৈচিত্র্যে ভরপুর গ্রামটি। নারীদের গ্রাম হিসেবেই উমোজা পরিচিত বিশ্বব্যাপী। পুরুষদের এ গ্রামে প্রবেশ করা নিষেধ।

সোয়াহিলি ভাষায় ‘উমোজা’ মানে ঐক্য। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে ৬ ঘণ্টার পথ এই গ্রামের নাম কেনিয়া ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের নানা দেশে, নানা অঞ্চলে। এই গ্রামের কথা জানে না এমন মানুষ কেনিয়াতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। নাম মনে থাকার মতো দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন উমোজা’র নারী গোষ্ঠী।

কেনিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম সাম্বুরু। এই গ্রামে সাম্বুরু আদিবাসীদের বাস। এ ছাড়াও তুর্কানা এবং অন্যান্য আদিবাসীও আছে কয়েকজন।

বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের নানা আদিবাসী নারীদের মতো সাম্বুরু নারীরাও সমাজের পিছিয়ে পড়া সারিতে ছিলেন। তাদের গণ্য করা হত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে। সাম্বুরুর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের প্রায় নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতেন পুরুষেরা।

কিছু সামাজিক কুপ্রথার জন্য তাদের যৌনাঙ্গহানি, অকথ্য নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। জোর করে নাবালিকাদের বিয়েও দিয়ে দেওয়া হত। এমনকি একাধিক পুরুষের ধর্ষণের শিকারও হতেন তারা। অথচ তাদের কথা শোনার জন্য কেউ ছিলো না।

এমনকি স্বামীর ইচ্ছা হলে স্ত্রীকে হত্যাও করতে পারত। নারীদের পাশে দাঁড়ানোর ছিল না কেউ। বরং স্বামীকে সমর্থন করার জন্য আরও অনেক পুরুষ তৈরি থাকত। নারীদের জন্য এ রকমই নিষ্ঠুর ছিল সাম্বুরু। মূলত স্বামীর সম্পত্তি হয়েই জীবন কাটাতেন সেখানকার নারীরা।

এই নির্যাতন সহ্য করতে করতে এক সময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল সাম্বুরু নারীদের। গড়ে উঠল ‘উমোজা’— নারীদের নিজস্ব গ্রাম। যেখানে পুরুষের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

১৯৯০ সালে রেবেকা ললোসলি নামে এক নারী নির্যাতিত এবং বিতাড়িত আরও কয়েকজন নারীকে নিয়ে এই পুরুষমুক্ত গ্রাম গড়ে তুলেছিলেন।

রেবেকা নিজেও একজন নির্যাতিতা। সাম্বুরুতে নিযুক্ত সেনারা নির্যাতন চালাত নারীদের উপর। তাদের নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করত সেনারা। যখন তখন নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে চলত ধর্ষণ।

এক সময় একসঙ্গে প্রায় দেড় হাজার সাম্বুরু নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন। সে সময় স্বামীদেরও তারা পাশে পাননি। স্বামীরা উল্টো তাদের বাড়িছাড়া করা হয়েছিল। সেই দলে রেবেকাও ছিলেন। এমন আশ্রয়হীন ১৫জন নারীকে নিয়েই নিজেদের জন্য আশ্রয় গড়ে তোলেন রেবেকা।

এখন সাম্বুরুর সমস্ত নির্যাতিতারা এই উমোজাতেই আশ্রয় নেন। এই গ্রামে শুধুমাত্র নারীদের কথাই চলে। মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচেন তারা।

বহু অন্তঃসত্ত্বাও এখানে ঠাঁই নেন। যদি তারা পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, তা হলে সন্তানের ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত সেই সন্তান এই গ্রামে থাকার অনুমতি পায়। ১৮ বছর হয়ে গেলে তাকে উমোজা ছাড়তে হয়। শর্ত এমনই।

উমোজা গড়ে তোলাটা সহজ ছিল না রেবেকাদের কাছে। নারীদের আধিপত্য কিছুতেই মানতে পারছিলেন না পুরুষেরা। রেবেকাদের অনেক হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। একজোট হয়ে লড়েছেন তারা।

এমন নয় যে উমোজার নারীরা এই গ্রামের বাইরে যান না। তাদের সমস্ত জায়গায় যাওয়ার অনুমতি রয়েছে। বাজার করা, ঘুরে বেড়ানো সবই করে থাকেন।

এক সময় তাদের কথা দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের স্থান হয়ে উঠল উমোজা।

পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার ফলে তাদের উপার্জনের রাস্তাও খুলে যায়। সমস্ত দিক থেকেই স্বনির্ভর হয়ে ওঠেন নারীরা। সাম্বুরুর পুরুষরা এটা মানতে পারছিলেন না কিছুতেই।

তারাও আলাদা পুরুষ-গ্রাম গড়ে তুলে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। খুব চেষ্টা করেছিলেন যাতে পর্যটকেরা উমোজাতে না যান, যাতে নারীদের উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পুরুষ-গ্রামের পরিকল্পনা সাফল্য পায়নি।

উমোজার বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তা আরও হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়াতে থাকে পুরুষদের কাছে। একাধিকবার তাদের গ্রামে আক্রমণ করে ঘর-বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়। মামলা করে নারীদের দখলে থাকা ওই জমি ছিনিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা হয়।

কিন্তু যত বেশি আঘাত তাদের উপর করা হয়েছে, ততটাই বুমেরাং হয়ে তা ফিরে এসেছে পুরুষদের উপর। এ খবর জানাজানি হওয়ার পর তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে জাতিসংঘ এবং কেনিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়। আইনত ওই উমোজার জমি এখন নারীদের।

অর্থ দিয়ে সাহায্যের পাশাপাশি উপার্জনের বিভিন্ন উপায় জানাতে নারীদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় এখানে। পর্যটনের পাশাপাশি কুটির শিল্প এবং চাষবাস করেও তারা উপার্জন করেন এখন।

নিজেদের জমি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছেন তারা। তার ভেতরে মাটি, গোবর আর ঘাস দিয়ে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে থাকেন। নারীদের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি আরও বহু সামাজিক কাজে নিযুক্ত তারা। অনাথ শিশুদের বড় করেন তারা।

এখন সাম্বুরু পুরুষদেরও ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে উমোজা। তবে শুধুমাত্র ঘুরে দেখার জন্য। রাত্রিযাপনের কোনও অনুমতি নেই তাদের।

শেষ ২০১৫ সালে লোকগণনা হয়েছিল এখানে। সেই অনুযায়ী, তখন ৪৭ জন নারী এবং শ’দুয়েক শিশু ছিল উমোজায়।

সাম্বুরুর শিশুরা যেখানে শৈশব কাটায় গবাদিপশু বিচরণ করিয়ে তখন উমোজার শিশুরা পড়াশোনা শেখে। উমোজাতে তাদের জন্য স্কুলও রয়েছে একটা।

২০১৫ সালে কেনিয়ায় এসেছিলেন বারাক ওবামা। উমোজার এই গ্রামে ঘুরে আপ্লুত হয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘বিশ্ব জুড়েই নারীদের দমিয়ে রাখার একটি রীতি রয়েছে। নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করা হয়। এ সমস্ত কু-রীতিনীতি বদলানো প্রয়োজন। অঙ্গহানি, বালিকা বিবাহের মতো প্রথাগুলো অনেক পুরনো। এই শতাব্দীতে এগুলোর কোনও জায়গা থাকা উচিত নয়।’

মূলত ২০০৪ কিংবা ২০০৫ সালের দিকে উমোজার নারীরা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেতে শুরু করে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য। এরপর থেকে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনুপ্রেরণার খোঁজে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। তবে এতকিছুর পরও আফ্রিকার পুরুষসমাজের বিভিন্ন অত্যাচার ও নিগ্রহ সহ্য করে চলেছে তারা। এখনো পুরুষশাসিত সমাজ সঠিকভাবে নিতে পারেনি নারীদের এই বীরত্বগাথা। তবে সবকিছু ছাপিয়েই উমোজার নারীরা এগিয়ে চলছে। ভালো থাকুক উমোজা, ভালো থাকুক উমোজার নারী সমাজ।