ঢাকা, শুক্রবার ২৬, এপ্রিল ২০২৪ ৩:৩৪:৩৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

একাত্তরের গেরিলাযোদ্ধা ছবির কিছু চাওয়ার নেই

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৪৩ পিএম, ২৪ মার্চ ২০২১ বুধবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি।  সংগৃহীত ছবি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি। সংগৃহীত ছবি।

আলমতাজ বেগম ছবি; একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তল সময়ে তিনি ১৬ বছরের কিশোরী। যুদ্ধে যাওয়ার স্বপ্ন দুচোখজুড়ে। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন ছবি। তখন তিনি বরিশাল শহরের জগদীশ সারস্বাত বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী।

ঝালকাঠী জেলার রাজাপুর উপজেলার শ্যাকরাইল গ্রামের হাবিবুর রহমান ও জাহানারা বেগম দম্পতির পঞ্চম সন্তান আলমতাজ বেগম। বাবা ছিলেন বরিশাল আদালতের আইনজীবী সহকারী। সে সুবাদে বরিশাল শহরেই তার বেড়ে ওঠা। এ এলাকার একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি।

ছবির বড় ভাই অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ও মেজো ভাই ফিরোজ কবিরের মাধ্যমে বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় তার। তারা পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সিরাজ শিকদারের সঙ্গে বাম রাজনীতি করতেন। দু’ভাইয়ের বন্ধুরা বরিশাল শহরের বিএম কলেজ রোডের তাদের বাসায় নিয়মিত আসতেন, আলাপ-আলোচনা করতেন। কিশোরী ছবি তাতে অনুপ্রাণিত হতেন। বড় ভাইয়ের বন্ধু সেলিম শাহনেওয়াজের সংস্পর্শে বাম রাজনীতির প্রতি আগ্রহ জন্মায় তার। সেলিম শাহনেওয়াজের সঙ্গেই পরে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

যুদ্ধের সময় অনিয়মিতভাবে তাদের বরিশালের বাসায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট (সর্বহারা) পার্টির ঘরোয়া আলোচনা বসত। কে কিভাবে যুদ্ধে যাবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলত।  আলোচনার মূল বিষয় নিয়ে তারা ছবিদের বাসায় বসে পোস্টার লিখতেন। হাতের লেখা ভালো থাকায় পোস্টার লেখায় সাহায্য করতেন আলমতাজ। রাতের আঁধারে সেই হাতে লেখা পোস্টার বরিশাল শহরের অলিগলিতে সাঁটানো হতো।

মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার মেজো ভাই ফিরোজ কবির মনু যুদ্ধে চলে যান। মাত্র দু বছরের বড় ভাইটি যুদ্ধে চলে যাওয়ার পর ছবির মনে এক অদ্ভূত প্রতিক্রিয়া হয়। তিনিও যুদ্ধে যাওয়ার সংকল্প করতে থাকেন।

বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার সীমান্তবর্তী আটঘর-কুড়িয়ানা পেয়ারাবাগানে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে যুদ্ধঘাঁটি। সেই ঘাঁটিতেই মেজো ভাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। প্রশিক্ষণ বিরতিতে একদিন মেজো ভাই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বরিশালের বাসায় আসেন। এসেই আলমতাজের কাছে জানতে চান, তিনি যুদ্ধে যেতে চান কি না। কোনো কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে যান আলমতাজ। কিন্তু তার বাবা-মা রাজি হলেন না। মা ভীষণ কাদলেন। বাবাও তাকে যুদ্ধে যেতে দিতে চাইলেন না। ছবির মেজো ভাই বাবা-মাকে অনেক বোঝালেন। বললেন,ছবিকে এই সময় বাসায় রাখা ঠিক নয়। অবশেষে তারা রাজি হলেন। সব পিছুটান ত্যাগ করে কিশোরী ছবি ভাইয়ের হাত ধরে চলে গেলেন যুদ্ধজয় করতে।

ভাই ফিরোজ এবং তার সহযোদ্ধাদের সাথে গিয়ে হাজির হলেন পেয়ারাবাগানের সেই যুদ্ধঘাঁটিতে। সেখানে যাওয়ার পর সিরাজ শিকদারের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তাকে অস্ত্র চালানো ও গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওই ঘাঁটিতে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র চালানো, গেরিলা প্রশিক্ষণসহ এক এক করে সব শেখানো হচ্ছিল। তার চেয়েও বেশি শেখানো হচ্ছিল যুদ্ধের সময় মনোবল কিভাবে বাড়ানো যায়। ছবির জন্য এটা তেমন কঠিন কাজ ছিল না। কারণ তার মাথায় সব সময়ই ছিল, যুদ্ধ করবেন, পাকিস্তানি সেনাদের তাড়াবেন দেশ থেকে।

আর তাই সব সময়ই হাতের কাছে থাকত অস্ত্র ছবির। শাড়ির বদলে লুঙ্গি-প্যান্ট-শার্ট পরে প্রস্তুত থাকতে হতো সারাক্ষণ। ঘাঁটিতে একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তাকে খবর আনা-নেয়ার কাজও করতে হতো।

ছবিসহ দলের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা যদি জানতেন কোনো গ্রামে একজন রাজাকার আছে, তখন ক্যাম্প থেকে হেঁটেই সে গ্রামে চলে যেতেন। খবর নিতেন সেই রাজাকার কোথায় যায়, কী করে। এরপর এসে ক্যাম্পে জানাতেন। সে অনুযায়ী অপারেশন চালানো হতো।

সে সময় নিয়ম ছিলো যে যুদ্ধে প্রথম অংশগ্রহণ করবে তাকে প্রতিপক্ষের কাউকে হত্যা করে হাত লাল করতে হবে। তাহলেই সে সত্যিকারের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে। ছবি ওই ক্যাম্পে যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই একজন রাজাকারকে ধরে আনা হলো এবং তাকে বলা হলো ওই লোকটিকে হত্যা করতে। ছবি সঙ্গে সঙ্গে ওই রাজাকারকে হত্যা করেন। এটা তার জীবনের স্মরণীয় এবং প্রথম ঘটনা। এরপর প্রতিপক্ষের অনেককে হত্যা করেছেন এই দেশপ্রেমী বীর নারী।

প্রশিক্ষণ নেয়ার পর ছেলেদের পাশাপাশি বিভিন্ন অপারেশনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। যুদ্ধচলাকালে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে স্বরূপকাঠির সন্ধ্যা নদীতে একটি ভয়াবহ অ্যাকশান করেছিলেন এই কিশোরী মুক্তিযোদ্ধা। এদিন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে সেলিম শাহনেওয়াজও ছিলেন। আলমতাজ প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর গানবোটে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। যখন গ্রেনেডের পিনটা খুলছিলেন তখন তার বুকটা ধড়ফড় করছিল, কী জানি যদি হাতেই বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডটা! দু:সাহসী এই নারীর হামলায় গানবোটে থাকা ১০জন পাকসেনা ও তাদের দোসরদের সকলে মারা যায়।

আলমতাজের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে গেরিলাযুদ্ধও হয়েছিল। ঝালকাঠির গাবখান খাল দিয়ে পাক বাহিনীর একটি স্পিডবোট যাচ্ছিল। খবরটা আগেই পেয়ে গেছিলেন আলমতাজরা। ওই গানবোটে একজন কমান্ডার, তিনজন পাকবাহিনীর সৈন্য এবং দুইজন দেশীয় দালাল ছিলো। আলমাজদের প্রথমে পরিকল্পনা ছিলো, ওই গানবোটে ছয়-সাতজন মিলে হামলা চালাবে। কিন্তু সরাসরি যুদ্ধ করার মতো অস্ত্র তাদের ছিল না। তখন আলমতাজ একাই গেরিলা কায়দায় পাকিস্তানি গানবোটে গ্রেনেড আর হাতবোমা দিয়ে হামলা করেন। এতে গানবোটটি নদীতে ডুবে যায়। এবারও গানবোটে থাকা প্রায় সব পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। পরবর্তীতে একাধিকবার পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

একাত্তরে উত্তাল সারাদেশ। যুদ্ধের দামামা বাজছে চারদিকে। এ সময় আলমতাজের জীবনে ঘটে যায় এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ২৮ মে, ১৯৭১। যুদ্ধের ক্যাম্পে গুলির শব্দ আর বারুদের গন্ধের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায় আলমতাজের। বর সহযোদ্ধা সেলিম শাহনেওয়াজ। কষ্টের জীবনের মধ্যে এই ঘটনায় সহযোদ্ধারা সবাই বেশ খুশি। সীমাহীন কষ্টের মধ্যে একটু যেন আনন্দ সকলের মনে। কিন্তু বিয়ের পরই বীরকন্যা আলমতাজের জীবনে নেমে আসে শোকের ছায়া।

পেয়ারাবাগান অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও সাংগঠনিক শক্তি বেড়ে যাওয়ায় হানাদাররা বাগান পরিষ্কারের পাশাপাশি চতুর্মুখী অভিযান চালাতে শুরু করে।
এ সময় হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে ধরা পড়েন আলমতাজের মেজো ভাই কমান্ডার ফিরোজ কবির মনুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। শক্র ক্যাম্পে নির্মম নির্যাতনে ১৮ আগস্ট মনু শহীদ হন। বন্দি আরেক মুক্তিযোদ্ধা এম জি কবির ভুলুর চোখের সামনে ঘটে এই নির্মম ঘটনা। এ ঘটনার পর আলমতাজ পেয়ারাবাগান ছেড়ে বরগুনার পাথরঘাটায় সেলিমের গ্রামের বাড়িতে আত্মগোপনে চলে যান। তার স্বামী সেলিম চলে যান পাবনায় নতুন ক্যাম্পে।

কিন্তু পাথরঘাটার হানাদার বাহিনীর দোসররা আলমতাজের  সন্ধান পেয়ে যায়। তাই নূর মোহাম্মদ নামে একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয় তাকে। পরে সেলিমের এক চাচাতো ভাই এবং সহযোদ্ধা দিপুকে নিয়ে আলমতাজ পাবনার মুক্তাঞ্চলে চলে যান। সেখান থেকে ঢাকার জিগাতলা হয়ে হাজারীবাগের এক ট্যানারির কাছে গোপন আস্তানায় বসবাস শুরু করেন। ঢাকায়ও অভিযানে অংশগ্রহণ করেন তিনি। বিএনআর (পাকিস্তান সরকারের ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন) অফিসে হামলার সময় আলমতাজ অস্ত্র পৌঁছে দেন সহযোদ্ধাদের। এ সময় সম্মুখযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন তিনি। আর এভাবেই আলমতাজ বেগম ছবির যুদ্ধের ৯ মাস কাটে।  

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে তারা খুলনায় এক আত্নিয় বাসায় ওঠেন। এ সময় দলে বেশ ক্রন্দল দেখা দেয়।  ১৯৭২ সালের ৬ জুন খুলনায় সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এসময় জানতে পারেন, ঢাকার ইন্দিরা রোডে তার বড় ভাই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন কবির গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন। সপ্তাহখানেক পর দলীয় কর্মীরা তাকে জানান, বড় ভাই নিহত হওয়ার আগেই ৩ জুন খুলনায় আসার পথে ঝালকাঠি লঞ্চঘাটে গুপ্তঘাতকেরা তার স্বামী সেলিম শাহনেওয়াজকে হত্যা করে। সেলিমের লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় সুগন্ধা নদীতে। এ সময় আলমতাজ অন্তস্বত্তা ছিলেন। এরপর আলমতাজ ঢাকায় এসে বড় বোনের বাসায় আশ্রয় নেন।  সেখানেই ২২ ডিসেম্বর জন্ম নেয় তার মেয়ে সেলিনা শাহনেওয়াজ শিমু।

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার শ্যাকরাইল গ্রামে ১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া আলমতাজ বেগম ছবির বাবার কর্মক্ষেত্র ছিলো বরিশালে। এ কারণে সেখানেই বেড়ে ওঠেন তিনি। দুই ভাই, স্বামী এবং তিনি নিজেও মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও তাদের কারোই মেলেনি স্বীকৃতি। তবে সর্বশেষ যাচাই-বাছাইয়ে তার নাম ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি বর্তমানে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের বরগুনা শহরে বসবাস করছেন। ১৯৭১ সালে ছবি নিজ চোখে দেখেছেন পেয়ারাবাগানের আশেপাশের অনেক বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো পাকবাহিনীর দোসররা। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে বাবা-মাকে আর পাননি এই মুক্তিযোদ্ধা। তাদের হত্যা করা হয়।  

এই বীর নারী মুক্তযোদ্ধার বোনের মেয়ে শিশুসাহিত্যিক মাহবুবা হক কুমকুম উইমেননিউজ২৪.কম-কে বলেন, আমার খালা দেশকে ভালোবেসে, দেশকে হানাদারদের গ্রাস থেকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করেছিলেন। দেশের স্বাধীনতাই তার প্রাপ্তি। তার কিছু চাওয়ার নেই। আর কিছু নিয়ে তিনি ভাবছেন না।

কুমকুম আরও বলেন, আমাদের ছবি খালা মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। ক্যান্সারের মত ঘাতকব্যাধিকেও তিনি জয় করেছেন। তিনি সুস্থ আছেন এবং ভালো আছেন। বর্তমানে বরগুনা শহরে বসবাস করছেন।