ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ৭:৫২:০৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ফের কমল স্বর্ণের দাম মক্কা ও মদিনায় তুমুল বৃষ্টির শঙ্কা খালেদার গ্যাটকো মামলায় চার্জগঠনের শুনানি পেছাল কুড়িগ্রামে তাপদাহ: বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা

গীতা-ইরা: দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা বোনের গল্প

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৫৮ পিএম, ২৩ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা গীতা কর

বীর মুক্তিযোদ্ধা গীতা কর

পাকিস্তানি দোসরদের হাতে বাবা ও কাকার খুনের প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রত্যয় নিয়েছিলেন গীতা ও ইরা কর৷ প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্ত এলাকায় যান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই বোন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার সুযোগ হয়নি তাদের৷
স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য গোবরা শিবিরে প্রথম যে পাঁচ জনকে নিয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল তাদের অন্যতম এই দুই বোন৷ নানা দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে মুক্তিযুদ্ধে কাজ করলেও এখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি তারা৷
১৯৫৪ সালের ২৮ মে রাজবাড়ীর শিবরামপুর গ্রামে জন্ম গীতা করের৷ পিতা জিতেন্দ্র নাথ কর এবং মা সন্ধ্যা রাণী কর৷ বাবা-মার ১১ মেয়ের মধ্যে গীতা কর ছিলেন সবার বড়৷ এলাকার প্রভাবশালী পরিবার হলেও ১৯৭০ সালে তার কাকাকে খুন করা হয়৷ পরের বছরই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ৫ মে তার বাবাকেও দিনের বেলায় হত্যা করে বিহারী ও স্থানীয় রাজাকাররা৷ এ সময় এলাকার অন্যান্য হিন্দু পরিবারগুলোর উপরও নির্যাতন শুরু করে পাকিস্তানি দোসররা৷ ফলে প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে কিছুদিন মামার বাড়িতে থাকেন গীতারা৷
কিন্তু গীতা করের মনে জ্বলতে থাকে কাকা আর বাবার হত্যাকারী রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার তাগিদ৷ গীতা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে ওঠেন৷ পাকসেনা এবং তাদের দোসরদের নির্যাতন গ্রামের দিকেও ছড়িয়ে পড়লে গীতা ও ইরাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ভারতে চলে যান৷ টানা নয় দিন পায়ে হেঁটে ভারত সীমান্তে পৌঁছেন তারা৷
এক সাক্ষাৎকারে গীতা কর ওই সময়ের ঘটনা তুলে ধরে বলেন, আমার এক ভাই জানান, কলকাতায় নারীদের যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হবে৷ তখন আমি এবং আমার বোন ইরা কর তৎকালীন নারীনেত্রী সাজেদা চৌধুরী, বদরুন্নেসা, নূরজাহান মোর্শেদের কাছে প্রায় প্রতিদিন যেতাম। কলকাতার সিআইপি রোডে গিয়ে দেখা করতাম তাদের সাথে। তাদের কাছে আমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহের কথা জানাতাম৷
প্রশিক্ষণের জন্য আমরাই প্রথম যোগাযোগ করি তাদের সঙ্গে৷ এ জন্য প্রায় এক মাস ধরে ঘুরতে থাকি। একদিন সাজেদা চৌধুরী জানান, মেয়েদের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু হবে৷ এরপর কলকাতার পার্ক সার্কাসের কাছে গোবরা নামক এলাকায় শুরু হয় মেয়েদের প্রশিক্ষণ৷ শুরুতে আমরা দুই বোন, রাজশাহীর দুইজন মেয়ে এবং সম্ভবত যশোরের একজনসহ মোট পাঁচজন মেয়েকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়৷
গোবরা শিবিরে তাদের প্রশিক্ষণের নানা দিক তুলে ধরে গীতা কর বলেন, ২ জুলাই রবিবার প্রথম আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়৷ আমাদের একটা ধুতি, একটা মগ এবং একটা টিনের থালা দেয়া হয়েছিল৷ প্রশিক্ষণের সময় আমাদের নির্দেশ দেয়া হয় আলো জ্বালানো যাবে না। কোন আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করা যাবে না৷ এসময় আমাদের থাকা-খাওয়ার তেমন কোন ঠিক ছিল না৷ মেঝেতে থাকতাম আমরা৷ এরপর ধীরে ধীরে শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে আরো নারী এসে যোগ দেন সেই প্রশিক্ষণ কোর্সে৷ তাদের মধ্যে ছিলেন শিরিন বানু মিতিল, লায়লা পারভীন বানু, খাদিজা আখতার, মনিকা ব্যানার্জিসহ আরো অনেকে৷ শেষে প্রায় আড়াইশ' থেকে তিনশ' মেয়ে হয়ে যাই আমরা৷ যাদবপুর এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন৷ ফরাসি বিপ্লব, কিউবার বিপ্লবসহ বিশ্বের ঐতিহাসিক নানা ঘটনা উল্লেখ করে আমাদের উৎসাহ যোগাতেন তারা৷
তিনি আরও বলেন, আমরা সেখানে শুধু অস্ত্র হাতে নেইনি৷ কিন্তু অস্ত্র চালনার তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ, ক্রলিং, গোয়েন্দাগিরি এবং প্রাথমিক চিকিৎসাসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আমাদের৷ সাজেদা আপা আমাদের প্রায় খোঁজ-খবর নিতেন৷

কলকাতার গোবরা শিবিরে প্রথম দফায় প্রশিক্ষণ নিয়ে সিলেট সীমান্তে যান দুই বোন গীতা আর ইরা৷ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন৷ কিন্তু সেখানে কোন পথ খুঁজে না পেয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার জন্য নারীনেত্রী সাজেদা চৌধুরীর কাছে টেলিগ্রাম করা হয়৷ টেলিগ্রামের উত্তর মেনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে আগ্রহী ১৫জন মেয়ের একটি দলকে আগরতলায় পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা হয়৷ সেখান থেকে তাদের বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে কাজে যোগ দিতে বলা হয়৷ বিশ্রামগঞ্জে কাজ শুরু করলেও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার দৃঢ় ইচ্ছা ছিল তাদের৷
এক সাক্ষাৎকারে গীতা কর বলেন, আমরা যুদ্ধ করে মরতে চাই৷ কিন্তু পথের মধ্যেই না খেয়ে মারা গেলে তো কোন লাভ হবে না৷ তাই সাজেদা চৌধুরীর ফেরত টেলিগ্রামের নির্দেশনা অনুসারে আগরতলা পৌঁছাই৷ এরপর বিশ্রামগঞ্জে গিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন ডা. সেতারা বেগম, ডা. এমএ মবিন, ডা. নাজিম, ডা. মোর্শেদসহ সবাই আমাদের অভিনন্দন জানান৷ তারা বলেন, তোমরা আমাদের সাথে কাজ করো৷ তোমাদের আর কোন চিন্তা নেই৷ কিন্তু তখনও আমরা বলছি, আমরা বন্দুক হাতে যুদ্ধ করতে চাই৷ আমরা তো তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি৷ এসব কথা বলে আমরা প্রশিক্ষণের সনদও দেখালাম৷ তবুও আমাদের চিকিৎসা সেবার কাজেই যোগ দিতে বলা হলো৷ সেখানে সুলতানা কামাল, তার বোন সাঈদা কামাল, নিলীমা বৈদ্য, বাসনা চক্রবর্তী, পদ্মা রহমানসহ অনেকের সাথেই কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমাদের৷ এসময় আমাদের মনে একটু আশার সঞ্চার হলো, আমরা শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা গীতা ও ইরা কর৷ এতোদিন পর্যন্ত কোন আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ ছিল না তাদের৷ পরে সেখান থেকে বর্তমান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে সোনামুড়া সীমান্ত দিয়ে কুমিল্লায় পৌঁছান৷ এরপর ঢাকায় এসে ইস্কাটন রোডে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ শুরু করেন দুবোন৷ সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক হিসেবে অবসর নিয়েছেন গীতা কর৷ ইরা করও সেখানেই কাজ করেছেন৷ এক সময় ফ্রান্স থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দেড় বছরের কোর্স সম্পন্ন করেন গীতা কর। ইরা করও একই জায়গা থেকে অণু-জীববিজ্ঞান বিষয়ে কোর্স সম্পন্ন করেন৷
দেশ স্বাধীন করা এবং দেশ গড়ার কাজে এমন একনিষ্ঠভাবে কাজ করেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি সাহসী ও ত্যাগী দুই বোন গীতা ও ইরা কর৷
এ প্রসঙ্গে গীতা কর বলেন, এমএজি ওসমানির কাছ থেকে সনদ পাওয়ার পর আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করি৷ বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ এবং কাগজ-পত্র জমা দিতে বেশ কিছু টাকাও খরচ করেছি৷ কিন্তু কোন কাজই হয়নি৷
কৃতজ্ঞতা: ডয়চে ভেলে