ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৮:২৪:৫৪ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতীরা রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম ঈদযাত্রা: ৮ এপ্রিলের ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে আজ বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকান, ছবি নিয়ে যাকে খুঁজতো পাকসেনারা

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:২০ পিএম, ১৭ মার্চ ২০২১ বুধবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকান বেগম।  ফাইল ছবি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকান বেগম। ফাইল ছবি।

ফোরকান বেগম; একাত্তরের এক সাহসী নারী যোদ্ধা। যুদ্ধের সময় তার ছবি নিয়ে তাকে খুঁজতো পাক বাহিনী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে সামনের সারিতে থেকেছেন এই বীর নারী৷ ঢাকার রাজপথ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন স্বাধিকারের বার্তা নিয়ে৷

বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে ১৯৫০ সালের ৬ মে জন্মগ্রহণ করেন ফোরকান বেগম৷ তার বাবা মো. তমিজ উদ্দীন ভুঁইয়া এবং মা রোকেয়া বেগম৷ ফোরকান বেগমের মা একজন মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক এবং বিদ্যোৎসাহী নারী ছিলেন৷

ফোরকান বেগম ১৯৬৬ সালে ঢাকা কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা সরকারি ইন্টারমেডিয়েট কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন৷ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন তিনি৷

প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তির জন্য কীভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন সেসম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলাম। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে পরবর্তী আন্দোলনমুখর দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে মিছিল-মিটিং করেছি৷ এছাড়া স্থানীয় পরিষদগুলোর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি৷ ঢাকায় গোয়েন্দাগিরি ও গেরিলা হামলার জন্য বিশেষ বাহিনী তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি৷ ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের মাঠে এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ামাগারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি৷ এছাড়া আত্মঘাতী হামলার জন্যও কিছু ছেলে-মেয়েকে প্রস্তুত করা হয়৷ এর মধ্যে ইয়াহিয়া যখন ঘোষণা দিলেন, অধিবেশন স্থগিত করা হলো তখন পহেলা মার্চ আমরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ি৷ ২রা মার্চ আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছি৷ এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের সময় সেনা-পুলিশ তো আমাদের পক্ষে ছিল না৷ তখন আমরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রাজ্জাক ভাইয়ের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে টুপি বানিয়ে সেই টুপি পরে হাতে লাঠি নিয়ে এই জনসভা নিয়ন্ত্রণ করেছি৷ ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস ছিল৷ অন্যান্য বছর পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা এই দিবসটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করলেও ১৯৭১ সালে তারা পূর্ব-পাকিস্তানে দিবসটি পালন করেনি৷’

তিনি আরও বলেন, ‘বরং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আমরা যারা সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলাম তারা ২৩ মার্চ সকাল ১০টার মধ্যে বর্তমান পল্টন ময়দানে হাজির হয়ে প্যারেড করবো৷ সেখানে আমরা কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী হাজির হয়ে সশস্ত্র প্যারেড করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতাকে সালাম জানাই৷ আমি প্যারেডে সামনের সারিতে থেকে সালাম দিয়েছিলাম৷ সেখানেই ছাত্রলীগের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা কামরুল আলম খসরু প্রথম উপরের দিকে বন্দুকের গুলি ফায়ার করে প্যারেড শুরু হওয়ার আগে মূল বড় পতাকাটি উত্তোলন করেন৷ আমরা এসব কর্মসূচি আগে প্রচার না করলেও সেদিন পল্টন ময়দানের চারদিকে হাজার হাজার মানুষ হাজির হয়ে আমাদের প্যারেড উপভোগ করেছে এবং করতালি দিয়ে উৎসাহিত করে৷ আমরা প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খালি পায়ে বন্দুক কাঁধে নিয়ে এবং পতাকা নিয়ে প্যারেড করে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িতে যাই৷ কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে আমরা বঙ্গবন্ধুর হাতে সেই পতাকাটি তুলে দিতে পারিনি৷ আসম আব্দুর রব ভাই তখন ইকুর হাত থেকে পতাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন৷ বঙ্গবন্ধু পতাকাটি নিয়ে উঁচু থেকে জনতাকে সেটি দেখান৷ এছাড়া সেদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ মানুষ নিজেদের বাড়িতে, দোকান-পাটে, নৌকায়, গাড়িতে এমনকি গাছের উপরও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে৷ আমরা সেদিনই মনে করেছিলাম, আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম৷'

বিটগড়ে আটকা পড়লে সেখানকার রাজাকার নেতাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য রাজি করেন ফোরকান বেগম৷ আগরতলায় বাছাইকৃত নারীদের উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণে অংশ নেন৷ কেনেডির কাছে যুদ্ধ পরিস্থিতি তুলে ধরেন তিনি এবং তার সঙ্গীরা৷

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগরতলায় যাওয়ার জন্য মনি ভাই লিখলেন, অনেকে আহত হয়েছে, এখানে সেবিকার অভাব৷ আমি যেন আমার সঙ্গীদের নিয়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছাই৷ তখন আমি এবং আমার চাচাতো বোন নাসু মামুর সাথে আগরতলা রওয়ানা করি৷ কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্য বিটগড়ে গিয়ে আটকে গেলাম৷ সেখানে প‌ৌঁছে শুনলাম, পাক সেনারা আগেই ওই গ্রাম থেকে মানুষদের ধরে নিয়ে গেছে। তারা কিছু বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে৷ সেখানে সাত-আটদিনের জন্য আটকা পড়ে গেলাম৷ কারণ সিএন্ডবি রোড দিয়ে পার হওয়া যাচ্ছে না৷ পাক সেনারা খুব কড়াকড়িভাবে টহল দিচ্ছে৷ তার উপর প্রচণ্ড বর্ষা৷ এ অবস্থায় আমরা সেই এলাকায় যে রাজাকার বাহিনীর প্রধান এবং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল, ভুলক্রমে তার বাড়িতে গিয়ে উঠি৷ তবে আমরা সেখানে যে ক'দিন ছিলাম সেসময়ে তাকে অনেক করে বুঝিয়েছি এবং তার যে বাহিনী ছিল রাজাকার, সংবাদ বাহক এবং নৌকার মাঝি তাদেরও আমরা বুঝিয়েছি৷ যেন তারা পাকিস্তানিদের সহায়তা না করে বরং তাদের সাথে খাতির রাখে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আগরতলা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। আবার একইসাথে যেসব মুক্তিযোদ্ধা আগরতলা থেকে আসছে তাদেরও যেন সহায়তা করে - সেজন্য তাদের রাজি করালাম৷ এরপর আমরা আগরতলা গেলাম৷ ইতিমধ্যে সেই শান্তি কমিটির প্রধান তার দুই ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন৷'

এর আগে ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে নিজের গ্রামের মানুষদের যুদ্ধের জন্য তৈরি করেন ফোরকান বেগম এবং তার সঙ্গীরা৷ পুটিনা বিদ্যালয় মাঠে পরের দিন থেকেই প্রশিক্ষণ শুরু করেন৷

এক সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে তিনি জানান, ‘সৌভাগ্যক্রমে আমাদের গ্রামে একজন বিমান বাহিনীর এবং দুইজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন৷ তাদের সহায়তায় সেখানে খুব ভোর থেকে কলার ডগা এবং মানকচুর বড় বড় গাছ কেটে এনে সেগুলো ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ আর জমি থেকে মাটির ঢেলা এনে গ্রেনেড চালানো শেখানো হয়৷ গ্রামের প্রশিক্ষিত তরুণদের সমন্বয়ে আমরা দশ ধরণের কাজের জন্য দশটি বাহিনী গড়ে তুলি৷'

আগরতলায় গিয়ে জিবি হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে এবং শরণার্থী শিবিরে সেবা দিয়েছেন ফোরকান বেগম৷ মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড এম কেনেডি সেখানে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গেলে তিনি এবং মিনারা বেগম কেনেডির কাছে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি তুলে ধরেন৷ এসময় কেনেডির কাছে তিনি বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন এবং কেমন আছেন সেসব তথ্য জানানোর জন্য অনুরোধ করেন৷ তাদের অনুরোধে পরবর্তী সাতদিনের মধ্যেই কেনেডি বঙ্গবন্ধুর অবস্থান এবং অবস্থা সম্পর্কে জানান৷ বঙ্গবন্ধুর খবর জানার পর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও স্বেচ্ছাসেবকসহ সবাই আরো বেশি উৎসাহিত হন এবং যুদ্ধের কাজে আরো মনোযোগী হন বলে জানান ফোরকান বেগম৷

এছাড়া লেম্বুছড়া শিবিরে বাছাই করা আট-দশজন সাহসী নারীকে নিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শুরু হলে সেখানে প্রশিক্ষণ নেন ফোরকান বেগম৷ সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের দেশের ভেতরে গেরিলা হামলার জন্য পাঠাতে চেয়েছিলেন৷ সেজন্য ফোরকান বেগম এবং তার সঙ্গিরা সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন৷ কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই খালেদ মোশাররফ জানান, ফোরকান বেগমের ছবি পকেটে নিয়ে তাকে খুঁজছে পাক সেনারা৷ তাই ঢাকায় তাকে অভিযানে পাঠানো সম্ভব নয়৷ সেজন্য ফোরকান বেগমের কাছ থেকে দেশের ভেতরে থাকা তার প্রশিক্ষিত সঙ্গিদের যোগাযোগের ঠিকানা নিয়ে তাদের গেরিলা অভিযানে কাজে লাগানো হয়৷

স্বাধীন দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন ফোরকান বেগম৷ পাশাপাশি চালিয়ে যেতে থাকেন অসমাপ্ত লেখাপড়া৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি৷ এরপরে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেন তিনি৷ চাকুরি জীবনে শ্রম মন্ত্রণালয়, যুব মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ চাকুরির পাশাপাশি বাংলা একাডেমি, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, সার্ক এর সদস্য দেশসমূহের গৃহস্থ কর্মীদের সমিতি সাবাহ, লায়ন্স ক্লাব, জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থাসহ বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত৷
লেখালেখির জগতেও রয়েছে তার সরব পদচারণা৷ এখন পর্যন্ত তার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে৷ তিনি বর্তমানে রাজধানীর আজিমপুরে বসবাস করছেন।

সূত্র : ডয়চে ভেলে