ঢাকা, শুক্রবার ২৬, এপ্রিল ২০২৪ ৯:০৪:৫৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

মীরা: এক বিস্মৃতপ্রায় মুক্তিযোদ্ধার লড়াইয়ের গল্প

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:২১ পিএম, ১০ মার্চ ২০২১ বুধবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা মেহেরুন্নেসা মীরা।  ছবি: এস এম শামসুর রহমান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মেহেরুন্নেসা মীরা। ছবি: এস এম শামসুর রহমান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মেহেরুন্নেসা মীরা। ১৯৭১ সালে সাহসে বুক বেঁধে লড়াই করেছিলেন দেশ স্বাধীনের জন্য। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু তার জীবনের লড়াই আজও শেষ হয়নি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আজও তিনি লড়াই করে যাচ্ছেন বেঁচে থাকার জন্য।

১৯৫২ সালের ১০ মার্চ বাগেরহাট জেলার সরই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মেহেরুন্নেসা মীরা৷ পিতা তাসের উদ্দীন শেখ এবং মা হাজেরা বেগম৷ বাবা ছিলেন গ্রামের কৃষক৷ অভাব অনটনের সংসারে বড় হন মীরা৷ লেখাপড়ার সুযোগ পাননি তিনি৷ বরং স্থানীয় যাত্রাদলে যোগ দেন কিশোরী মীরা৷ যাত্রাদলে অভিনয় করে অর্থ উপার্জন করে সংসারে খরচ দিতেন৷ কিন্তু ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে যাত্রাপালা বন্ধ হয়ে যায়৷

লেখাপড়া না জানলেও মানসিকভাবে মীরা ছিলেন অনেক সচ্ছল। অনেকেই যা বোঝেনি, তিনি তা ঠিকই বুঝেছেন। নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে চাই স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব, বিষয়টি মীরা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন।

এভাবেই কেটে যায় দেড় বছর। চলে আসে অগ্নিঝরা একাত্তর। মীরার মা তখন কাজ করতেন ওয়াপদা কলোনির এক কর্মকর্তার বাড়িতে। সেই কলোনিতে পাকসেনা ও রাজাকারদের আসা-যাওয়া ছিল৷ ফলে মীরার সাথে তাদের দেখা হতো৷ মায়ের চাকরির সুবাদে বাগেরহাটে অবস্থানরত পাক বাহিনী আর রাজাকারদের গতিবিধি ভালোই জেনে যান মীরা। বুঝতে পারেন, দেশের জন্য তারও অনেক কিছু করার আছে। তাই একাই গিয়ে উপস্থিত হন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে।

মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাছে গিয়ে মীরা বলেন, ‘আমার মা কাজ করে ওয়াপদার এক স্যারের বাড়িতে। আমি আপনাদের কাছে মিলিটারির খবর এনে দিতে পারি। যদি আপনারা আমাকে দলে নেন।’’

মুক্তিবাহিনীর কেউই তার কথা বিশ্বাস করেননি। ভেবেছেন মীরা রাজাকারদের পাঠানো গুপ্তচর। তবে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম খোকন তখন ছিলেন নিরুপায়। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলেন না, কিভাবে বাগেরহাট থেকে হানাদারদের হটানো যায়। তাই মীরাকে বিশ্বাস করে ঝুঁকি নিলেন তিনি। মীরাকে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা মীরা, আমি তোমায় বিশ্বাস করছি। আজ থেকে তুমি আমাদের দলের একজন।’

এভাবেই বাগেরহাট মুক্তিবাহিনীর প্রথম নারী সদস্য হয়ে উঠলেন মীরা।

ওয়াপদা কলোনির কর্মকর্তা সে সময় হঠাৎ বদলি হয়ে গেলেন। সৌভাগ্যবশত, মীরার মা কাজ পেয়ে গেলেন একেবারে হানাদারদের ক্যাম্পেই! মিলিটারির ক্যাম্প বসেছিল এসডিও'র বাসভবনে। মীরার মা ঢুকে পড়লেন একেবারে অন্দরমহলে। ওদিকে মীরাও তখন কমান্ডার রফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধায়নে শুরু করেছিলেন সশস্ত্র ট্রেনিং। দু'সপ্তাহেই শিখে গেলেন রাইফেল চালানো। তারপর যোগ দিলেন গেরিলা বাহিনীতে।

এদিকে নিজেদের পরিকল্পনা যেন কোনোমতেই বাইরে পাচার না হয়, তাই হানাদাররা তাদের ক্যাম্পে কাজ করা সকলের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করল। কিন্তু মীরা তো দমে যাওয়ার পাত্রী নন। এতদিনে মীরা এক অদম্য যোদ্ধায় পরিণত হয়েছেন। সাথে ছিল তার অভিনয়ের অসামান্য প্রতিভা। তাই মুক্তিবাহিনীর সকলের সব বাধা অগ্রাহ্য করে, ভিক্ষুক বেশে তিনি হাজির হন মিলিটারিদের ক্যাম্পে।

এ প্রসঙ্গে মীরা জানান, ‘আমি অনেক সময় ভিক্ষুক সেজেও পাক সেনাদের শিবিরে যেতাম৷ ওদের কাছে গিয়ে খেতে চাইতাম৷ কিছু কথা বলতাম৷ ওরা একজন কাজের মহিলা জোগাড় করে দিতে বলে৷ তো আমাদের এলাকার বৃদ্ধ মহিলাকে সেখানে কাজের জন্য দিয়েছিলাম৷ তার কাছেও যেতাম এবং গল্প করতাম৷ আর সেসব খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতাম৷'

উর্দু জানা থাকায় সহজেই মীরা বের করে ফেলেন মিলিটারি ক্যাম্পের হাঁড়ির খবর। নিজের মায়ের সাথেও দেখা হয়। তার কাছ থেকে একদিন জানতে পারেন, বাগেরহাটের সবচেয়ে বড় রাজাকার রজব আলী খুব শীঘ্রই তার বাড়ি যাবে। এই রাজাকার যুদ্ধ চলাকালে মিলিটারির ক্যাম্পে থাকত। তার হাতে খুন হয়েছে বাগেরহাটের শতাধিক মানুষ।

প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মীরা ফিরে আসেন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। সবাইকে জানান রজব আলীর বাড়ি যাওয়ার কথা। মুক্তিবাহিনীদের জন্য এ ছিল এক বিরাট সুযোগ। মীরার তথ্য অনুযায়ী তারা লুকিয়ে থাকেন রজব আলীর বাড়ির পাশে। রজব আলী বাড়ি আসতেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিবাহিনী। কিন্তু কাপুরুষ রজব আলী অবস্থা বেগতিক দেখে নিজের হাতের হীরার আংটি থেকে হীরা মুখে দিয়ে আত্মহত্যা করে। এভাবেই মীরার কৃতিত্বে নিধন করা সম্ভব হয় বাগেরহাটের এক কুখ্যাত রাজাকারকে। এরপর মুক্তিবাহিনীর লোকেরা রজব আলীর লাশ সারা বাগেরহাট শহরবাসীকে দেখানোর জন্য শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঝুলিয়ে রাখে।

পরবর্তীতে জানাজানি হয়ে যায় রজব আলীর মৃত্যুর পেছনে মীরার ভূমিকা ছিলো। মীরার বাবার ওপর রাজাকাররা অকথ্য নির্যাতন চালায়। এরপর থেকে যুদ্ধে মীরার কর্মপদ্ধতি বদলে যায়। তিনি বাগেরহাটের সাধনার মোড়ে বসতে থাকেন ভিক্ষুক সেজে। এ সময় তার কাজ ছিল শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় ও সংযোগ স্থাপন করা। ভিক্ষুকবেশে বসে থাকা অবস্থায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা তার কাছে এসে বিভিন্ন খবর দিত, সেই খবর আবার মীরা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন।

মীরা বলেন, ‘বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে বিভিন্ন কাজের ধরণ শিখিয়ে দেয়৷ সেই অনুসারে আমি কাজ করতে থাকি৷ অনেক সময় আমাকে ছাপানো লিফলেট দিয়ে দিত তারা৷ আমি ফকির বেশে সাধনার মোড়ে গিয়ে কাগজগুলো চুপ করে ফেলে দিতাম। তারপর অন্য রিকশা নিয়ে চলে যেতাম খাদ্দার মোড়৷ আবার সেখান থেকে কলেজে গিয়ে কিছু কাগজ ফেলে দিয়ে চলে যেতাম গোপালঘাটি৷ এ কাজ করতে গিয়ে কখনো সন্ধ্যা হয়ে যতে৷ আমি নদীর ঘাটে গিয়ে মাঝিকে আকাশ বলে ডাকতাম৷ মাঝি ঠিক বুঝে যেত তাকে ডাকছি৷ সে তখন আমাকে নদীর ওপারে পৌঁছে দিত৷ আমি অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে ফিরতাম৷

এভাবেই গোটা একাত্তরজুড়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে গেছেন মেহেরুন্নেসা মীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন তিনি করে গেছেন এসব কাজ।

যুদ্ধ শেষে মীরা বিয়ে করেন এক দিনমজুরকে। এই দম্পতির কোলে আসে চার সন্তান। কিন্তু ক'বছর পরই মীরার স্বামী ছেড়ে যায় মীরাকে। কিন্তু দু:খের বিষয় সে যাওয়ার সময় মীরাকে দিয়ে যায় খারাপ মেয়ের অপবাদ।

স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর মীরার ঘাড়ে বর্তায় সন্তানের দায়িত্ব। হানাদারদের সাথে লড়াইয়ে জিতলেও দারিদ্র্যের সাথে লড়াইয়ে হার মানেন মীরা। অভাবের কারণে তিনি সন্তানদের পড়াশুনা করাতে পারেননি। এমন কি দু বেলা দুমুঠো খাবারও তুলে দিতে পারেননি সন্তানদের মুখে। তবু তার আশা ছিল, বঙ্গবন্ধু হয়ত তাদের জন্য কিছু করবেন। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সব আশা ছেড়ে দেন মীরা।

এর বাড়ি, ওর বাড়ি কাজ করে এতদিন জীবিকা নির্বাহ করেছেন মীরা। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় কিছু দিন বাগেরহাটের বাজারে বসে সবজি বিক্রি করেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। হাড়ি-বাসন মাজা আর সবজি কোটার কাজ করেছেন বাগেরহাট লঞ্চঘাটের এক দোকানে। বর্তমানে বাস করছেন বাগেরহাট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদীর পাড়ে জরাজীর্ণ এক ঘুঁপড়িঘরে। জীবন ও নদীর সাথে ক্রমাগত লড়াই করে চলছে তার দিনক্ষণ।

মীরার সম্পর্কে এক অদ্ভুত স্মৃতিচারণা করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক)। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে দ্বিতীয় গোলন্দাজ বাহিনীকে সংগঠিত করেছিলেন। ২০১২ সালের দিকে তিনি বাগেরহাটের মোল্লারহাটে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে। সেখানে তার সাথে দেখা করতে আসেন এক নারী, হাতে যার টুকরি আর পরনে ছেঁড়া শাড়ি।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাজ্জাদকে সেদিন তিনি খুবই কড়া গলায় বলেছিলেন, ‘আমার নাম মেহেরুন্নেসা মীরা। মুক্তিযুদ্ধ করলাম আমি-আপনি। আমরা ছিলাম সহযোদ্ধা। আপনি হয়ে গেলেন বীরপুরুষ, আমি হয়ে গেলাম খারাপ মাইয়া, সমাজের বিচার ঠিক নেই। আমার সনদ নেই। সবাই বলে, তুই বস্তিতে থাকস সনদ দিয়া কী করবি?’

এই স্মৃতিচারণা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর অবশ্য মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পেয়েছেন তিনি। এরপর থেকে ভাতাও পান। সাথে জুটেছে টুকটাক আরো কিছু সম্মাননা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসেও প্রশ্ন থেকে যায়, এ কি যথেষ্ট একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্যে!

কৃতজ্ঞতা: ডয়চে ভেলে