ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১২:১৫:৪১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতীরা রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম ঈদযাত্রা: ৮ এপ্রিলের ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে আজ বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া

মুক্তিযোদ্ধা তুষি হাগিদক: এক গারো নারীর যুদ্ধের কাহিনি

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৪:৩০ পিএম, ২৮ মার্চ ২০২১ রবিবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা তুষি হাগিদক

বীর মুক্তিযোদ্ধা তুষি হাগিদক

একাত্তরের উত্তাল সময়গুলোতে বাঙালীদের পাশাপাশি আদিবাসীরাও দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। আদিবাসী অনেক মেয়ে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দেশের জন্য কাজ করেছেন। তারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করা, আহতদের সেবাদান, তথ্য সংগ্রহসহ নানা কাজ করেছেন। এরকমই একজন গারো আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধা তুষি হাগিদক।  
এই বীর নারীর জন্ম নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার রামপুর গ্রামে। বাংলাদেশ বেতারের গারোদের জন্য অনুষ্ঠান সালগিওলের প্রথম দিকের প্রথম সারির জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন মিশনারি স্কুলের শিক্ষিকার কাজে করেছেন। তুষি হাগিদক স্বনামধন্য কবি ও গীতিকার মতেন্দ্র মানখিনের স্ত্রী।
তুষি হাগিদক বলেন, আমি একমাস সশস্ত্র গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। ইচ্ছা থাকা সত্বেও প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি বা সে সুযোগ হয়ে উঠেনি। আমাদের যুদ্ধে পাঠাননি উর্ধতন কর্মকর্তারা। আমি যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক সেবা দিতাম। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা দিতাম মাত্র। তাই নিজেকে আমি সে ধরনের মুক্তিযোদ্ধা মনে করি না।
তুষি হাগিদক জানান, গত বছর সংশধিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম উঠে এসেছে। তিনি ছাড়াও আরো ১৬ জন মেয়ের নামও উঠে এসেছে এ তালিকায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজ এলাকায় তিনিসহ ১৭ জন গারো মেয়ে একসাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে শুধু রাইফেল চালানো নয় নয়, এস এম জি, এল এম জি, গ্রেনেড চার্জ করা সবকিছুরই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এই বীর নারী। এমন কি কিভাবে স্পাই সেজে ঢুকে পাকসেনাদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে হবে সে বিষয়েও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো।     
তুষি হাগিদক জানান, আদিবাসীদের আলাদা কোনো স্বার্থ ছিলো কি ছিলো না তাতো জানি না। কিন্তু দেশ তো আমাদের সবার, আমাদের পূর্বপুরুষদের। তাই দেশের প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসার টানেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক আর্মিরা আমাদের গ্রামের খুব কাছেই রংরা ক্যাম্পে ঘাটি গেড়ে বসেছিল। জেবি নকরেক নামে এক যুবক আমাদের বাড়িতে থাকত। একদিন জেবি নকরেককে রাস্তায় পেয়ে আর্মিরা বলে, এই ছোকরা লাড়কি হায় না লাড়কি? যা লাড়কি লিয়ে আয়। বলে নির্দেশ দেয় তাকে। লাড়কি বলতে জেবি বুঝেছিল লাককি বা খড়ি। জেবি এক বোঝা লাকড়ি মাথায় করে নিয়ে ক্যাম্পে গেল। আর তা দেখে পাক আর্মিরা রেগে গিয়ে জেবিকে ভীষণ প্রহার করে ছেড়ে দেয়। এই ঘটনা বাসায়ে এসে জেবি আমাদের বলেছিল। নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা সে রাতেই ভারতে পালিয়ে যাই। লাড়কি হায় না, কথা শুনে ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছি পুরুষ হলে আমিও মুক্তিযুদ্ধে চলে যেতাম। পাকসেনাদের গুলি করে মেরে ফেলতাম। কিন্তু আমি তো মেয়ে! এরপরও ভেবেছি যদি সুযোগ পাই যুদ্ধে যাবো।
তুষি হাগিদক বলেন, এক সময় সে সুযোগও পেলাম। একদিন প্রতিবেশী এক দিদি মল্লিকা ঘাগ্রা এসে জানালো, রংরা ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন চৌহান পুরুষদের পাশাপাশি নারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যেও একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছেন। নারীদেরও মুক্তিযুদ্ধে রিক্রুট করা হচ্ছে। আমি রিক্রুট হবো কি না মল্লিকা জানতে চায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যাই। আমরা ১৭ জন নারী একসাথে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। আমাদের ক্যাম্পের নাম ছিল কমলা ক্যাম্প। ক্যাপ্টেন চৌহানের ছোট মেয়ের নামে নামকরণ করা হয়েছিল আমাদের ক্যাম্পের।
তুষি হাগিদক জানান, তিনি ছাড়াও মল্লিকা ঘাগ্রা, ছায়া বনোয়ারী, মগ্ধলিনা নেংমিঞ্জ, সঞ্চিতা জরিনা রেমা, পরিচয় চিসিম, সেলিনা হাউই, জিতা নকরেক, টুনটুনী নকরেক, রীতা রেমা, সুজানা জাম্বিল, মুকুল আজিম, রচিতা হাগিদক, বেঞ্জিনা নকরেক, নীকাবতী রেমা, অনিতা নকরেক এবং হাসিনা বনোয়ারী ওই ক্যাম্প কে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
তুষি হাগিদক জানান, তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত পাঠানো হয়নি। তাছাড়াও এক সময় যুদ্ধ জয়ের সময়টাও ঘনিয়ে এসেছিল। তাদের মূলত তিনটি কারণে রিক্রুট করা হয়েছিল। প্রথমত আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রুষা ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া। দ্বিতীয়ত গুপ্তচর বা গোয়েন্দাগিরির কাজ করা এবং তৃতীয়ত প্রয়োজনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা।
তুষি হাগিদক বলেন, স্মরণীয় ঘটনা তো আছেই কোনটা রেখে কোনটা যে বলি। এক হচ্ছে-গোয়েন্দাগিরি কীভাবে করতে হবে, কীভাবে প্রেমের অভিনয় করতে হয়, কীভাবে ভালবাসার ভান করতে হবে এসব ক্যাপ্টেন পিয়ারীলাল আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের মধ্যে সুজানা জাম্বিলা ছিল সব থেকে সুন্দরী। এই লাড়কী হাম তুমসে পেয়ার কারেগা বলে ক্যাপ্টেন পিয়ারিলাল সুজানার পাশে গিয়ে বসে। সুজানা তখন বসে থাকা বেঞ্চ থেকে ভয়ে লাফিয়ে উঠে খরের কোণায় পরে গিয়েছিলো। ওই কঠিন সময়েও ওর অবস্থা দেখে আমরা সবাই হেসে উঠেছিলাম।
তিনি বলেন, মনে পড়ে এক আহত বাঙালির মুক্তিযোদ্ধাকে আমাদের ক্যাম্পে আনা হয়েছিল। তার ডান হাতে গুলি লেগেছিলো। ছেলেটার নাম রুহুল আমিন। পাক আর্মিরা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলেছিলো। ছেলেটি পালাতে না পেরে বিলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পরে। কচুরিপানা দিয়ে মাথা ঢেকে লুকিয়ে থাকে। এভাবে বিলের মধ্যে ছেলেটি ৩ কে ৪ দিন লুকিয়ে ছিলো। চার দিনের মাথায় তার সহযোদ্ধারা তাকে উদ্ধর করে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে। তার একটা হাত পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। ড্রেসিং করতে গিয়ে আমি তার ওপরেই বমি করে দিয়েছিলাম। তাকে পাঠানো হয়েছিল টুরায় (টুরা শহরে)। ছেলেটি মরে গিয়েছিলো নাকি বেঁচে আছে জানা নেই। ওই ঘটনাটা মনে পড়লে আজও দারুন খারাপ লাগে, নিজেকে অপরাধি মনে হয়।
এই মুক্তিযোদ্ধা জানান, একবার খুবই সুন্দরী শিক্ষিত ও স্মার্ট এক বাঙালি তরুণী তাদের ক্যাম্পের অদূরে এক বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সে ছিল পাকিস্তানী গোয়েন্দা। তার হাতে ছিল একটি ঘড়ি।
তিনি বলেন, সে আমাদের সাথে মিশতো কথা বলতো আর সুযোগ পেলেই কথা বলত ওই ঘড়িতে কান রেখে। মেয়েটি পিয়ারিলালের সাথে ভাব জমাতে চেষ্টা করত। তার লক্ষ্য ছিল পিয়ারিলালকে কৌশলে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়া। আমরা বিষয়টি ক্যাপ্টেন চৌহানকে জানাই।
তিনি আরও বলেন, মেয়েটি সে সময় জায়গা বদল করে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। অন্যদিকে আমরা সে সময় মল্লিকা দিদিকেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আসলে মল্লিকা দিদিকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই বাঙালির তরুণীর পেছনে। তার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। মল্লিকা দিদি পরে জানান সেই বাঙালি তরুণীকে ভারতীয় আর্মিরা গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তুষি হাগিদক জানান, এখনো স্পষ্ট মনে আছে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মানচিত্র খচিত যেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল সেই সনদপত্র তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন চৌহান। বলেছিলেন কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। এই সনদপত্রগুলো যত্ন করে রাখবেন।
তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন, কিন্তু সেই সনদপত্র যত্ন করে রাখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ মেরে ফেলার পর গুজব ছড়িয়ে পড়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তাদেরও মেরে ফেলা হবে, নয় তো জেলে পাঠানো হবে। ভয়ে সে সনদপত্র পুড়িয়ে ফেলেছিলাম।
তুষি হাগিদক জানান, ব্যক্তিগত চাওয়া বা দাবি কোনটাই নেই। কিন্তু সরকার আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদেরও সম্মান স্বীকৃতি মর্যাদা দিক এটা চান তিনি। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য আরো শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ করে দিক সরকার এটাই তার প্রত্যাশা।
তুষি হাগিদক বলেন, আমাদের এলাকাটি গারো আদিবাসী অধ্যাষিত এলাকা। আমাদের এলাকায় সবকিছুই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করা হচ্ছে। দেশ স্বাধীন করতে গারো অধিবাসীদেরও অনেক অবদনায় রয়েছে। গারো মুক্তিযোদ্ধাদের নামেও দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণ করা উচিত।

কৃতজ্ঞতা : থকবিরিম .কম