ঢাকা, শুক্রবার ২৬, এপ্রিল ২০২৪ ৮:১৬:৩১ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

মুক্তিযোদ্ধা পাপড়ি বসু: যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতেন যিনি

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:২৩ পিএম, ২৭ মার্চ ২০২১ শনিবার

নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন পাপড়ি বসু

নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন পাপড়ি বসু

কুমিল্লার মেয়ে পাপড়ি বসু৷ ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল সময়ে দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। সীমান্তে গিয়ে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। আগরতলায় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সাথে নেচে-গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন৷ দিনের পর দিন রুটি বানিয়ে পাঠিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের৷ সেবা করেছেন আহত যোদ্ধাদের। স্কুল জীবন থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে ছিলেন এই সাহসী দেশপ্রেমী নারী।
কুমিল্লায় ১৯৫৬ সালের ২ মার্চ জন্ম তার৷ মা মায়া ধর এবং বাবা প্রমথ চন্দ্র ধর৷ ছোট থেকেই নাচ-গানসহ সাংস্কৃতিক ধারায় নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছেন পাপড়ি৷ একইসাথে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য ছিল তার মধ্যে৷ ফলে তিনি যখন মাত্র ক্লাস এইটের ছাত্রী তখনই পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেওয়া একটি পাঠ্যবই প্রত্যাহার করার দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন পাপড়ি বসু৷ এমনকি দাবি আদায়ে শিক্ষা বোর্ডের সামনে অনশন ধর্মঘট করেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে৷ এ সময় তৎকালীন পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মীদের মুখোমুখিও হন তারা৷ ফলে মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার নামে পরিচিত ফরিদা বিদ্যায়তনের ছাত্রী হিসেবে সেই বিদ্যালয় জীবন থেকেই মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন পাপড়ি৷
এরপর আসে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালরাত্রি৷ এক সাক্ষাৎকারে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর এই দিনগুলো সম্পর্কে পাপড়ি বসু বলেন, আমাদের বাড়িটা বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারের কাছে। এ বাড়িতে বিশাল মাঠ ছিল৷ এই মাঠে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ শুরু হয়৷ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, যুদ্ধ আসন্ন৷ তাই আমরা সেভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলাম৷
তিনি বলেন, একদিন সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হলো৷ সেদিন শুধু কুমিল্লাতে নয়, সারাদেশে পাক হানাদার বাহিনী হামলা শুরু করে৷ আমাদের বাসাটি পুলিশ লাইন থেকে একটু দূরে ছিল৷ ডিনামাইট দিয়ে প্রতিবেশী রুস্তম আলীর বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হলো৷ সেই রাতের কথা কোনোদিনই ভুলবো না৷ আমাদের বাসার দু'টো বাসা সামনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যতীন্দ্র ভদ্রের বাসা ছিল৷ তার দুই ছেলে ডাক্তারি পড়তো। কাজল এবং রতন৷ বাবা-ছেলে এবং তাদের বাড়ির ভাড়াটিয়াসহ প্রায় ১০ থেকে ১২ জনকে একসঙ্গে মেরে ফেলে পাকসেনারা৷ তবে তার মেয়ে শুভ্রা আমাদের বাড়ির ভেতর দিয়ে পেছনের দিকে পালিয়ে বেঁচে যায়৷
পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে উল্লেখ করে পাপড়ি বসু বলেন, এ অবস্থায় আমরা আর আমাদের বাড়িতে থাকতে পারিনি৷ আমরা লাকসাম রোডে গিয়ে এক আত্নীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম৷ কিন্তু সেখানেও বেশি সময় থাকা সম্ভব হলো না৷ পরের দিন আমরা দেখলাম মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দুই সংগঠক এন পি রায় চৌধুরী এবং প্রকাশ সাধুকে নির্মমভাবে গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হলো৷ এমনকি সাথের কুকুরটিকেও মারা হয়েছিল৷ এরপর কারফিউ শিথিল হলে আমরা আমার মামার সাথে বুড়িচং দিয়ে পায়ে হেটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আগরতলায় চলে যাই৷
দেশের মুক্তির জন্য আরো বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে কখনো ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে নানা বিপদ-আপদ মাড়িয়ে ভারতে পৌঁছান পাপড়ি এবং তার সঙ্গিরা৷ সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেন।
সেসব ঘটনা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে আমরা আমার জেঠিমার বাড়িতে উঠলেও পরে ‘সূর্যমনি’ শিবিরে চলে যাই৷ সেখানে আমরা একটি গোষ্ঠী তৈরি করি৷ অভিনেত্রী সুজাতার বড় বোন কৃষ্ণাসহ আমরা নৃত্যশিল্পী অসিত চৌধুরীর নেতৃত্বের একটি সাংস্কৃতিক ও নাট্য গোষ্ঠী গড়ে তুলি৷ সে সময় আমার দাদার এক বন্ধু একটি গাড়ি দিয়েছিলেন৷ সেই গাড়িতে করে আমরা বিভিন্ন জায়গায় নাচ-গান করতাম৷ সেই নাচ-গান পরিবেশন করে আমরা যে অর্থ পেতাম সেটা নারীনেত্রী সেলিনা বানুর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতাম৷ এ টাকা আহত মুক্তযোদ্ধাদের চিকিৎসায় খরচ করা হতো। পরে যখন অনেক মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত হয়ে আসতে থাকলেন তখন সেলিনা বানু আমাদের বিশ্রামনগর শিবিরে নিয়ে গেলেন তাদের সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য৷
তিনি বলেন, এক সময় ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেন গুপ্তের সাথে পরামর্শ করে আমার জেঠিমা আমাদের রুটি বানানোর দায়িত্ব দেন৷ ফলে নাচ-গানের পাশাপাশি চিত্রাদি, আমি, আমার বড় বোন ভারতীসহ সবাই মিলে রুটি করে জেঠিমার হাতে তুলে দিতাম, কখনো সেলিনা বানুর হাতেও দিতাম৷ সেদিনগুলোতে আমরা প্রতিদিন অনেক রুটি তৈরি করেছি৷
নারী মুক্তিযোদ্ধা পাপড়ি বসু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নাচ-গান করে অর্থ ও ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন৷ সীমান্ত এলাকার সংবাদ পরিবেশনে সহায়তা করেছেন এবং পত্র-পত্রিকায় লেখার মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বের কাছে দেশের যুদ্ধাবস্থা তুলে ধরেছেন৷
এ প্রসঙ্গে পাপড়ি বসু বলেন, আমার মামা নীতিশ রায় চৌধুরী ছিলেন আকাশবাণী'র সংবাদদাতা৷ তিনি যুদ্ধের সময় সীমান্ত এলাকা থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতেন৷ মাঝে মাঝে আমি তার সাথে খবর সংগ্রহের জন্য যেতাম৷ আবার কখনও তিনি একাই খবর নিয়ে আসতেন৷ সে সময় আমি খুব লেখালেখি করতাম৷ তাই মামার বিশ্বাস ছিল অপ্রয়োজনীয় সংবাদগুলো আমি ঠিকঠাক মতো এডিট করতে পারবো৷ তাই কখনও মামার সাথে বসে আবার কখনও আমি একাই সংবাদগুলো কেটেছেঁটে সম্পাদনা করতাম৷ পরের দিন আকাশবাণী থেকে এই সংবাদগুলোর প্রায় অংশই দেব দুলাল কিংবা সান্যাল দা’র কণ্ঠে ভেসে আসতো৷ মামা মে মাসে এসেছিলেন৷ আগস্ট পর্যন্ত থেকে আবার কলকাতা চলে যান৷ এসময় আমি তার সাথে সংবাদগুলো পরিবেশনের কাজ করতাম৷ সেসময় আমি ৩ থেকে ৪টি নিবন্ধ লিখেছিলাম৷ যুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধীর মানবিকতা ও মহানুভবতা দেখেছি। আমরা প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম৷ আমাদের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কীভাবে খাবার সরবরাহ করা হতো সে বিষয়ে আমি লিখেছিলাম৷ আনন্দবাজার পত্রিকায় সেই নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল৷ শিরোনাম ছিল ‘মানবিকতার প্রশ্নে ইন্দিরাজি'৷ সেই লেখাটি খুব সমাদৃত হয়েছিল৷
এছাড়া দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই দেশের মানুষ নিজেদের কীভাবে প্রস্তুত করছিলেন তারই একটি নমুনা তুলে ধরেন তিনি৷
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২১ মার্চ দিনটির কথা মনে পড়ে৷ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেখতে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন৷ তখন আমরা তাকে ছানার সন্দেশ খেতে দিয়েছিলাম৷ তখন তিনি বলেছিলেন, পুরোটা খাওয়া যাবে না৷ দেশে খুব ক্রান্তিলগ্ন৷ জাহাজে ভরে সব সৈন্য চলে আসবে কিছুদিনের মধ্যেই৷ তাই আমরা একটি খাবারের চার ভাগের এক ভাগ খাবো৷ বাচ্চারা পেট পুরে খাবে আর তোমরা খাবে তিন ভাগের দুই ভাগ৷ সেইদিনই তার সাথে আমার শেষ দেখা৷ এর মাত্র সাত দিন পর ২৯ মার্চ তাকে হত্যা করা হয়৷
দেশ স্বাধীন হলে ১৬ ডিসেম্বর জাসদের নেতা রাশেদ খান মেনন এবং জেঠিমা শান্তি ধরের সাথে আখাউড়া দিয়ে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন পাপড়ি বসু৷ এসময়ের হৃদয় বিদারক একটি ঘটনার কথা জানান তিনি।
তিনি বলেন, তখন দেশে বিজয়ের পতাকা উড়ছে৷ আমরা সীমান্তের কাছে থাকায় পতাকা দেখতে পাচ্ছিলাম৷ কিন্তু সীমান্ত দিয়ে আসার সময় আমি নিজ চোখে দেখলাম পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার শিকার কিছু বীরাঙ্গনাকে৷ আমাদের সঙ্গে ট্রেনে চার থেকে পাঁচজন বীরাঙ্গনা ছিলেন৷ তাদের মধ্যে আমার এক আত্মীয়ও ছিলেন৷ আমাদের এক দাদার মেয়ে৷ এই ঘটনাটা আমার জন্যে খুব বেদনার এবং প্রেরণারও বটে৷
নতুন দেশে ফিরে আবারও লেখাপড়া শুরু করেন পাপড়ি বসু৷ ১৯৭২ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন৷ পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে লেখাপড়া সম্পন্ন করেন এই নারীনেত্রী৷ এরপর ইস্পাহানি কলেজে অধ্যাপনা করেন পাপড়ি বসু৷ তবে এক সময় নিজেই কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সমাজ সেবায় জড়িয়ে পড়েন৷
তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদে সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির দক্ষিণ এশিয়ার পরিষদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি৷
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন পাপড়ি বসু। #