ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৮:৪৭:১৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতীরা রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম ঈদযাত্রা: ৮ এপ্রিলের ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে আজ বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া

রূপগঞ্জের অহংকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ঝুনু

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:২০ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২১ শুক্রবার

রূপগঞ্জের অহংকার বীর মুক্তিযোদ্ধা মিনারা বেগম ঝুনু

রূপগঞ্জের অহংকার বীর মুক্তিযোদ্ধা মিনারা বেগম ঝুনু

পাকসেনাদের টহল ব্যাহত করতে কখনও পানিতে নেমে আবার কখনও গাছের উপর থেকে গ্রেনেড ছুঁড়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মিনারা বেগম ঝুনু৷ আগরতলায় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠন করেন৷ মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন ঝুনু।

কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত মিনারা বেগম৷ যুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন বীরদর্পে৷ ঝুনু কখনো সংগঠক, কখনো সৈনিক আবার কখনো গেরিলা হিসাবে মুক্তিযোদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার দাউদপুর গ্রামে ১৯৫২ সালের ১ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন তিনি৷ তার বাবা শামসুল ইসলাম ভুইয়া এবং মা জুবাইদা বেগম৷ ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় থেকেই ছাত্রলীগের সাথে জড়িয়ে পড়েন৷

ঢাকার গভর্নমেন্ট ইন্টারমেডিয়েট গার্লস কলেজ এবং তেজগাঁও কলেজের ছাত্রী ছিলেন মিনারা৷ কলেজ ছাত্রী হয়েও দেশের মুক্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীর চর্চাকেন্দ্র এবং কলা ভবনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ তবে সেটিই তার একমাত্র প্রশিক্ষণ নয়। সেটি ছিল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির শুরু৷ এরপর দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ করার জন্য আরো বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র চালনা, গেরিলা এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন মিনারা৷

২৫ মার্চের কালো রাতে পাক বাহিনীর নৃশংসতা ও গণহত্যার কথা স্মরণ করে তিনি জানান, ‘২৫ মার্চ রাতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় আমার বোনের বাসায় ছিলাম৷ সেখানে কালোরাত্রির হত্যাযজ্ঞের ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা৷ রাত বারোটায় চারদিকে মুহুর্মুহু গুলিতে প্রকম্পিত অবস্থা৷ আমি এবং আমার বোনের ছেলে ক্রলিং করে করে বাসার মধ্যে চলাফেরা করতাম। জানালা দিয়ে বাইরের ঘটনা উঁকি দিয়ে দেখতাম৷ ঘরের মধ্যে গুলি এসে মাথায় বা শরীরে লাগার ভয় ছিল৷

তিনি বলেন, মধ্যরাতে গোলাগুলি কিছুটা কমে আসার পর জানালা দিয়ে দেখলাম, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তখন ইকবাল হল ছিল) পেছনে খেলার মাঠে লাশের স্তূপ৷ খড়ের পালা যেমন হয়, তেমনভাবে লাশ এনে এনে জমা করা হয়েছে।’

২৭ মার্চ সান্ধ্যআইন শিথিল করা হলে রূপগঞ্জে নিজ গ্রাম দাউদপুরে চলে যান তিনি এবং তার সঙ্গিরা৷ সেখানে তিনি এবং ফোরকান বেগমসহ অন্যান্যরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করা শুরু করেন৷

তিনি বলেন, সেসময় ঢাকা নগরীকে আক্রমণ করতে হলে রূপগঞ্জ দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের আসতে হতো৷ আমরা দু'জন তখন মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়া, যাত্রার পরিকল্পনা, থাকা-খাওয়া সবকিছুর ব্যবস্থা করতাম৷ এছাড়া আমরা মেয়েদের এবং ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে তথ্য সরবরাহের কাজ করাতাম৷ মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হতো। তাই শিশুদের এই কাজে লাগাতাম বেশি৷’

তবে কিছুদিন পর মিনারা বেগমসহ অন্যান্যদের নেতৃবৃন্দ নির্দেশ দেন ওই এলাকা ছেড়ে ভারতে চলে যেতে৷ এক বাহকের হাতে পাঠানো চিঠিতে এ নির্দেশ দেয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওখানে আমরা যখন কাজ করছিলাম তখন মণি ভাই (শেখ ফজলুল হক মণি) আমাদের চিঠি পাঠান। তিনি জানান, এখানে আমাদের আর থাকা নিরাপদ নয়৷ আমাদের কাজের কথা জানাজানি হয়ে গেছে৷ তাই পত্রবাহকের সাথেই যেন ভারতে চলে যাই৷ নাসির মামার সাথেই আমি এবং ফোরকান বেগম আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই৷ নরসিংদীর কাছে আসতেই আমরা পাকসেনাদের সামনে পড়ে যাই৷ গ্রাম পুড়ানোর জন্য যাচ্ছিল পাকসেনারা৷ সেখান থেকে অনেক কৌশল করে রক্ষা পাই আমরা৷’

তারপর করিমপুর হয়ে কসবার ভিটগড়ে যান মিনারা বেগম এবং তার সঙ্গীরা৷ ভিটগড়ে অমাবশ্যার রাতে ভুল করে শান্তিবাহিনীর প্রধানের বাড়িতে গিয়ে ওঠার ঘটনা সম্পর্কে মিনারা বেগম জানান, ‘ভিটগড়ে আওয়ামী লীগের এক লোকের বাড়িতে আমাদের আশ্রয় নেওয়ার কথা৷ কিন্তু অন্ধকার রাতে আমরা গিয়ে উঠি শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান কালু সর্দারের বাড়িতে৷ আমরা ঘটনা বোঝার পর নিজেদের রক্ষার জন্য বুদ্ধি করি৷ কালু সর্দারের নাতনি রোজী এবং পরিবারের অন্যান্য সবার সাথে মিশে গেলাম৷ এমনকি আশেপাশের বাড়িগুলোর ঝি-বউদের সাথেও খাতির জমালাম৷ এক পর্যায়ে কালু সর্দারকেও আমরা বোঝাতে সক্ষম হই। এ সময় তিনি তার ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠাবেন বলে কথা দেন এবং তিনি তার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন৷ পরে তার দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে৷ তারা আমাদের সাথে আগরতলায় গিয়ে দেখা করেছিল৷'

এই বীর নারী মুক্তিযুদ্ধা বলেন, ‘কালু সর্দারের বাড়ি থেকে আমরা গেলাম ভিটগড়ে নিখিল দা’র বাড়িতে৷ উনি তখন ঐ অঞ্চলের যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায়, তাদের ওপারে পারাপার করতেন৷ তিনি আমাদের একটা জায়গায় নিয়ে গেলেন থাকার জন্য৷ সেখানে অনেক বাড়ি-ঘর থাকলেও তেমন লোকজন নেই। জায়গাটার অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ায় আগেই সবাই অন্যত্র চলে গেছে৷ সেই জনমানবশূন্য গ্রামে আমরা দু'টি মেয়ে আর নাসির মামা থাকলাম৷ নিখিল দা আমাদের খাবার-দাবারের আয়োজন করতেন৷ এসময় রাতে আমরা তার সাথে যুদ্ধের কাজ করতাম৷ চৌদ্দগ্রামের পাশ দিয়ে যে সিঅ্যান্ডবি রোড আগরতলা গেছে সেখানে পাকসেনারা টহল দিতো৷ যাতে করে কোন মুক্তিযোদ্ধা ওপারে পার হতে না পারে, কিংবা কোন মুক্তিযোদ্ধা এপারেও না আসতে পারে৷ আমাদের কাজ ছিল পাক সেনাদের এই টহল বাহিনীটাকে নস্যাৎ করে দেওয়া৷ আমি, নিখিল, ফোরকান আমরা অনেক রাতে তাদের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতাম৷ পাক সেনাদের গাড়ির চাকা নষ্ট করে ফেলতাম৷ ফলে তারা আর টহল দিতে পারতো না৷ অনেক সময় এমন হয়েছে, গ্রেনেড ছুঁড়ে পানিতে ডুব দিয়ে অপেক্ষা করেছি৷ পরে ওরা চলে গেলে পানি থেকে উঠেছি৷ পায়ে জোঁক লেগে থাকতো৷ জোঁক টেনে টেনে ছুটাতাম৷

মিনারা বেগম বলেন, ‘জোঁকের কামড় সহ্য করতে না পেরে আমি একদিন হিজল গাছে চড়লাম৷ এ সময় পাকসেনারা গুলি ছুঁড়ছিল৷ ওরা সাধারণ উচ্চতায় গুলি করে৷ গাছের উপরেও গুলি করতো না আবার পানিতেও গুলি করতো না বলে সুবিধাই হয়েছিল৷ পাকসেনারা যখন চলে গেল তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে৷ আমি গাছ থেকে নেমে আসলাম৷ তখন পথে দু'একজন লোককে দেখা গেল৷ আমি তখন লুঙ্গি পরতাম এবং মাথায় গামছা বেঁধে রাখতাম৷ কিন্তু গাছ থেকে লাফিয়ে নামার ফলে আমার লম্বা চুল বের হয়ে গেছে৷ তখন একজন বলে ওঠলো, ‘আরে, এ তো মাইয়া মানুষ৷ গাছে চড়ে বসে ছিল৷ আমি চলে আসলাম৷ কিন্তু কানে ভেসে এলো ওরা বলাবলি করছিল, এরা মুক্তিবাহিনী৷ মাইয়া মানুষ-পুরুষ মানুষ সব কাজ করতাছে এক সাথে৷’

মিনারা বেগম বলেন, ওই গ্রামের আশেপাশে যে কয়জন হিন্দু নারী ছিল তাদের আমরা কলেমা শিখাতাম, নামাজ শিখাতাম এবং মুসলমান মেয়েদের মতো করে কাপড় পরা শিখাতাম৷ যাতে বিপদ হলে আত্মরক্ষা করতে পারে৷ রাতের বেলা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতাম৷ আর দিনের বেলায় এসব কাজ করতাম৷’

সেখান থেকে কিছুদিন পর আগরতলায় চলে যান মিনারা বেগম এবং তার সঙ্গীরা৷ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে মিলিত হন তারা৷ সেখানে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী তৈরি করেন৷ এই বাহিনীর পরিচালনা পরিষদে দপ্তর সম্পাদিকা ছিলেন মিনারা বেগম৷ এই বাহিনীর নেতৃত্বে আরো যারা ছিলেন তাদের মধ্যে ফোরকান বেগম, ফরিদা মহিউদ্দীন, জাহানারা হক অন্যতম৷

এই বাহিনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মিনারা বেগম বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনীর অনেকগুলো কাজ ছিল৷ তার মধ্যে সেবিকা হিসেবে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া অন্যতম৷ কারণ সেসময় অনেক সেবিকা প্রয়োজন ছিল৷ মুক্তিযোদ্ধারা আহত হয়ে আসতেন৷ তাদের চিকিৎসা সেবার জন্য এটা জরুরি ছিল৷ তাই আমরা শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে মেয়েদের সংগ্রহ করে তাদের সেবিকা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দিতাম৷ এছাড়া কিছু বিপ্লবী বই সংগ্রহ করে আমরা একটি পাঠাগার গড়ে তুলি৷ এসব বই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পড়তে দিতাম৷ যাতে তাদের মনোবল ভেঙে না পড়ে৷ এছাড়া নারীদের আরেকটি দলকে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ কিছুদিন পর নয়জন মেয়েকে বাছাই করে আরো উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়৷ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় লেম্বুচড়া প্রশিক্ষণ শিবিরে৷ সেখানে আমিনুল হক ছিলেন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপক৷ আর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ভারতের সেনা বাহিনীর মেজর আর সি শর্মা ও মেজর কে বি সিং৷ ছোট-খাটো অস্ত্র চালনা তো আমরা আগেই শিখেছিলাম৷ সেখানে আমাদের শেখানো হয় কীভাবে বিমান বন্দর কিংবা বিমান ধ্বংস করতে হবে সেসব কৌশল৷ এসময় আমাদের খুব গোপন জায়গায় রাখা হতো৷ নেতৃবৃন্দ কয়েকজন ছাড়া কেউ জানতো না যে আমরা কোথায় আছি৷’

যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে বীরমুক্তিযোদ্ধা মিনারা বেগম তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোং-এ  চাকরিতে যোগদান করেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ডিজিএম (অর্থ) পদে কর্মরত ছিলেন। মিনার বেগম ঝুনু একজন লেখক, গীতিকার ও ছড়াকার। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের মা। তার ছেলে শান্তনু আদিব ও মেয়ে আজমা আলী পূর্ণ। তার স্বামী মরহুম অ্যাডভোকেট আলতাফ আলী।