ঢাকা, বুধবার ২৪, এপ্রিল ২০২৪ ২০:০৬:০৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
খালেদার গ্যাটকো মামলায় চার্জগঠনের শুনানি পেছাল কুড়িগ্রামে তাপদাহ: বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা ‘পদ্মশ্রী’ গ্রহণ করলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কাতার-বাংলাদেশ ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই

শহীদ সেলিনা পারভীন, ‘শিলালিপি’তে লিখেছিলেন স্বাধীনতার গান

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:৫৭ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২১ বুধবার

শহীদ সেলিনা পারভীন।  ফাইল ছবি।

শহীদ সেলিনা পারভীন। ফাইল ছবি।

আমার কবিতাখানি রাখিও যতনে/আমি আবার আসিবো ফিরিয়া...। হ্যাঁ শহীদরা বারবার আমাদের কাছে ফিরে আসেন। শহীদদের মৃত্যু নেই। তারা চির ভাস্বর। তারা বেঁচে আছেন আমাদের স্মৃতিতে, অন্তরে, ভালোবাসায়।

শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। আজ ৩১ মার্চ তার জন্মদিন। দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন এই লড়াকু বীর নারী। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৮০ বছর।

তৎকালীন পূর্ব বাংলার মেধাবী সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। তিনি সাপ্তাহিক ‘ললনা’ ও ‘শিলালিপি’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশকে ভালোবেসে প্রাণ দিয়েছেন সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন ছিলেন স্বাধীনচেতা এক নারী। একজন নির্ভীক কলম সৈনিক। যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকতা করে গেছেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর আল বদর বাহিনী তাকে নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করে পাকসেনারা। পরে রাজধানীর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।

সেলিনা পারভীনের জন্ম ফেনীতে, ১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ। তার বাবা আবিদুর রহমান শিক্ষকতা করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে ওঠেন। এসময় থেকেই  গল্প ও কবিতা লেখা শুরু করেন। গ্রামীণ কুসংস্কারের মারপ্যাঁচে তার পড়ালেখার সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ওই বয়সে স্বামীর সাথে থাকার কথা ভাবতে পারেননি। ১০ বছর স্থায়ী হয় সে বিয়ে। পরে তিনি আবার পড়ালেখা শুরু করেন।

১৯৪৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হল পরিচালক হিসেবে চাকরি নেন। পরের বছর কর্তৃপক্ষের সাথে মতের অমিল হওয়ায় তিনি চাকুরি ছেড়ে দেন। পরে তিনি একজন রাজনীতিককে বিয়ে করে তার সাথে সংসার শুরু করেন।

ললনা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করতেন সেলিনা পারভিন। বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, টাকা তোলাসহ সব কাজ একাই করতেন। পত্রিকা অফিস থেকে বেতন হিসাবে অনেক সময় তেমন কিছুই পেতেন না।

ললনায় কাজ করার সময় ১৯৬৯ সালে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বের করেন ‘শিলালিপি’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা। পাঠক মহলে পত্রিকাটি বেশ আলোড়ন তোলে। তিনি নিজেই পত্রিকাটি সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্বে ছিলেন। শিলালিপি ছিল সেলিনার নিজের সন্তানের মত। দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীর লেখা নিয়ে প্রকাশিত হতো শিলালিপি। স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা ছিলো শিলালিপি। এ কারণে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি।

১৯৬৯ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। সেলিনা পারভীন নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের এই আন্দোলনে। একমাত্র ছেলে সুমনকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন। ৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় যোগ দিতেন। কিংবা শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ সভাতেও। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন সেলিনা পারভীন।

এরই মধ্যে চলে আসে ১৯৭১ সাল। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। উত্তাল সারা বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। এ সময় তার বাসায় মাঝে মাঝে রাত হলে কয়েকজন তরুণ আসতেন। এই তরুণরা সকলেই ছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে তারা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন। শিলালিপির কপি বিক্রি করে যে টাকা পেতেন তা দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন।

চারদিকে তখন চলছে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, প্রতিরোধ। চারপাশে শুধু বুলেটের শব্দ আর বারুদের গন্ধ, চিৎকার, গোঙানি, রক্তস্রোত আর মৃত্যু। এরই মাঝে ললনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শিলালিপির উপরও নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর খড়গ। হাশেম খানের প্রচ্ছদ করা শিলালিপির প্রকাশিতব্য একটি সংখ্যা নিষিদ্ধ করে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরে প্রকাশের অনুমতি মিললেও নতুনভাবে সাজানোর শর্ত দেয়া হয়। সেলিনা পারভীন বরাবরের মতো প্রচ্ছদ না নিয়ে তার ভাইয়ের ছেলের ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে শিলালিপির সর্বশেষ সংখ্যা বের করেন। কিন্তু এর আগের সংখ্যার জন্যই সেলিনা পারভীন পাকিস্তানী ও তাদের দালালদের নজরে পড়ে যান। শিলালিপির ওই সংখ্যাটি ছিল দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লেখায় ভরপুর। আর তা-ই কাল হলো সাংবাদিক সেলিনার জন্য। শিলালিপির আরেকটি সংখ্যা বের করার আগে নিজেই হারিয়ে গেলেন তিনি।

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। দেশের বেশ কিছু অঞ্চল ইতোমধ্যে মুক্ত হয়ে গেছে। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডে তার বাড়িতে থাকতো তিনজন মানুষ—তার মা, ছেলে সুমন আর ভাই উজির। সেদিন শীতের সকালে তারা সবাই ছিলেন ছাদে। সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সুমন যখন ছাদে খেলাধুলা করছিল তখন সেলিনা পারভীন চেয়ারে বসে একটি নতুন লেখা লিখছিলেন। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ তাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। সেলিনাদের বাড়ির উল্টো দিকে চলচিত্র নির্মাতা খান আতাউর রহমানের বাসার সামনে এসে ইপিআরটিসি’এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামলো। সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু আল বদর কর্মী। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা, মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা।

একসময় সেলিনাদের ফ্ল্যাটে এসে কড়া নাড়ে তারা। সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু সময় ধরে কথা হয়। এরপর তারা সেলিনা পারভীনকে তাদের সাথে নিয়ে যায়। শিশু ছেলেকে রেখে সেই যে গেলেন তিনি, প্রাণ নিয়ে আর ফিরে আসেননি কোনো দিন।

তাকে মোহাম্মাদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় ৩০ জনকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত একটি ঘরে বন্দি করে রেখেছিল ঘাতকরা। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন, শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ আরও অনেকে। সেখানে একমাত্র নারী বন্দি ছিলেন সাংবাদিক সেলিনা পারভীন।

১৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় রায়েরবাজারের বটতলায়। লম্বা দড়ি দিয়ে ৩০ থেকে ৪০ জনকে সোজা লাইনে দাঁড় করিয়ে হাত বাঁধা হয়। পরিণতি বুঝতে পেরে সেলিনা পারভীন চিৎকার শুরু করেন। ঘাতকরা তখন তার মুখে বেয়ানেট চার্জ করে মুখ চিড়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তার আর্তনাদ আর গোঙানির শব্দ শোনা যায়। ঘাতকরা তখন তার বুকেও বেয়ানট চার্জ করে। পরে তাকে গুলি করা হলে তিনি প্রাণ হারান। ১৪ ডিসেম্বর আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে সেলিনা পারভীনকেও হত্যা করে পাকিস্তানের দালাল আলবদর বাহিনীর ঘৃণিত নরপশুরা।

এ ঘটনার মাত্র তিন দিন পর ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। গুলি আর বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত ছিলো সেই দেহ। খুব শীতকাতুরে ছিলেন সেলিনা। তার পায়ে তখনও পড়া ছিল সাদা মোজা। এটি দেখেই তাকে সনাক্ত করেন স্বজনরা।

১৮ ডিসেম্বরেই তাকে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়। নির্ভিক সাংবাদিক সেলিনা পারভীন শুয়ে আছেন আজিমপুর কবরস্থানে। তিনি ঘুমাননি। পাহারা দিচ্ছেন দেশকে। তিনি জেগে আছেন। তিনি কখনও ঘুমান না। কারণ শহীদরা জেগে থাকে, শহীদরা ঘুমায় না।