ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১৯:৫২:৫৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁতীরা রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম ঈদযাত্রা: ৮ এপ্রিলের ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে আজ বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া

সুকুমার রায় আর কমন সেন্সের প্যারোডি

শ্রেয়ণ | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৪:২৮ পিএম, ১ আগস্ট ২০১৯ বৃহস্পতিবার

সে অনেক অনেক ছোটোবেলার কথা। নিজের জীবনে কখন থেকে সুকুমার রায়ের সঙ্গে পরিচিত হলাম, সেটা খুঁজতে গেলেই সেই দিনগুলোকে মনে পড়ে। বিশেষ করে মনে পড়ে সেই দুপুরগুলোকে। তখনও আমার স্কুলে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি। মা দুপুরবেলা খাওয়ার পর আমাকে বিছানায় শুইয়ে ঘুম পাড়াতেন। বয়সের স্বভাবে ঘুমোনোর কোনো ইচ্ছেই তখন আমার হত না, বরং সুযোগ খুঁজতাম কীভাবে খাট থেকে নেমে দুষ্টুমি করা যায়। মা তখন আমাকে সামলানোর জন্য বেশ অভিনব একটা উপায় বার করেছিলেন। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ বই থেকে ‘ভয় পেও না’-র পাতাটা খুলে আমার পায়ের দিকে খাটের শেষ প্রান্তে রেখে দিতেন, আর আমাকে বলতেন, চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো, নইলে ‘ভয় পেও না’ এসে তোমাকে ধরবে। ছড়াতে ওই অদ্ভুত দেখতে প্রাণীটার আদপে কোনো নামই নেই, কিন্তু আমার কাছে তখন ছড়ার নামেই প্রাণীটার নাম হয়ে গিয়েছিল। এবং সেই অজানা প্রাণীর বারণ উপেক্ষা করে ছবিটা দেখেই আমি ভয়ে চোখ বুজে থাকতাম। ওই বয়সটাই তো এরকম। যেটা করতে বারণ করা হয়, সেটাই ওই বয়সের ছেলেমেয়েরা বেশি বেশি করতে থাকে। আমার ভয় পাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই সেই মনস্তত্ত্ব কাজ করত। ‘ভয় পেও না’ কথাটাই আমার মনের ভেতরে জাগিয়ে তুলত খুউব খুউব ভয়। এখন অবশই ওই ছবিটা দেখলে ভীষণই হাসি পায়, ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে বলেই।

এর বেশি সুকুমার রায় সম্পর্কে ছোটোবেলার কোনো স্মৃতি আমার মনে নেই। ভাবতে অবাক লাগে, যিনি বাংলার এক প্রধান শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিত, এবং হাস্যরসের কারিগর হিসেবে বিখ্যাত, আমার শিশু বয়েসে তাঁর স্মৃতি বলতে হাসি তো নেই-ই, কেবলই ভয়। তখনও তো বুঝিনি, ছোটোবেলার ভয় পাওয়ানোর সুকুমার বড়ো হয়ে আমাকে ভাবাবেন? হ্যাঁ, আমি সুকুমার রায়ের ফ্যান হয়েছি বড়োবেলায় এসে, যখন তাঁর লেখাগুলোকে রাজনৈতিকভাবে পাঠ করতে শিখলাম, যখন দেখলাম সমাজের বিভিন্ন স্টিরিওটাইপ প্রবণতাগুলো রূপক হয়ে তাঁর লেখাতে ফুটে উঠেছে। এই শেখাটার জন্য আমি অবশ্য ঋণী আমার বাবার কাছে। নানা প্রসঙ্গে ‘খুড়োর কল’ কথাটা তিনি প্রায়ই ব্যবহার করতেন। তিনিই আমাকে প্রথম বুঝিয়েছিলেন ‘একুশে আইন’ ছড়াটার মধ্যে কীভাবে স্বৈরাচারকে ব্যাঙ্গ করেছেন সুকুমার। ‘ভয় পেও না’ ছড়াটার কথাই ধরা যাক।  যে কোনো শাসনব্যবস্থা আমাদের কাছে দাবি করে আনুগত্য।  আর সেই দাবি কিন্তু দু’মুখো। একদিকে থাকে ভয়ের উপাদান, থাকে শাস্তি, থাকে নির্যাতনের হুমকি। আরেকদিকে থাকে নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার, থাকে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। যতক্ষণ তুমি সিস্টেমের অনুগত, ততক্ষণ সিস্টেম তোমাকে অভয় দেবে, আর যেই তুমি খানিক গড়বড় করবে, সিস্টেমের দাঁত-নখ বেরোবে তখনই। ভয় আর অভয়ের এই যে খেলা, তার ভারসাম্যটা ভেঙে গেলে কী হয়, তার উদাহরণ আছে আরেকটা ছড়ায় –


চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক্ ওদিক্ ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুরে রোদে ঘামিয়ে তায়-
একুশ হাতা জল গেলায়।। (‘একুশে আইন’)

বোঝাই যাচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষিতেই এটা লেখা হয়েছিল এই ছড়াটা। আরেকটা ব্যাপারও লক্ষ করার মতো, যখন সুকুমার রায় ‘আবোল তাবোল’-এর ছড়াগুলো লিখছেন, যার মধ্যে এই লেখাটিও আছে, তখন ইউরোপে গুটি গুটি পায়ে এক নতুন রাজনৈতিক মতবাদ নিজের জমি শক্ত করছে। সেই দর্শনের নাম ‘ফ্যাসিবাদ’। এই ছড়াটির কোথাও তার কি ইঙ্গিত নেই? আর এখনকার সময়ে তার লেখাগুলো কি নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে না? বাংলার সুকুমার রায় এখন পথ দেখাতে পারেন গোটা ভারতকে, এমনকি গোটা বিশ্বকেও। ননসেন্স ভার্স আসলে তো শুধুমাত্র ননসেন্স নয়, শুধুমাত্র অর্থহীন কিছু শব্দসমাহার নয়। ননসেন্স ভার্স আসলে সেন্সের এক ধরনের প্যারোডি। আরও স্পষ্ট করে বললে মানুষের যে কমন সেন্স, তার প্যারোডি এই ননসেন্স ভার্স। যদিও এই সাহিত্যরীতির জন্ম ইউরোপে, তা সত্ত্বেও সুকুমার যখন ননসেন্স ভার্স লেখেন, সেগুলোর মধ্যে বাঙলিত্ব খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না। সুকুমার নিজেই তো একজন আন্তর্জাতিক প্রাচ্যবাসী।

সুকুমার রায়কে আসলে নানাভাবে পাঠ করা যায়, নানা বয়সে, নানা সময়কালে। যেন ল্যাবরেটারিতে গবেষণার জন্য রাখা ব্যাঙ কিংবা আরশোলা। বাইরে থেকে যেন একটা মজার প্রাণী, যাকে নিয়ে বাচ্চারা খেলতে পারে, কিন্তু তার চামড়া খুলে ভেতরে চোখ লাগালেই বাইরের দৃশ্যের সঙ্গে কোনো মিলই নেই, তার বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে গেলে শরণ নিতে হবে জীববিজ্ঞানের খটোমটো জ্ঞানের। সুকুমারের লেখাগুলোতে বাইরে থেকে এক রকমের মজা, ভেতরে আরেক রকমের গভীরতা। ‘বাবুরাম সাপুড়ে’-র থেকে যে রকমের সাপ চায় তার ক্রেতা, আমরাও কি ঠিক অধস্তন কাজের ক্ষেত্রে একই রকম মানুষের সন্ধান করি না? কিংবা রাষ্ট্র? সে কি চায় না তার নাগরিকদের এরকম নিরীহ বানিয়ে রাখতে?

হ য ব র ল’-র যে বিচারপতি চোখ বুজে মামলার কাজ পরিচালনা করেন, আমি তাকে আজও বসতে দেখি এজলাসে। প্রায়ই দেখি অনেক অনেক হাঁসজারু আর বকচ্ছপ ঘুরে ফিরে কথা বলে বেড়াচ্ছে আমার চারদিকে – শহরে, শহরতলিতে, মফস্‌সলে, গ্রামে সব জায়গায়তেই। সেই তুলনায় খুব কমই চোখে পড়ে হেসোরাম হুঁশিয়ারকে, আর কখনও সখনও দেখি পাগলা দাশু উঁকি মেরে ভ্যানিস হয়ে যায়। তবে সুকুমার রায়ের তৈরি করা এতগুলো চরিত্রের মধ্যে আমি কোনটা, সেটা এখনও ঠাওর করে উঠতে পারিনি। সুকুমার রায়ের দেখা যদি কখনও পাই, তাঁকে জিজ্ঞেস করে নেব। আসলে আমি তো সুকুমার রায়কে খুঁজে চলেছি এই একুশ শতকের পৃথিবীতে। যিনি ‘উলঙ্গ রাজা’-র সেই শিশুটার মতো আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবেন সিস্টেমের দিকে –

“সভায় কেন চেঁচায় রাজা ‘হুক্কা হুয়া’ ব’লে?
মন্ত্রী কেন কল্‌সী বাজায় ব’সে রাজার কোলে?
সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?
কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি?
রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা প’রে?
এমন কেন ঘটছে তা কেউ বলতে পার মোরে?”

(বঙ্গ দর্শন থেকে নেয়া)