ঢাকা, শুক্রবার ০৩, মে ২০২৪ ১৮:৩৮:০২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
জনগণ তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করুক: প্রধানমন্ত্রী সবজির বাজারে স্বস্তি নেই যুদ্ধকে ‘না’ বলতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছি ভারী বর্ষণে মহাসড়কে ধস, চীনে ২৪ প্রাণহানি রাজবাড়ীতে ট্রেন লাইনচ্যুত, রেল যোগাযোগ বন্ধ

হাওরে দিল্লির আখড়া, রহস্যময় হিজল-করস

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:০৪ পিএম, ২২ জুলাই ২০২৩ শনিবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

হাওরে দিল্লির আখড়া শব্দে হয়তো অনেকে ভাবছেন ভারতের কোনো আখড়া কিনা! না, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর জনপদ কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কাঠখাল ইউনিয়নে পৌরাণিক কাহিনী সম্মৃদ্ধ, রহস্যময় হিজল-করস গাছ ও বিস্তৃর্ণ সবুজে ঘেরা ঐতিহাসিক দিল্লির আখড়ার অবস্থান।

লোকালয়ের বাহিরে প্রায় চারশ একক জমিতে কয়েক হাজার হিজল-করস গাছের সবুজে ঘেরা প্রাগৈতিহাসিক আমলের আখড়াটি হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান। এই হিজল-করস গাছ নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে ধর্মীয় ভাব আবেগের বহু কথা। প্রতি বছর ৮ চৈত্র দুদিন ব্যাপী মেলা বসে আখড়া প্রাঙ্গণে। 

প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি হিজল-করস গাছের সবুজে ঘেরা দিল্লির আখড়ার জমির পরিমান ৩৭২ একর। কালনী নদীর তীরবর্তী আখড়ার পুরো জমিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় তিন হাজার হিজল ও শতাধিক করস গাছ। আর সাড়ে ৫বিঘা উচু জমিতে আখড়ার মন্দির, নাটমন্দির, উপাসনালয়, অতিথিশালা ও সেবায়েত বা বৈঞ্চব থাকার ঘর  আর রান্নাঘর। দক্ষিণ পুকুরের পাড়ে ভূমিহীন মানুষদের বসতঘর। পশ্চিম পুকুরে জোড়া পাকা ঘাটসহ আরো একটি পুকুর। আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা সাধক নারায়ণ গোস্বামী ও তার অন্যতম শিষ্য গঙ্গারাম গোস্বামীকে সমাহিত করা হয়েছে আখড়ার মন্দিরে। 


ঐতিহাসিক এই দিল্লির আখড়ার বৈচিত্র্যময় হিজল-করস গাছের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত ভিড় করেন হিন্দু সম্প্রদায় ও ভ্রমণপিপাসু মানুষ।

তিনি জানান, মন্দিরের আদিকথা, সেই ১৬শ শতাব্দীর কোনো এক সময় সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে আখড়া ও মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময়ে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা সাধক নারায়ণ গোস্বামী পার্শ্ববর্তী হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বিতাঙ্গল আখড়ার পুরোহিত সাধক রামকৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে দীক্ষা নিয়ে সেখানে আরাধনা করতেন। পরে তার গুরুদেবের নির্দেশে সাধক নারায়ণ গোস্বামীকে ছন আর ঘাসে ঘেরা নির্জন (আখড়া) হাওরে এসে তপস্যা শুরু করেন।

গুরুদেব রামকৃঞ্চ গোস্বামীকে ছেড়ে হাওরে এসে সাধনা করতে গিয়ে দৈব বাধাপ্রাপ্ত হন। রাতে দানব বা ভূত-প্রেতনিরা নারায়ণ গোস্বামীকে বিরক্ত করতে থাকেন। পরে নারায়ণ গোস্বামী তার দীক্ষাগুরু রামকৃষ্ণ গোস্বামীর আর্শিবাদ ও মন্ত্রবলে সব দানব বা অপদেবতাকে হিজল-করস গাছে রুপান্তর করেন। আখড়া নিয়ে   রয়েছে বহু অলৌকিক জনশ্রুতি। 


সাধনা করতে গিয়ে তিনি বাধার মুখে পড়েন। একদিন দৈবশব্দে সাধক নারায়ণ গোস্বামী কে বলা হয় আপনি কে? দীর্ঘদিন ধরে বাস করে আসছি এই স্থানে, আপনার জন্য এখন শান্তিতে বাস করতে পারছি না। সাধক তাদের (দানব) প্রকাশ্যে আসা ও স্থান ত্যাগ করার কথা বলেন। তারা প্রকাশ্যে আসেন এবং স্থান ত্যাগে আপত্তি করেন। তাই নদীতে মানুষের নিরাপদ যাতায়াত ও মানব কল্যাণে সব দানবকে মন্ত্রবলে হিজল গাছে রুপান্তর করেন।


কয়েক শত বছরের পুরোনো অদ্ভুত ধরনের হাজারো হিজল গাছ ভ্রমণপিপাসুদের আর্কষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি গাছের উচ্চতা ৭ থেকে ১০ ফুটের বেশি না। অনেক গাছের ভেতরে খোলা জায়গায় নির্বিগ্নে মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারেন। তবে, সব গাছগুলোর বয়স সাড়ে চারশ বছর বলে জানান, পুরোহিত নারায়ণ দাস মোহন্ত গোস্বামী।


আখড়া সংলগ্ন অষ্টগ্রাম উপজেলার কদমচাল গ্রামের পল্লী চিকিৎসক ইদ্রিস আলী জানান, বংশ পরম্পরায় হিজল গাছ একই আকারে দেখে আসছেন তাদের আগের পুরুষরা। গত ১৬ বছরে বহুগাছ মরে গেছে। আখড়ার সৌন্দর্য বাড়াতে সরকারি সহায়তা চান তিনি।


দিল্লির আখড়া নামকরণের বিষয়ে জানা যায়, সাধক নারায়ণ গোস্বামীর তপস্যাকালে তৎকালীন মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলার খাজনা আদায়ের জন্য আখড়া সংলগ্ন কালনী নদী দিয়ে প্রায়ই যাতায়ত করত সম্রাটের নৌকাসহ লোকজন। 

১৬০৫ সালের পর কোনো একসময় বিশাল এই জঙ্গলে মানুষের শব্দ শুনে সম্রাটের লোকজন গিয়ে দেখেন, ঝোপের মাঝে এক সাধক প্রার্থনা করছেন। তারা সাধকের কয়েকটি স্বর্ণ মুদ্রা নিয়ে ফেরার পথেই শুনতে পান পানিতে চলাৎ চলাৎ করে শব্দ। তারা বুঝতে পারেন স্বর্ণমুদ্রাগুলো পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। রাগে তারা, সাধককে মুদ্রাটি ফেরত চাইলেন, সাধক শান্তভাবে পানিতে ভাসমান অগনিত স্বর্ণমুদ্রা দেখিয়ে বলেন, তোমাদের মুদ্রা চিনে নিয়ে যাও! সাধকের এমন অলৌকিক আচরণে হতভম্ব হয়ে পড়েন তারা।

সম্রাট জাহাঙ্গীর সাধকের নির্লোভ ও অলৌকিক আচরণে মুগ্ধ হন। এবং ৩৭২ একর জমি দানের একটি তাম্রলিপি সাধকের কাছে পাঠানো হয়। যদিও পরে তাম্রলিপিটি ডাকাতরা নিয়ে যায়। যেহেতু দিল্লির সম্রাট জমি দান করেছেন তাই এই আখড়ার নামকরণ হয় ‘দিল্লির আখড়া’।

প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় দিল্লির আখড়া নিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে পৌরাণিক বহু প্রথা চালু রয়েছে। এখানের পুরোহিত ও বৈঞ্চব বা মন্তরা সাধারণত চিরকুমার হয়। মা-বাবা সন্তানের মঙ্গলের জন্য আখড়ায় মান্সা বা মান্নত করা, ছেলেরা চিরকুমার থেকে আখড়ায় বৈঞ্চব মতবাদ পালন করবেন। পরে ঈশ্বর প্রার্থনায় ধীরে ধীরে মন্ত বা প্রধান বৈঞ্চব বা গোস্বামী পদালংকৃত করেন। গোস্বামীর নির্দেশে আখড়ায় সব পূজা পার্বণ পরিচালিত হয়।

যেভাবে যাবেন দিল্লির আখড়া:

হাওরে দিল্লির আখড়া দেখতে ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে আসতে হবে কিশোরগঞ্জ। এরপর করিমগঞ্জ চামড়া ঘাট হতে লঞ্চ বা ট্রলারে মিঠামইন পরে আবার ট্রলারে দিল্লির আখড়া। অথবা কুলিয়ারচর, বাজিতপুর হতে লঞ্চ, স্প্রীডবোট ও ট্রলারে অষ্টগ্রাম, রিজার্ভ ট্রলারে দিল্লির আখড়া। অন্যদিকে, হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচং হয়েও আসা যায়। তবে ওখানে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফিরে এসে, উপজেলা সদরে থাকবে হবে।