ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:০৫:৪৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
খালেদা জিয়ার অবস্থা এখনও উদ্বেগজনক আরও পেছাল খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা খালেদা জিয়ার এন্ডোসকপি সম্পন্ন, থামানো গেছে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ আগারগাঁওয়ে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ, নারীসহ দগ্ধ ৬ প্রবাসীদের নিবন্ধন ছাড়াল এক লাখ ৯৩ হাজার

১৬/এ আহিরিপুকুর ফার্স্ট লেন : শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০৯:১০ পিএম, ১০ জুন ২০১৮ রবিবার

দেশবিভাগ নিয়ে কার কী মতামত আমি জানি না। তবে আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে ১৯৪৭ সালে বাঙালির বুকের ভিতর ছুরি চালিয়ে তার হৃদয়কে দুই ভাগ করে তৈরি হয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ। একই আকাশ, একই বাতাস, একই প্রকৃতি একই ভাষা তারপরও আমাদের সীমান্তে সর্বদা জেগে থাকে কাঁটাতার। রাজনৈতিকভাবে অনেকের ভিন্ন মত থাকতে পারে। সেটা আমি সহনশীলতার সঙ্গে মেনে নিয়েও একান্ত আমার ব্যক্তিগত কথাগুলো বলছি।

 

এবার কলকাতায় গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য। তাই ঘোরাঘুরি সম্ভব হয়নি। তারপরও দুয়েকটি জায়গায় গিয়েছি এরই ফাঁকে। এর মধ্যে একটি জায়গায় গিয়ে আমার চোখে সত্যিই জল এসে পড়েছিল। সেটি হলো ১৬/এ আহিরি পুকুর ফার্স্ট লেন। এই বাড়িটি ছিল আমার নানা খান বাহাদুর আফাজউদ্দীন আহমেদের বড় সাধের বাড়ি। তিনি এটি কিনেছিলেন এক জমিদারের কাছ থেকে। এসবই আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। আমার মায়ের শৈশব কেটেছে এ বাড়িতে।

 

আমি ছোটবেলা থেকে এই বাড়ির গল্প শুনে এসেছি। এমনকি অনেক ভুতুড়ে গল্পও। সন্ধ্যেবেলায় এ বাড়ির নারিকেল গাছ বেয়ে কেমন করে জলিল নামে একজন কাজের লোক উঠেছিলেন, পরে জানা যায় সেটি ছিল কোনো প্রেতাত্মা। এমনি কতশত গল্প শুনেছি মায়ের কাছ থেকে। শৈশবের রঙিন কাঁচে দেখা পৃথিবীর গল্প। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর এই বাড়ি হাত বদল হয়। মা যখন ওই বাড়ি থেকে চলে আসেন তখনও বুঝতে পারেননি আর কখনও ফিরতে পারবেন না। মনে করেছিলেন ঢাকায় বেড়াতে যাচ্ছেন। তাই এক বাক্স চীনেমাটির পুতুল লুকিয়ে রেখে এসেছিলেন চিলেকোঠায়। ১৯৪৭ এর পর ৭১ বছর পার হয়েছে।

 


কতবারই তো কলকাতায় যাওয়া হযেছে। তবে এই বাড়িতে কখনও ফেরা হয়নি। এবার কলকাতায় যাবার আগে আমার মামাতো বোন চৈতি জিজ্ঞেস করলো ফুপুর কি মনে আছে তাদের বাড়ির ঠিকানা? আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম। যে মা আমার প্রতি মুহূর্তের কথা ভুলে যান, যিনি বুঝতে পারেন না স্বামীর মৃত্যু, বোনেদের মৃত্যুর কথা তিনি প্রশ্ন শুনে আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর তার ঘোলাটে চোখে একটা দীপ্তি দেখলাম। তিনি কোন দ্বিধা না করে বললেন, ১৬/এ আহিরি পুকুর ফার্স্ট লেন, বেকবাগান, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সঙ্গে।

 


১৯৪৭ সালে চলে আসার ৭১ বছর পর আফাজউদ্দীন আহমেদের উত্তরসূরী দুই মেয়ে পা রাখলো সেই বাড়িতে। আমি দৌহিত্রী, চৈতী পৌত্রী। অবাককরা বিষয় হলো ৭১ বছর ধরে বাড়িটি টিকে আছে। যদিও এখন নিতান্তই ভগ্নদশা। যেই জীর্ণ শীর্ণ বাড়িটি যেন আমাদের শোনাতে চায় তার যৌবনের গল্প। সেই আমলের কয়েকটি আসবাবও রয়েছে। বাড়িতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের দেখা পেলাম। তিনি খান বাহাদুর সাহেবকে দেখেছিলেন। সে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের নাম শেখ মোস্তফা। (আমার মামার নামও কিন্তু ছিল মোস্তফা। আবু তাহের সালাহউদ্দীন আহমেদ মোস্তফা, যার জন্ম হয়েছিল আহিরিপুকুরের এই বাড়িতেই।)

 


মায়ের মুখে শুনেছিলাম এই বাড়ির গাছগুলো ছিল নানার বড় আদরের। তিনি গাছপালা ভালোবাসতেন। নারিকেল গাছটির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছিল যেন সেই গল্পগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।ঢাকায় ফিরে কাল মাকে ছবিগুলো দেখালাম। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। চিনতেও পারলেন। দেখি তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। বললেন, আব্বা-আম্মা-ভাই-বোনদের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে রে। ছোটাপা, সোনাপা, শিরিআপা, বড়দি, মেজদি, মোস্তফা কেউ আর নেই না? আমাকে একবার ওই বাড়িতে নিয়ে যাবি?

 


তারপর চোখ মুছে বললেন, আমাদের দেশ, আমাদের ঘর ওই ব্রিটিশরা কেন ভাগ করে দিয়ে গেল রে? হায় এই সরল মানুষের সরল প্রশ্নের উত্তর দেবার সাধ্য কি আছে?

 


আমার মনে পড়লো সেই বিখ্যাত লেখা, ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে..’।

 

৥ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক