ঢাকা, বুধবার ০৯, অক্টোবর ২০২৪ ২:৫১:৪৭ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন জন হোপফিল্ড ও জিওফ্রে হিন্টন সেই তাপসী তাবাসসুমের বিরুদ্ধে এবার মামলা শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু বুধবার চিকিৎসায় নোবেল পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই বিজ্ঞানী নেত্রকোণায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, শেরপুরে নিহত বেড়ে ৯ কোথায় আছেন শেখ হাসিনা, জানালেন জয়

গৃহশ্রমিক মেয়েদের দিন কষ্টে কাটে

আইরীন নিয়াজী মান্না | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:২৪ এএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সোমবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

গৃহকর্মী শিশু নির্যাতনের নানা খবর প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমে আসে। নির্মমভাবে অত্যাচার থেকে শুরু করে হত্যা পর্যন্ত করা হয় তাদের। সমাজের উন্নত স্তরের মানুষ দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হয় এসব কোমলমতি শিশুরা। জীবনের প্রয়োজনে অন্যের ঘরে কাজ করতে এসে লাশ হয়ে ফিরতে হয় মায়ের কোলে। গৃহশ্রমিক শিশুদের যখন এমন নাজুক অবস্থা ঠিক তখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস। কেমন আছে রাজধানী ঢাকার গৃহশ্রমিক কন্যা শিশুরা!

আসলে রাজধানীর গৃহশ্রমিক কন্যারা ভালো নেই। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর লোকাল গভর্নমেন্ট রাজধানী ঢাকার ৩ লাখ ১৫ হাজার বাড়ির উপর একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, ৪৪ শতাংশ পরিবারেই সার্বক্ষণিক গৃহভৃত্য রয়েছে এবং ২৯ শতাংশ পরিবারের আছে খন্ডকালীন। জরিপ বলছে, এদের অধিকাংশই মেয়ে শিশু।

গবেষক পি. স্টকার প্রণীত ‘চাইল্ড লেবার ইন বাংলাদেশ: এ সামারি অব রিসেন্ট ইনভেস্টিকশনস’ শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের গৃহভৃত্যের আনুমানিক সংখ্যা ২ লাখ থেকে ১০ লাখ।

বিভিন্ন কেস স্টাডি বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এসব গৃহভৃত্যরা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত একটানা কাজ করে। অধিকাংশ সময়ই তারা গৃহকর্ত্রী কর্তৃক নির্যাতিত হয়। মালিক পরিবারের কর্তা বা পুরুষ সদস্য কর্তৃক যৌন নিপীড়ণ মেয়ে গৃহভৃত্যদের ক্ষেত্রে যেন একটি অতি সাধারণ বিষয়। এই গৃহভৃত্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুত মাইনে থেকে বঞ্চিত হয়।

বিশিষ্ট গবেষক তেরেস ব্লঁশের ‘লস্ট ইনোসেন্স, স্টোলেন চাইল্ডহুড’ শীর্ষক গবেষণামূলক বইয়ে উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। ব্লঁশে তার গবেষণার উল্লেখ করেছেন, রাজধানীর শিশু গৃহভৃত্যরা নিঃসন্দেহে শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়িত শ্রেণীর অন্যতম। তার গবেষণার সার্বিক নমুনায় দেখা গেছে মেয়েদের অর্ধেক এবং ছেলেদের এক তৃতীয়াংশ গৃহভৃত্য শিশু তাদের গৃহকর্তাদের দ্বারা শারীরিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। তাদের চড়-চাপড় মারা হয়, বাঁশের কঞ্চির বা লোহার রড দিয়ে পেটানো হয়। এ সব শিশুরা মনে করে তারা যেটুকু ‘ভুল’করে তার চেয়ে অনেক বেশি শাস্তি দেয়া হয় তাদের।

ঢাকা শহরের ৭৯টি এলাকায় পরিচালিত ব্লঁশের জরিপ বলছে, ১৮টির এলাকার মেয়ে শিশু গৃহশ্রমিকরা (২৫.৩৫ শতাংশ) যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ১৮টির মধ্যে ৯.৮৫ শতাংশ স্বীকার করেছে, তারা তাদের মনিবের বাড়িতে পুরোপুরি ধর্ষিতা হয়েছে। এইসব মেয়েশিশুর গড় বয়স ১১ বছর। মোট ৭১টি মেয়ে ও ৭টি ছেলের উপর পরিচালিত ব্লঁশের জরিপে দেখা গেছে, তাদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশের কোনো নির্ধারিত বেতন নেই। যাদের বেতন দেয়া হয়, তারা প্রতিমাসে গড়ে ১৪৫ টাকা পাচ্ছে।

তেরেস ব্লঁশে ‘লস্ট ইনোসেন্স, স্টোলেন চাইল্ডহুড’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে ঢাকা শহরের শিশু গৃহভৃত্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এক জায়গায় বর্ণনা করেছেন, ’তারা রান্না ঘরে কিংবা থাকার ঘরের মেঝেতে ঘুমায়। তাদের জন্য আলাদা কোনো জায়গা নেই। তাদের খাবার, থালা বাসনও নিম্নমানের। খাবার তারা মেঝেতে বসেই খায়। মালিকের পরিবারের মতো তারা চেয়ার টেবিলে বসে খেতে পারে না। অন্য সকলের খাওয়ার পর তারা খায়। নিজের খাবার নিজে নিয়ে খেতে পারে না। গৃহভৃত্য একটি শিশু হওয়া সত্ত্বেও তার নিম্নমর্যাদার কারণে এসব সামাজিক রীতির পরিবর্তন ঘটছে না।’

ব্লঁশের গবেষণার আশিটি কেস স্টাডির মধ্যে মাত্র ২টি ঘটনায় দেখা গেছে শিশুরা নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গৃহভৃত্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে। অধিকাংশ শিশুই এক্ষেত্রে অভিভাবকের ইচ্ছায় কাজে আসে। ঢাকার নাগরিক সমাজে শিশুদের গৃহস্থকর্মকে সাধারণত সাহায্য দেয়া বা ছোট কাজ ‘ফুটফরমাশ’ বলে অভিহিত করা হয়।

সেভ দ্য চিল্ড্রেন ফান্ড (যুক্তরাজ) এর আর্থিক সহায়তায়, শৈশব বাংলাদেশ এর ডঃ মুনিরুল ইসলাম এবং অন্যান্য গবেষক কর্তৃক পরিচালিত ‘দ্যা কোয়ান্টিটিভ স্টাডি অন চাইল্ড ডমোস্টিক ওয়ার্কাস ইন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসায় কর্মরত গৃহভৃত্যদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগই শিশু। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য ও বিভিন্ন প্রবণতা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা অনুমান করেন, ঢাকা শহরে প্রায় ৩,০০,০০০ শিশু গৃহভৃত্য রয়েছে। এর মধ্যে ২,২৫,০০০ মেয়ে শিশু।

এই গবেষণায় দেখা যায় বড় ব্যবসায়ীদের পরিবারেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিশু গৃহভৃত্য রয়েছে। এরপরেই রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি চাকুবীজী পরিবারে। তুলনামূলকভাবে যৌথ পরিবারের চেয়ে ছোট ও একক পরিবারগুলোতে বেশি সংখ্যক শিশু গৃহভৃত্য কাজ করছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার শহরের শিশু গৃহভৃত্যদের ৮০ ভাগই সারা দেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগত। কয়েক বছরেও এইসব শিশু তাদের আত্মীয় স্বজনের দেখা পায় না।

অন্যদিকে সেভ দ্য চিলন্ডেন ফান্ড (অস্ট্রেলিয়া) ও এন্টি-স্ল্যাভারি ইন্টারন্যাশনাল, লন্ডন কর্তৃক পরিচালিত ‘চাইল্ড ডমোস্টিক ওয়ারকিং ইন ঢাকা: অ্য স্টাডি অব এক্সপ্লটেটিভ সিচুয়েশন’ গবেষণায় ব্যাপকহারে শিশু গৃহভৃত্য রাখার প্রধান তিনটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। এক. গৃহভৃত্য হিসেবে শিশুরা অনুগত। দুই. গৃহভৃত্য শিশুরা কঠোর পরিশ্রমী। তিন, শিশুদের গৃহভৃত্য হিসেবে খুব সহজে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা যায়।

শিশু গৃহভৃত্যদের অস্তিত্ব রক্ষা করে বেচে থাকাই যেখানে কষ্টকর সেখানে তাদের অন্যান্য মৌলিক অধিকারের মতো বিষয় নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই। উপরোক্ত গবেষণায় দেখা যায় শিশু গৃহভৃত্যদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৩ ভাগ মেয়ে শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতন। মেয়েদের তুলনায় তিনগুন বেশি অনুপাতের অর্থাৎ শতকরা ৯ ভাগ ছেলে শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতন। অন্যদিকে শিশু গৃহভৃত্যদের মধ্যে শতকরা ৯৭ ভাগ মেয়ে ও ৯১ ভাগ ছেলে তাদের আইন সঙ্গত অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞ।

যদিও অধিকারংশ গৃহভৃত্য শিশু তাদের অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ তবুও তাদের অনেকেরই সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি করার নানা রকম ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা আছে এমন গৃহভৃত্য মেয়ে শিশুদের মধ্যে শতকরা ১২ ভাগই শিক্ষা গ্রহণকে প্রাধান্য দেয়। 

অন্যদিকে গৃহভৃত্য ছেলে শিশুদের মধ্যে শতকরা ৪৯ ভাগই ভবিষ্যতে অফিস পিয়ন, নাইটগার্ড ইত্যাদি পেশা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে বিপুল সংখ্যক গৃহভৃত্য শিশু অর্থাৎ শতকরা ৪৭ ভাগ মেয়ে এবং ছেলের মধ্যে শতকারা ২১ ভাগ ছেলেরই কোনো ধরনের ভবিষ্যও পরিকল্পনা নেই।