ঢাকা, বুধবার ১৮, জুন ২০২৫ ২০:১৫:৫২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সন্ধ্যায় হাসপাতালে যাবেন খালেদা জিয়া উপকূলে চলছে ভারী বর্ষণ, জনজীবন স্থবির বাসের ধাক্কায় মা-ছেলেসহ সিএনজির তিন যাত্রী নিহত ৬০ কিমি বেগে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টির আভাস এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় বাড়লো

ছোটদের গল্প: উ ন চা: আইরীন নিয়াজী মান্না

আইরীন নিয়াজী মান্না | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:০৩ পিএম, ৫ জুন ২০২৫ বৃহস্পতিবার

ছোটদের গল্প: উ ন চা: আইরীন নিয়াজী মান্না

ছোটদের গল্প: উ ন চা: আইরীন নিয়াজী মান্না

অফিসের কাজে কয়েক দিন হলো মাধবপুরে এসেছি। নির্জন পাহাড়ী এলাকা। তিন মাস থাকতে হবে। টিলার উপরে বিশাল একটি বাংলোবাড়ি। আমি একা। সাথে আছে রাধুনী, মালি, আরদালীসহ আরও দুয়েকজন। বাড়ির পেছন দিকটায় বিস্তৃত ঘন বন। জায়গাটা আমার পরিচিত নয়, আগে আমি কখনো আসিনি। তবে বেশ আকর্ষণীয় জায়গা। গাছ-গাছালিতে ভরা চারপাশ। অচেনা পাখির ডাক আর সবুজের সমারহ মনে আনন্দ দেয়। সেই ভোর থেকে দোয়েল পাখি মনের সুখে প্রভাত সংগিত গাইতে শুরু করে। আকাশ কালো করে চোখের সামনে দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় সবুজ টিয়া। সাদা বকেরা সাড়িবদ্ধ হয়ে উড়ে চলে ভোরের বাতাস কেটে কেটে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। 

বাংলোর লনে বিশাল বিশাল আম, কাঠাল, জাম, জামরুলসহ নানা রকম গাছ নজরে পড়ে। ঠিক গেটের পাশের আম গাছটার নিচু ডালে প্রতি দিন ভোরে এক জোড়া হলদে পাখি এসে বসে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি ওদের। ওরা অনেকক্ষণ ধরে ডালে ডালে ঘুরে ঘুরে খেলা করে, পোকা খুঁজে খুঁজে খায়। আর কর্কশ শব্দে দুজনে কি যে বলে! ওদের ভাষা আমি বুঝি না। খেলাধুলা শেষ হলে এক সময় উড়ে চলে যায় পুবের আকাশ দিয়ে। বারান্দার সামনে ঝাঁকড়া হয়ে লাল টালির ছাদে উঠে গেছে একটি বাগান বিলাসের ঝার। তার ডালে চঞ্চল চলাচলা টুনটুনিদের। কী অস্থির ক্ষুদ্র পাখিগুলো। আসে, ডালে ডালে ঘুরে বেড়ায় অস্থির ভঙিতে। তারপর ফুড়–ৎ করে উড়ে যায়। 

এখানে শহুরে কোলাহল নেই, মানুষের চেঁচামেচি নেই। নির্জন-নিরিবিলি সব। নির্জন সকালে কিংবা নিশ্চুপ দুপুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে পাহাড়-গাছ-আর মেঘ পেড়িয়ে দৃষ্টি ছুটে যায় অনেক দূরে দিগন্তের শেষপ্রান্তে।

খুব ভোরে পাখিদের কলকাকলি ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। শেষ রাত থেকে যখন সূর্যটা মাত্র উঠি উঠি করতে শুরু করে তখন থেকেই পাখিদের কিচিরমিচির কানে আসে। এপাশ ওপাশ করে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে যাই। বারান্দায় এসে বসি, চারদিক দেখি, ঘুমভাঙা ভোর দেখি। অনেকটা সময় কেটে যায়। ওপাশে রান্নাঘরে টুংটাং শব্দে ততক্ষণে রাধুনী অরুণার মায়ের কাজ শুরু হয়ে যায়। 

এমনি করে সকাল কাটে। বিকেলে গেট পেড়িয়ে আশেপাশে হাঁটতে যাই। কখনো সাথে থাকে অরুণার মা। আবার কখনো সাথে যায় আরদালি মলয়। ওরাই আমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যায়। 

আমার অফিসটা এখান থেকে দশ মিনিটের পথ। চলাচলের জন্য আমাকে একটা জিপ দেওয়া হয়েছে। সকালে নাস্তা সেরে অফিসে যাই। কাজ শেষে বেলা তিনটা-সাড়ে তিনটা নাগাদ আবারও ঘরে ফেরার পালা। পথে যেতে যেতে কত কিছু দেখি, কত কী যে চিনি। ড্রাইভার অতীন সব চিনিয়ে দেয়, জানিয়ে দেয়। যত অফিসের দিকে আগাতে থাকি ততই লোকের দেখা মেলে। এদিকে কিছুটা লোক সমাগম আছে। অফিস-থানা-হাসপাতাল-বাজার এদিকটাতেই আছে যা কিছু। 

সাত-আট দিন হয়ে গেছে এখানে এসেছি। একদিন অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। অরুণার মা চা দিয়ে গেছে। রান্নাঘরটা বারান্দা থেকে লনটা পেড়িয়ে ঠিক সরাসরি। তাকিয়ে দেখি রান্নাঘরের দাওয়ায় একটি ছোট্ট মেয়ে বসে আছে। বয়স অনুমানিক নয়-দশ। লালচে সুন্দর চুলে মাথা ভরা। চোখগুলো ডাগর ডাগর। টুকটুকে সাদা গায়ের রঙ। দেখলেই মায়া লাগে। আমি ভাবলাম ও বুঝি অরুণার বোন। আরও দুয়েকদিন মেয়েটাকে একই ভঙিতে বসে থাকতে দেখলাম। 

এ ক’দিন অফিসে কাজের বেশ তাড়া আমার। বাড়ি ফিরতেও দেরি হয়ে যায়। সকালে লন পেড়িয়ে ধীর গতিতে আমার গাড়িটা যখন গেটের দিকে চলে যায় তখন কখনো কখনো মেয়েটাকে দেখি রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে থাকে। গাড়ির শব্দে কখনো আনতো নয়নে তাকায়। তখন হঠাৎ কখনো আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। ও কখনো বাংলোর দিকে আসে না। মনে হয় কথাবার্তা বা কাজ শেষ করে চলে যায় বাড়িতে। অরুণার মাকে ওর কথা জিজ্ঞাসা করবো ভাবি। কিন্তু মনে থাকে না বলে জানতে পারি না ও কে। অরুণার মায়ের সাথে ওকে নিয়ে কোনো কথাও হয়না। 

এরই মধ্যে একদিন অফিস থেকে জ্বর নিয়ে ফিরলাম। প্রচন্ড জ্বরে আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। চোখগুলো জবা ফুলের মত টকটকে লাল হয়ে গেছে। ডাক্তার প্রসেনজিৎ আমাদের অফিসেরই স্টাফ। সে আমাকে ভালো করে দেখে বেশ কিছু ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। বলেছে সন্ধ্যায় বাসায় এসে আবারো দেখে যাবে। অরুণার মা আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ও না থাকলে কি যে হতো এ দফায়। 

জ্বরের ঘোরে কেটে গেলো প্রায় তিন দিন। একদিন সকালে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি সেই ছোট্ট মেয়েটা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে আমার মাথার পাশে। 

আমি ওকে দেখেই চিনে ফেললমা। ঘুম ভাঙা কণ্ঠে বললাম: কি নাম তোমার?

ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। ঠিক এ সময় অরুণার মা সকালের নাস্তা হাতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো: বিবি, ওর নাম উনচা। আমার বোনের মেয়ে। মা-বাবা দুটোতেই মরে গেছে। আমার কাছেই থাকে। আমিই পেলেপুলে বড় করেছি।

কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠলো। আহারে, এতটুকু শিশুটা এতিম। ওর কেউ নেই! উনচার চেহারার মধ্যে আমাদের পরিবারের শিশুগুলোর চেহারা আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

অরুণার মা বললো: এ ক’দিন আপনার জ্বরের কারণে ও আমার সাথেই ছিলো। সারারাত জেগে জেগে আপনাকে পাহারা দিয়েছে। খালি ঘরে আপনি একা থাকবেন বলে ওকে এ ঘরে রেখে আমি রাধতে গেছি।

আমি ¯েœহের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম। জলে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। বাড়িতে রেখে আসা সারা আর মানহার কথা ভেবে মন কেমন কেঁদে উঠলো। 

আমি বিছানা থেকে উঠে বসলাম। উনচাকে কাছে ডাকলাম। মাতৃ¯েœহে আমার হৃদয় ভরে উঠলো। আমি পরম ¯েœহে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

আমি মৃদুকণ্ঠে ওকে প্রশ্ন করলাম: তুমি স্কুলে যাও?

ও মাথা নেড়ে বললো: নাহ্।

অরুণার মা জানালো ক্লাস টু পর্যন্ত ও পাড়ার পাঠশালায় পড়েছে। বেতন দিতে পারে না বলে এখন আর স্কুলে যায় না। 

এ কথা শুনে আমি হতাশ হলাম। উনচার কপালে পরে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে তুলে দিতে দিতে বললাম: তুমি এ কদিন আমার এখানেই থাকবে। ঠিক আছে? আমি সুস্থ হয়ে গেলে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো।

আরো কিছু দিন কেটে গেলো। অফিস করি, কাজ করি, ঘরে ফিরি। এক বিকেলে অফিস থেকে ফিরে দেখি উনচা ওর খালার সাথে সেই রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে আছে। আমাকে দেখে ছুটে আসে। আমরা টুকটাক কথা বলতে বলতে বাংলোতে গিয়ে ঢুকি। উনচা মৃদুভাষি, আর কথাও বলে খুব আস্তে আস্তে। শব্দহীন ওর চলাচল।

আজকাল বাড়িতে যতটা সময় থাকি উনচা আমার সাথেই থাকে। ওর সাথে আমার সময়টা খুব সুন্দর কাটে। ও বন-পাহাড়ের গল্প বলে। গহীন বনের ভেতরে একটি আহত পাখি পেয়েছিলো ওর বন্ধুরা। তারপর ওই পাখিটিকে কিভাবে সবাই মিলে সুস্থ্য করে তুললো, সে গল্প বলতে বলতে ও কেমন আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। আমি তাকিয়ে দেখি ছোট্ট মেয়েটাকে। বড় মায়া হয় ওর জন্য।

প্রায় দিন সন্ধ্যায় আমরা লুডু খেলি। অধিকাংশ সময় উনচা-ই জিতে যায়। আমি হেরে গিয়ে মিথ্যেই অভিমান করি। আর ও খিলখিল করে হেসে ওঠে। আনন্দধ্বনি হয়ে ওর মিষ্টি হাসির শব্দ মিলে যায় বাতাসে। খাবার দেয়ার ছলে অরুণার মা ঘরে ঢুকে ওকে মিথ্যেই শাসিয়ে বলে: দেখ্ উনচা, বিবির কোনো ঝামেলা করিস না যেন।

আমি চাপাকণ্ঠে বলি: আহা! তুমি কেন ওকে বকছো? ও তো খুব লক্ষি, কিচ্ছু করেনি। 

কোনো কোনো সন্ধ্যায় যখন ঝিঁঝির ডাক কালে জ্বালা ধরায়, জানলার পাশের ঝোপে সবুজ আলো জ্বেলে জোনাকীরা উড়ে বেড়ায় তখন আমি মৃদুলয়ে উনচাকে নামতা শেখাই। সুর করে করে অ-আ-ক-খ শেখাই। ও খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। 

সাপ্তাহিক ছুটির দিন রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই আমার ঘরে বসে ভূতের গল্পের আসর। মালি বউ সাধনা তার গল্পের ঝুড়ি খুলে বসে। সাধনার মেয়ে কঙ্কাবতি, ছোট ছেলে পলাশ আর অরুণা নিয়ম করে আসে গল্প শুনতে। গল্প বলতে বলতে সাধনার গলা ওঠা-নামা করে নানা ক্লাইমেক্সে। চারদিকের নিঝঝুমতাকে ছাপিয়ে শুধু সাধনার ফিসফিস শোনা যায়। রাত ন’টাকেই তখন মনে হয় মধ্যরাত। ভূতদের নানা রকম অত্যাচারের কাহিনি শুনতে শুনতে উনচা আমার আরো গা ঘেষে বসে। আমি অভয় দিয়ে শক্ত করে ওর হাত ধরি। ওর ভয় যেন কেটে যায় কিছুটা।

একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি উনচা আমার অপেক্ষায় বারান্দার সিঁড়িতে চুপ করে বসে আছে। আমাকে দেখেই উচ্ছসিত হয়ে উঠলো। এগিয়ে এসে বললো: বিবি, ও পাড়ার টুডু বলেছে ওদের বাড়িতে লাল রক্ত করবী ফুটেছে। তুমি যাবে দেখতে?
আমি বললাম: টুডুদের বাড়ি কত দূর? 
ও বললো: ওই যে সেদিন নদীর পাড়ে বেড়াতে গেলাম না? তার পাশেই।
আমি বললাম: বিকেলে আমরা প্রথমে বাজারে যাবো। কিছু জিনিস কিনতে হবে। তারপর টুডুদের বাড়ি যাবো। ঠিক আছে?

আমি অতীনকে ডেকে বললাম: এখানে ছোটদের জামা-কাপড় কোথায় পাওয়া যায় বলো তো। 
ও বললো: ম্যাডাম, আপনার অফিসের কাছেই বটতলা বাজারে কয়েকটি দোকান আছে। ওখান থেকেই সবাই কেনে। এখানে ওর চেয়ে ভালো দোকান আর নেই ম্যাডাম।

বিকেলে আমরা মানে আমি আর উনচা বেড়িয়ে গেলাম বটতলা বাজারের দিকে। অতীন আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভো ভো শব্দে পাড়া-গাঁ মাতিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে সুরু পথ ধরে। আমরা দুজন কথা বলে চলেছি অবিরাম।

বাজারে গিয়ে নানা দোকানে ঘুরে ঘুরে উনচার জন্য বেশ কয়েকটি জামা কিনলাম। প্রথমে সে নিতে চাইছিলো না। কিন্তু আমি বোঝানোর পর রাজি হলো। ওর জন্য দুজোড়া স্যান্ডেলও কিনলাম, কিছু খেলনা কিনলাম। অরুণার মাসহ আমার সাথে যারা থাকে তাদের সবার জন্য টুকটাক কেনাকাটা করলাম। কেনাকাটা শেষে বটতলার একটি হোটেলে বসে অতীনসহ আমরা চা-নাস্তা খেলাম। এবার কিন্তু উনচা ভীষণ খুশি। ওর চোখে-মুখে আনন্দ খেলা করছে।

তারপর টুডুদেও বাড়ির আঙিনায় রক্ত করবী ফুল দেখে আর নদীর পাড়ে মুক্ত হাওয়া খেয়ে আমরা যখন বাড়ি ফিরলাম তখন সন্ধ্যা পেড়িয়ে গেছে। 

রাতে খাবার খেতে বসে অরুণার মা বললো: বিবি, কেন মিছে এতগুলো টাকা তুমি খরচ করলে? কত্তগুলো টাকা চলে গেলো।
আমি বললাম: কেন শাড়ি পেয়ে তুমি খুশি হওনি?
ও মুচকি হেসে বললো: তা কি আর হইনি। অত দামি শাড়ি আমি জীবনেও পরিনি বিবি। উনচারে কত কিছু কিনে দিলা তুমি। এ কয়দিন তুমি ওর জন্য যা করছো সে ঋণ তো আমি কোনো দিনও শোধ করতে পারবো না।
আমি বললাম: ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। ওকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করে দাও। সব খরচ আমি দেবো। তুমি তাড়াতাড়ি খোঁজ নাও। আমার তো চলে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে।
শেষের কথাটা শুনে উনচা খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমি ওর দিকে এক পলক তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। 

পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙেই দেখি আমার ঘরের দরজায় উনচা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মনে হলো ওর চোখ দুটো যেন ভিজেভিজে। মনে হলো ও যেন কিছু একটা বলতে চায়। সে জন্য হয় তো অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়। ওকে কাছে ডাকলাম। ও গুটিগুটি পায়ে এলো আমার কাছে। বললাম: কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?
ও বললো: বিবি, তুমি কী চলে যাবে? 
এবার আমি বুঝলাম ওর মন খারাপের কারণ। বললাম: যেতে তো হবেই। এখানে যে আমার কাজ শেষ।
মুহূর্তেই ওর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো। ও নিশ্চুপ ভঙিতে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি ওকে কাছে ডেকে চোখ মুছে দিতে দিতে বললাম: ছি, এভাবে কাঁদে না। আমি তোমাকে স্কুলে ভর্তি করার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি সুন্দর করে পড়াশোনা করবে। আমি সব সময় তোমার খবর রাখবো।
হঠাৎ উনচা নিচু হয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো: তুমি আমাকে নিয়ে চলো বিবি। আমি তোমার সাথে যেতে চাই।

এই ছোট্ট মেয়েটার রোদনকরা আব্দার শুনে আমার চোখে জল চলে এলো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। আর ও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই চললো।

সারাটা দিন খুব অস্থির কাটলো আমার। অফিসে গিয়েও কাজে মন বসাতে পারলাম না। বার বার ওর শেষ কথাটা কানে বাজতে লাগলো, আমি তোমার সাথে যেতে চাই...।

ওকে কিভাবে আমি সাথে নিয়ে যাবো! পাহাড়ী এলাকার একটি ছোট্ট মেয়েকে আমি শহুরে জীবনের জটিলতায় কিভাবে বন্দি করবো। মুক্ত বিহঙ্গের মত যে সারাক্ষণ সবুজের বুকে ঘুরে বেড়ায় তার কি ফ্ল্যাট বাড়ির বন্দি জীবন ভালো লাগবে! আর তাছাড়া ওর খালা বা আতিœয়-স্বজনরা কোন বিশ্বাসে আমার হাতে ওকে তুলে দেবে। আমার মন বিষাদে ভরে উঠলো। একটি জটিল ভালোবাসার বন্ধনে আমি জড়িয়ে গেছি। এই মায়ার বন্ধন থেকে ছুটি নিয়ে এখান থেকে আমাকে চলে যেতে হবে।

এ ঘটনার পর দু তিন দিন উনচাকে আর বাংলোতে দেখা গেলো না। সেদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে ফিরে দেখি আমার পড়ার টেবিলের ওপর বেশ কতগুলো রক্ত করবী ফুল কে যেন রেখে গেছে। অরুণার মাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেই বললো: ওমা, এতো উনচা রেখে গেছে। বিবি, তোমার নাকি এ ফুল প্রিয়। তাই তো সে ওপাড়া থেকে এই ফুলগুলো চেয়ে নিয়ে এলো।
আমি ফুলগুলো হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললাম: কিন্তু উনচা কোথায়? আজ দুদিন ও এদিকে আসে না।
: সে কি! ও তো বললো তোমার হাতে ফুল দিয়ে গেছে।

মাধবপুর থেকে বিদায় নেবার দিন চলে এলো। তবুও নানা ছলে দিন দুয়েক দেরি করলাম। যাই যাই করেও কি কারণে যেন ফিরে যেতে মন চাইছিলো না। কিন্তু ফিরে তো যেতে হবেই। 

আজ সকাল থেকে সব জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধি শুরু হলো, বিকেল চারটায় বাস। কোম্পানিগঞ্জ থেকে টিকিট করা হয়েছে। বাস মাধবপুর স্টেশনে কিছুক্ষণ থামবে, এখান থেকে আমি উঠবো। বাংলো থেকে স্টেশন পাঁচ মিনিটের পথ। সেই সকাল থেকে আমার অফিসের লোকজন আমাকে বিদায় জানাতে আসছে আর যাচ্ছে। 

দুপুর নাগাদ গেটের বাইরে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। তাতে আমার লাগেজগুলো তোলা হচ্ছে। অরুণার মা, আরদালি মাইকেল আর ড্রাইভার অতীন ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। অরুণার মা সবচেয়ে বেশি ছুটোছুটি করে কাজ সামলাচ্ছে। কোনো কিছু যেন খোয়া না যায় সেদিকে তার নজর। সকলকেই দেখা গেলো। কিন্তু উনচা কোথাও নেই। ওকে দেখতে না পেয়ে আমি মনে মনে বেশ হতাশ হলাম।
ইশারায় অরুণার মাকে কাছে ডেকে বললাম: উনচা কোথায়?
: বিবি, অরুণা বললো সেই কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে ও যেন কোথায় চলে গেছে। অরুণা আর আমার ভাইপো ওকে অনেক খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি।

স্টেশনে যাওয়ার সময় হয়ে গেলো। আমি গাড়িতে চড়ে বসলাম, অরুণার মা এলো আমার সাথে। অতীন গাড়ি চালাতে শুরু করলো। পাঁচ মিনিটের পথ শেষে স্টেশনে পৌঁছে দেখি এ তিন মাস আমার পাশে যারা ছিলো তারা সকলেই চলে এসেছে শেষ বিদায় দিতে। শুধু উনচাকেই কোথাও দেখা গেলো না! আমার তৃষ্ণার্ত চোখ ওদিক-ওদিক ছুটে গেলো। কিন্তু নাহ্, উনচার দেখা মিললো না। 

বাস স্টেশনে চলে এসেছে। ছাড়তে আর মিনিট দুয়েক বাকি। আমি অরুণার মাকে ডেকে বললাম: তোমরা ভালো থেকো। আর উনচার যেন লেখাপড়া হয়। আমি নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে দেবো। ওকে বলবে, ওর বিবি ওকে কোনো দিনও ভুলবে না।

অরুণার মা কোনো কথা না বলে শুধু আঁচলে চোখ মুছতে থাকলো। 

বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেলো। মালপত্র তোলা হলো, আমি উঠে বসলাম। গরম বাতাসে ধুলো উড়িয়ে পিচঢালা কালো পথে চাকা ঘষে বাসটা ধীর গতিতে চলতে শুরু করলো। ঠিক এসময় এসি বাসের ঝাপসা কাচের জানালা গলে দেখতে পেলাম স্টেশনের গেটের বাইরে পথের ধারে একা দাঁড়িয়ে আছে উনচা। অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাসটার দিকে। 

বাসের চলার গতি বাড়লো, ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কোনো আগ্রহ মনের মধ্যে খুঁজে পেলাম না। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ক্ষণিকেই। বার বার উনচার আকুতিভরা কণ্ঠ ভেসে এলো কানে, তুমি আমাকে সাথে নিয়ে চলো বিবি।