ঢাকা, সোমবার ০৬, মে ২০২৪ ১১:৩৮:৪৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বজ্রপাতে মা-ছেলেসহ ৯ জনের মৃত্যু রাজধানীতে ৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে, ধোঁয়া দেখলেই পানি স্প্রে বজ্রপাতে বসতঘরে আগুন, ঘুমের মধ্যে মা-ছেলের মৃত্যু এএফআইপি ভবন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী আজ থেকে স্কুল কলেজ খোলা

আজ ভয়াল কালরাত্রি ২৫ মার্চ

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৪১ পিএম, ২৫ মার্চ ২০১৯ সোমবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বাঙালি জাতি তথা মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর রাত ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এ রাতে বাঙালির জীবনে এক বিভীষিকাময় রাত নেমে এসেছিল। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাপুরুষের মতো মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়।

আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে ঢাকা ও এর আশপাশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া কুলাঙ্গাররা।

পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী তারা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটনায়। বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে। দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের কাজ চলছে।

‘গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারীদের প্রতি তারা গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। এ অপারেশনে নিরপরাধ, ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এ অপারেশনে নিহতের সংখ্যার বিষয়ে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র-এর সভাপতি, ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা বলা একটু কঠিন।

তিনি বলেন, তবে ২৫ মার্চ রাত থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালে ঢাকায় সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করা হয়। ‘ঢাকায় গণহত্যার প্রথম পর্ব (১৯৭১ : ২৫ থেকে ৩১ মার্চ)’ শীর্ষক গবেষণাটি কিছুদিনের মধ্যে বই আকারে প্রকাশিত হবে। গবেষণাটি করেছেন রীতা ভৌমিক।

গবেষণাপত্রটি থেকে জানা যায়- ২৫ মার্চ কালরাত্রি এবং এর পরবর্তী কয়েকদিন ঢাকা শহরজুড়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, ইপিআর বাহিনী, ঢাকা পিলখানা, প্রেসিডেন্ট হাউস, গভর্নর হাউস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, সার্ভেন্ট কোয়ার্টার, রমনা কালীমন্দির, রমনা থানা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পুরানা পল্টন, পুরান ঢাকার নয়াবাজার, বাবুবাজার, কোতোয়ালি থানা, কাঠেরপুল, লোহারপুল, মানিকটোলা, শাঁখারীবাজারে বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটে।

এ গবেষণা কর্মের এক জায়গায় গবেষক রীতা ভৌমিক উল্লেখ করেছেন, ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে অনেক পুলিশ সদস্য শহীদ হন। এসআই, সুবেদার, নায়েক, হাবিলদার, সিপাহিসহ প্রায় দেড়শ’ পুলিশ সদস্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা জগন্নাথ হলের শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জিসি দেব), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, মধুর ক্যান্টিনের মধুসূদন দে (মধু দা ) এবং ২৫ মার্চ গুলিবিদ্ধ হয়ে চার দিন পর মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্রদের মধ্যে ৪৫ জন শহীদ হন।

জগন্নাথ হলের কর্মচারীদের মধ্যে পাঁচজন শহীদ হন। জগন্নাথ হলে ২৫ মার্চ রাতে তিনজন অনাবাসিক ছাত্রও শহীদ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে সাতজন শহীদ হন। ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সাতজন ছাত্র ও দু’জন কর্মচারী শহীদ হন। রোকেয়া হলে ৩৩ জন শহীদ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ শিক্ষক, ১০১ ছাত্র, একজন কর্মকর্তা, ২৮ কর্মচারী ও মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে, তার স্ত্রী, ছেলে ও পুত্রবধূকে হত্যা করে পাকবাহিনী।

রাত ১২টার পরপরই একসঙ্গে ঢাকার পিলখানার ওপর ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা আক্রমণ চালায়। বাঙালি ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সদস্যরা প্রাণপণে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালান। শহীদদের মধ্যে রয়েছেন- সুবেদার হেড ক্লার্ক আলা বখ্স, সুবেদার হেড ক্লার্ক দলিল উদ্দিন, সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার হাসমত উল্লাহ, ল্যান্স নায়েক আবুল বাশার প্রমুখ। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।

২৬ মার্চ দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার দিকে শাঁখারীবাজারের বাসিন্দাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনারা। তাৎক্ষণিক ১৪ জনকে হত্যা করা হয়। শাঁখারীবাজারে ৫৪ জন শহীদ হন। ২৮ মার্চ রাজাকাররা ডা. নিশিহরি নাগকে (৬৫) হত্যা করে।

২৭ মার্চ বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা বিউটি বোর্ডিং ঘেরাও করে। মালিক প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ বন্ধু-বান্ধব, বোর্ডার ও কর্মচারীসহ ১৯ জনকে ধরে নিয়ে যায়। ১৮ জনকে হত্যা করা হয়। একজন জিপ থেকে লাফিয়ে পালাতে সক্ষম হন।

২৭ মার্চ রাতে রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করে। তাদের হাতে নিহত ৬০ জন শহীদের নাম পাওয়া যায়। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পলাশীর মোড়ে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন লিখেছেন, ‘সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা এবং আরও তিন হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হয়। বাংলাদেশ হয়ে ওঠে শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।’

গবেষক রীতা ভৌমিক বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে ও ২৬ মার্চ ঢাকার নীলক্ষেত, পলাশী, রেলওয়ে বস্তিগুলোতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে অনেক বাঙালি শহীদ হন। তবে তাদের সংখ্যা কত, তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। নিউমার্কেটের কাঁচাবাজারের সব কসাইকে হত্যা করা হয়। ঢাকা শহর থেকে যখন লোক পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জিঞ্জিরার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের ওপর কামান দাগায় পাকসেনারা। এভাবে বহু লোককে হত্যা করা হয়। সদরঘাটের টার্মিনালে মধ্যরাতে ও ভোররাতে নির্বিচারে হত্যা করা হয়।

‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে ২৫ মার্চের কালরাত্রির বর্ণনার এক জায়গায় শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বলেছেন, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ভীষণ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসলাম। রুমী-জামী ছুটে এলো এ ঘরে। কী ব্যাপার? দু- তিন রকমের শব্দ- ভারি বোমার বুমবুম আওয়াজ, মেশিনগানের ঠা ঠা ঠা ঠা ঠা আওয়াজ, চিঁ-ই-ই-ই আরেকটা শব্দ। আকাশে কি যেন জ্বলে উঠছে, তার আলোয় ঘরের ভেতর পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠছে। সবাই ছুটলাম ছাদে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকের মাঠ পেরিয়ে ইকবাল হল, মুহসীন হল, আরও কয়েকটা হল, ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার্সের কয়েকটা বিল্ডিং। বেশিরভাগ আওয়াজ সেদিক থেকে আসছে, সেই সঙ্গে বহু কণ্ঠের আর্তনাদ, চিৎকার।’

প্রতিথযশা চিত্রশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন আহমেদ তার ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘২৫ মার্চের পর আমার বাবা-মা এই প্রথম ঘরের বাইরে এলেন। আর আমি একা একা কলাবাগানের বাসা থেকে বের হয়ে বাইরের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছি।

জানার চেষ্টা করছি, ভয়াবহতা কতটুকু চলেছে। প্রথমেই আমি গ্রিন রোডের দিকে গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখি রিকশায় তিনটি লাশ পড়ে আছে। রিকশাওয়ালা আর দু’জন যাত্রী। তিনজনেই লুঙ্গি পরা। মনটা খারাপ হয়ে গেল ভীষণ। খুব ছোটাছুটি করতে লাগলাম। এরপর গেলাম সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে। ওখানেও দেখলাম ৪-৫টা লাশ পড়ে আছে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে মিরপুর রোডে গেলাম। সেখানে দেখি ট্রাকভর্তি হেলমেট পরা অস্ত্রধারী পাকিস্তানি সৈন্য।’

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। তার ডাকে দেশের সর্বত্র সশস্ত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। অকুতোভয় বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।


-জেডসি