ঢাকা, মঙ্গলবার ১৯, মার্চ ২০২৪ ১২:৪৩:১১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
মীমের বিষয়ে যে আশ্বাস দিলেন জবি উপাচার্য হিলিতে পেঁয়াজের দাম কেজিতে কমেছে ৫০ টাকা ভোরে গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ২০ রোহিঙ্গাদের জন্য ইউএনডিপিকে যে আহ্বান জানালেন প্রধানমন্ত্রী গাজীপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ আরো শিশুসহ ৪ জনের মৃত্যু তিনদিনের সফরে সুইডেনের রাজকন্যা ঢাকায়

একাত্তরে শহীদ ভাগীরথীকে ভুলে গেছে জাতি

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৫২ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার

ছবি: পিরোজপুর মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ

ছবি: পিরোজপুর মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ

মহান মুক্তিযুদ্ধে জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন পিরোজপুর এক নিভৃত গ্রামের গৃহবধূ ভাগীরথী সাহা। দিনটি ছিল ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। সেদিন পিরোজপুর শহরের পিচঢালা কালোপথ লাল হয়েছিলো শহীদ ভাগীরথীর তাজা রক্তে।

পিরোজপুরের পাশের জেলা বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার দেবীপুর গ্রামে ১৯৪০ সালে ভাগীরথীর জন্ম। বাবা বসন্ত সাহা ছিলেন গরীব মুড়ি বিক্রেতা। অভাবের কারণে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তার।  ১৯৫৬ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। পিরোজপুরের বাগমারার প্রিয়নাথ সাহার সাথে। তাদের ঘরে জন্ম নেয় দুই ছেলে। ১৯৬৭ সালে প্রিয়নাথ সাহা মারা যান। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে বিধবা হন ভাগীরথী। কখনো ঝিয়ের কাজ করে কখনো ভিক্ষা করে অনেক কষ্টে ছেলেদের মুখে খাবার তুলে দেন তিনি। জুজখোলা গ্রামের নিরীহ নারী ভাগীরথীর দিনকাল চলে যাচ্ছিলো কোনো রকম।

একাত্তরের ৪ মে ৩২ পাঞ্জাবের এক প্লাটুন পাক হায়না হানা দেয় পিরোজপুরে। হুলারহাট লঞ্চঘাট থেকে শহরে প্রবেশের পথে তারা মাছিমপুর আর কৃষ্ণনগর গ্রামে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। কয়েকশ নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। রাজাকার আলবদর জামায়েত ও মুসলিমলীগের সমর্থকদের সহযোগিতায় পাকসেনারা বাগমারা গ্রামের সব কয়টি বাড়ির মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। হিন্দুদের ঘরবাড়িগুলো পুড়িয়ে দেয়।

একদিন তারা আসে জুজখোলা গ্রামে। এ গ্রামের আইয়ুব আলী মেম্বারের পরিবারের ১৪ জনকে একসাথে হত্যা করে পাকসেনারা। এরপর স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা হানা দেয় ভাগীরথীর বাড়িতে। তার বাড়িসহ আশেপাশের বাড়িগুলোর সব কিছু লুট করে নিয়ে যায়। আগুনে পুড়িয়ে দেয় ঘরবাড়ি।

দুই ছেলেকে নিয়ে আবার মহাবিপদে পড়ে যান ভাগীরথী। উপায় না দেখে পিরোজপুরে শহরে বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেন। প্রতিদিন সকালে তিনি নৌকায় পিরোজপুর শহরে এসে বিভিন্ন বাসায় কাজ করেন। নৌকায় চড়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসার সময় তার চোখে পড়ে নদীতে ভাসমান মানুষের লাশ। নদীর পাড়ে শিয়াল শকুনে খাচ্ছে লাশ! এক সময় তার মনে জ্বলে উঠে প্রতিশোধের অগ্নিশিখা।

সেই সময় বাগমারাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বাড়তে শুরু করেছে। ১৩ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা একপাই জুজখোলা গ্রামে অবস্থান নেন। পরে মতিউর রহমান সরদারের নেতৃত্বাধীন আরেকটি দল সরোয়ারের সঙ্গে মিলিত হয়ে পাকসেনাদের দোসর রাজাকার কমান্ডার আবদুল আলীর উপর আক্রমণ চালায় এবং তাকে হত্যা করে।

এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভাগীরথী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আগ্রহের কথা জানান। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানি হানদার ও তাদের দোসরদের গতিবিধির উপর নজর রাখার। মুক্তিযোদ্ধাদের চর হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে ভাগীরথী পিরোজপুর শহরে এসে কাজ শুরু করেন। পাকসেনাদের ক্যাম্পের সামনে গিয়ে ভিক্ষুকের বেশ ধরেন। তাকে দেখে পাকিস্তানি সুবেদার সেলিম ভাগীরথীকে প্রস্তাব দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে গোপন তথ্য দেয়ার। ভাগীরথী তার প্রস্তাবে রাজি হন। মিথ্যে তথ্য দিয়ে পাকবাহিনীকে বিভ্রান্ত করার বুদ্ধি করেন তিনি।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুত রেখে ২৯ আগস্ট বাগমারায় পাকসেনাদের নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন ভাগীরথী। ভাগীরথীর কাছ থেকে খবর পেয়ে পাকসেনারা সেখানে যায়। ওই দিন মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ করে পাকিদের। বেশ কয়েকজন পাকসেনা মারাত্নকভাবে আহত হয় মুক্তিযোদ্ধারে গেরিলা আক্রমণে।

৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর আবারও ভাগীরথী পাকসেনাদের বিপদে ফেলেন। তার দেয়া তথ্যমত পোরগোলা গ্রামে যায় পাকসেনারা। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা বুঝতে পারে তারা পাতানো ফাঁদে পড়েছে। সম্মুখযুদ্ধে ৪৫ জন পাকসেনার মধ্যে মাত্র ৪ থেকে ৫ জন ক্যাম্পে ফিরে আসতে পারে। ভগীরথীর কৌশল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ধুরন্ধর পাকসেনাদের বুঝতে বাকি থাকে না এটা একান্তই ভগীরথীর ফন্দি।

সেনারা ক্যাম্পে ফিরে ক্যাম্প প্রধান ক্যাপ্টেন এজাজ  নিশ্চিত হয় ভাগীরথী মুক্তিযোদ্ধাদের চর। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয় সে।

১৩ সেপ্টেম্বর ভাগীরথী যথারীতি পিরোজপুর শহরে আসেন। বাজারে বসে পাকসেনাদের চলাচল নজর করতে থাকেন। অল্প কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনীর দালাল শামসুল হক ফকির ও আশরাফ হোসেন তাকে দেখে ফেলে। তখনই ক্যাম্পে খবর পাঠায়। দুজন পাকিস্তানি হানাদার আর ছয়জন রাজাকার এসে হাজির হয়। ভাগীরথীকে ধরে টেনেহেচরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। ক্যাপ্টেন এজাজের সামনে হাজির করে। এজাজ সুবেদার সেলিমকে নির্দেশ দেয় ভাগীরথীকে হত্যা করার।

এ নির্দেশ পাওয়ার পর দু’জন সিপাহি দড়ি দিয়ে ভাগীরথীর দুই হাত বেঁধে তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। দড়ির অপর প্রান্ত মোটর সাইকেলের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। মোটর সাইকেলটি নিয়ে পিরোজপুর শহরের চৌমাথা থেকে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ছুটে বেড়ায় সুবেদার সেলিম। ঘন্টাখানেক এভাবে ঘুরতে থাকে সে। ইট-পাথরের আঘাতে ভগীরথীর চোখ-মুখ-শরীর থেতলে যায়। তার রক্তে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো রাজপথ! এই নির্মম অত্যাচারে এক সময় ভাগীরথী প্রাণহীন হয়ে পড়েন। পরে তার নিথর দেহটি নিক্ষেপ করা হয় খরস্রোতা বলেশ্বর নদে।

পিরোজপুরের সাংবাদিক খালিদ আবু বলেন, আমি স্বচক্ষে পোস্ট অফিস রোড থেকে ভাগিরথীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছি। দেখেছি ভাগিরথীর রক্তাক্ত সাদা শাড়ি আর রাস্তায় রক্তের ছোপ।

তিনি আরও বলেন, আমার মনে হয়, বলেশ্বর সারাক্ষণ বিলাপ করে। সাহসী ভাগীরথীকে বক্ষে ধারণের সামর্থ্য আছে বলেশ্বরের? আমি জানি না।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধকালীন কমান্ডার মতিউর রহমান সরদার বলেন, ভাগিরথীর উপর অর্পিত দায়িত্ব সে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। তাকে যেভাবে শহরের রাস্তায় টেনে হত্যা করা হয়েছে তা একমাত্র পশুদের পক্ষেই সম্ভব। পাকিস্তানী নরপশুরা তাই করেছে।

ভাগীরথী সাহার বড় ছেলে কার্তিক সাহা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। ছোট ছেলে ৬০ বছর বয়সী গণেশ সাহা দিনমজুর। থাকেন পিরোজপুরেই। আজও মায়ের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির আশায় দিন গোনেন তিনি।

সাগর তীরের জেলা পিরোজপুরের খরস্রোতা বলেশ্বরের বুক থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মরদেহটি উদ্ধার করে শহীদের স্বজনরা। পরে তার গ্রামের বাড়িতে সৎকার করা হয়। এখনও তার সমাধির শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু পড়ে আছে বাড়ির এক নির্জন কোণায়। শহীদের পুত্র গণেশ সাহা দারিদ্রের কারণে নিজ উদ্যোগে সেটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারেননি।

দেশের জন্য সর্বোচ্চ আত্মদানকারী এই নারীর জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি তেমন কোন উদ্যোগ। পিরোজপুর শহরে স্থাপিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে ভাগীরথীর নাম রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আর শহরের কৃষ্ণচূড়া মোড়টিতে তার নামে রয়েছে একটি ফলক।