ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ৫:১৫:৪৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
আজ আসছে না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা পেছাল খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে জুবাইদা রহমান ‘শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের ইতিবাচক সাড়া নেই’ বেশির ভাগ সবজিই ৬০-৮০ টাকার ওপরে বন্যায় সহায়তা: বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী

ও. হেনরী এবং একটি পানশালার সাতকাহণ

আইরীন নিয়াজী মান্না, নিউ ইয়র্ক থেকে | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৫৪ এএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ শনিবার

নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে Pete`s Tavern পানশালার সামনে আইরীন নিয়াজী মান্না।

নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে Pete`s Tavern পানশালার সামনে আইরীন নিয়াজী মান্না।

ছবির এই পানশালাটিতে জীবনে বহুবার আড্ডা দিয়েছেন কালজয়ী মার্কিন কথাসাহিত্যিক ও. হেনরী। কথিত আছে তিনি তার বিখ্যাত ছোট গল্প ‘দি গিফট অব দ্যা ম্যাজাই’ এখানে বসেই লিখেছিলেন, মাত্র দু’ঘন্টায়। হয়তো অনেকেই জানে না সে গল্প, আবার হয় তো অনেকেরই জানা।

এদিকে নিউ ইয়র্কে আসার পর থেকে ভাবছি, আমার প্রিয় লেখকের পায়ের স্পর্শ পরেছে যে জায়গায় তা দেখতে যাবো না? তা তো হয় না! ‘দি গিফট অব দ্যা ম্যাজাই’ পড়ে ফেলেছি সেই কবে; তারপর তার লেখা আরো সব অসাধারণ ছোটগল্প পড়েছি। আমেরিকায় যেমন পাঠপুস্তকে ও. হেনরীর গল্প রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তকেও এক সময় তার গল্প ছিলো। মূলত এ কারণেই বাংলাদেশে কিশোর-তরুণ পাঠকদের কাছে তার নামটি বিশেষভাবে পরিচিত। 

নিউ ইয়র্কে ‘Pete's Tavern’ নামে বহু পুরানো একটি পানশালা রয়েছে। পানশালাটি ম্যানহাটনের ১২৯ পূর্ব, ১৮ সড়কে। বিখ্যাত ইউনিয়ন স্কয়ারের একদম কাছে। পানশালাটি ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। পানশাল কর্তৃপক্ষের  দাবি এটিকে বিখ্যাত করেছেন ও. হেনরী। তিনি এখানে নিয়মিত আসতেন বলেই ‘Pete's Tavern’-র নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। 

পানশালার সামনের সড়কপথটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ও হেনরী’স ওয়ে’ নামে। ইলেক্ট্রিক সাইনের লাল আলোয় জ্বলছে  একটি লেখা ‘The Tavern O. Henry Made Famous’। প্রধান দরজার পাশের লোহার বারে খোদাই করে লেখা আছে ও. হেনরী এবং তার লেখা সম্পর্কে কয়েকটি কথাসহ পানশালাটি এখন কারা চালায় ইত্যাদি।

পানশালার ভেতরে এবং বাইরে বসার ব্যবস্থা আছে। প্রায় ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে। লোকে লোকারণ্য থাকে সারাক্ষণ। খদ্দেররা নানা স্বাদের পানীয়র সঙ্গে এখানে বসে খেতে পারেন স্টেক, চিকেন ফাইডসহ অন্যান্য খাবার।

মাত্র ৫২ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনের শেষ দশ বছর নিউ ইর্য়ক শহরে বসবাস করেছেন প্রিয় এই লেখক। এ শহরের অলিগলি-রাজপথে ঘুরে ঘুরে তিনি লক্ষ্য করতেন সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ। তারপর তা তুলে আনতেন নিজের গল্পে। 
‘The Gift of the Magi’ ছোট গল্পটি ১৯০৫ সালে নিউ ইয়র্ক সানডে ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯০৬ সালে গল্পটি ‘The Four Million’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। 

ও. হেনরি কল্পলোকের গল্পলেখক: ও. হেনরী, কালজয়ী মার্কিন কথাসাহিত্যিক। তার আসল নাম উইলিয়াম সিডনী পোর্টার। রসিকতা, বিশেষ ধরনের চরিত্র সৃষ্টি ও গল্পের শেষে অসাধারণ চমক সৃষ্টির জন্য বিখ্যাত তিনি। হেনরী আমেরিকার সাধারণ মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়ে ছয় শ’র বেশি গল্প লিখেছেন। 

এক সময় কলেজ পাঠ্য হওয়ায় তার লেখা ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’ গল্পটি বাংলাদেশে খুবই পরিচিত ও জনপ্রিয়। ১৯১০ সালের ৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে মারা যান জনপ্রিয় এই ছোটগল্পকার। 

জন্ম ও ছেলেবেলা: ও. হেনরি ১৮৬২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নর্থ ক্যারোলিনার গ্রিনসবরোতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম অ্যালগারনন সিডনি পোর্টার, তিনি পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। আর মা মেরি জেন ভার্জিনিয়া ছিলেন গৃহিণী। মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারান এই লেখক। পরে তিনি বড় হন নানী ও খালার কাছে। খালা এভেলিনা ছোট্ট হেনরি এবং তার বড় ভাই শার্লির পড়াশুনার দায়িত্ব নেন। লিনা পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তার উৎসাহেই শিশুকাল থেকে ও হেনরির মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ জন্মে। তার বয়স যখন দশ, তখনই তিনি ডিকেন্স এবং স্যার ওয়াল্টার স্কটের লেখা পড়তেন মনযোগ দিয়ে।  

১৮৭৬ সালে খালার স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন হেনরী। ভর্তি হন লিন্ডসে স্ট্রিট হাই স্কুলে। কিন্তু মাত্র পনের বছর বয়সে একদিন সার্টিফিকেট না নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দেন। কাজ নেন মামার ফার্মেসিতে। তখনকার দিনে ফার্মেসিতে নির্দিষ্ট সময় কাজ করলে তা প্রশিক্ষণ হিসেবে ধরা হতো। এর ভিত্তিতে দেয়া হত ফার্মাসিস্টের লাইসেন্স। তিনিও সেই সুযোগই কাজে লাগালেন। চার বছরের মাথায় লাইসেন্স নিয়ে হয়ে যান অনুমোদিত ফার্মাসিস্ট।  

মামার ফার্মেসিতে কাজ করার সময়ই প্রথম তার মধ্যে সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ঘটে। ফার্মেসিতে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে তিনি সাবলিলভাবে কাস্টমারদের স্কেচ আঁকতেন। কাস্টমাররা তার প্রতিভা দেখে অবাক হয়ে যেত।   

নানা পেশায় হেনরী: দীর্ঘ বত্রিশ বছর ও হেনরি নানা পেশায় জড়িত ছিলেন। কখনো ওষুধের দোকানের কেরানি, খামার বাড়ির কেয়াটেকার, হিসাবরক্ষক, ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট্যান্ট, শিক্ষক কিংবা সাংবাদিকের কাজ করেছেন।

এক সময় চাকরি নেন ব্যাংকের কেরানি পদে। এরই মধ্যে রম্য সাপ্তাহিক ‘দ্য রোলিং স্টোন’ বের করেন তিনি। কাগজটি না চলায় হিউস্টন পোস্টে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। 

এদিকে ব্যাংকে চাকরি করার সময় ১৮৯৬ সালে তিনি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তখন হেনরী পালিয়ে নিউ অরলিয়ন্সে চলে যান। কিন্ত এর কিছুদিন পর তার নামে মামলা হলে কাঠগড়ায় না দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী দেশ হন্ডুরাসে পালিয়ে যান তিনি। হন্ডুরাসে যাওয়ার মাত্র ছয় মাস পর তার স্ত্রী যক্ষায় আক্রান্ত হয়। ফলে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং পুলিশের কাছে ধরা দেন। বিচারে তার পাঁচ বছরের জেল হয়। 

জেলজীবন: ১৮৯৮ সালের ২৫ এপ্রিল, স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে আগে ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের কলম্বাস জেলখানায় কয়েদি নম্বর ৩০৬৬৪ হিসেবে জেলজীবন শুরু করেন ও হেনরি। অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সেখানে নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট হিসেবে জেল কারাগারে রাতে কাজ করতেন এই লেখক।

জেলে থাকাকালে বিভিন্ন ছদ্মনামে চৌদ্দটি গল্প লিখেন হেনরী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পায় ‘ও হেনরী’ নামটি। অলিভার হেনরী নামটি প্রথম ব্যবহার করেন ১৮৯৯ সালের ম্যাকক্লারেস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘হুইসলিং ডিকস ক্রিস্টমাস স্টকিং’ গল্পে। পরে অলিভার হেনরি থেকে হন ও হেনরি। নিউ অরলিয়ন্সের এক বন্ধু গল্পটি পত্রিকায় পাঠান। পত্রিকা কর্তৃপক্ষের ধারণাই ছিল না লেখক জেলে বন্দি আসামি। 

ভালো আচরণের কারণে সাজা মওকুফ হয়ে যায় তার। সাজার তিনবছর পূর্ণ হলে ১৯০১ সালের ২৪ জুলাই মুক্তি পান তিনি। মুক্তি পেয়েই পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গে মেয়ে মার্গারেটের কাছে ছুটে যান। মার্গারেটকে তার বাবার জেলে থাকার কথাটি কখনো বলা হয়নি। মেয়ে জানতো ব্যবসার কাজে বাবা বাইরে আছেন।

নিউ ইয়র্কে লেখক: ও. হেনরী পিটসবার্গ থেকে ১৯০২ সালে চলে যান নিউ ইয়র্কে। নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও অন্যান্য প্রকাশকদের জন্য সপ্তাহে একটি করে গল্প লিখতে হতো তাকে। তার প্রথম গল্প সংকলনের নাম ‘ক্যাবাজেস অ্যান্ড কিংস’ (১৯০৪)। নিউইয়র্কে থাকার সময় ৩৮১টির মতো গল্প লেখেন তিনি। 

তার দ্বিতীয় গল্প সংকলনের নাম ‘দ্য ফোর মিলিয়ন’ (১৯০৬)। এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল বিখ্যাত ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’, ‘দ্য স্কাইলাইট রুম’ ও ‘দ্য গ্রিন ডোর’। তার আরও দুটি বিখ্যাত গল্প হলো ‘দ্য রানসাম অব রেড চিফ’ ও ‘দ্য ফার্নিসড রুম’। পাঠকপ্রিয় অন্যান্য সংকলনের মধ্যে রয়েছে ‘রোডস টু ডেস্টিনি’ ও ‘সিক্সেস অ্যান্ড সেভেনস’। গল্পগুলো তার সমকালকেই ধারণ করে। অধিকাংশ গল্পের চরিত্র সমাজের নিচু তলার মানুষজন। তাদের নিঃসঙ্গতার নানা চিত্র এ সব গল্পে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

জীবদ্দশায় ও. হেনরী বেশ খ্যাতি লাভ করেন, হয়ে উঠেন প্রভাবশালী লেখক। তার গল্প বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় দিক হলো তার গল্প বিভিন্ন দেশে পাঠ্যক্রমে স্থান পেয়েছে। তার গল্প অবলম্বনে তৈরি হয়েছে সিনেমা। তার জীবদ্দশায় মুক্তি পায় তিনটি নির্বাক ছবি-‘দ্য স্যাক্রিসাইস’ (১৯০৯), ‘ট্রাইং টু গেট অ্যারেস্টেড’ (১৯০৯) ও ‘হিজ ডিউটি’ (১৯০৯)। তার লেখা অবলম্বনে নির্মিত আরও দুটি বিখ্যাত ছবি হলো ‘দ্য অ্যারিজোনা কিড’ (১৯৩১) ও ‘দ্য কিসকো কিড’ (১৯৩১)। ১৯৫২ সালে পাঁচটি গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘ও হেনরীস ফুল হাউস’। এতে স্থান পেয়েছে ‘দ্য কপ অ্যান্ড দ্য অ্যান্থেম’, ‘দ্য ক্লারিওন কল’, ‘দ্য লাস্ট লিফ’, ‘দ্য রানসাম অব রেড চিফ’ ও ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’। 

তার গল্পগুলোতে নাগরিক জীবন, বিচিত্র পেশার মানুষ, জীবনের নানা দ্বন্দ্বসংঘাত, হাসিকান্না ও ব্যঙ্গ-পরিহাস অপরূপ সুষমায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। ও. হেনরী সমাজের সকল স্তরের মানুষ নিয়ে গল্প লিখেছেন। তবে তার গল্পের একটি অসাধারণ বিষয় হলো, মানুষকে তিনি কখনোই অমানুষরূপে চিত্রিত করেননি। তার গল্পের পাত্রপাত্রীরা সবাই সাধারণ স্তরের মানুষ। এসব গল্পের নামধাম ও সময়টা বদলে নিলেই মনে হয় এরা আমাদের চারপাশেরই মানুষ।

দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি কখনো: দুর্ভাগ্য সারাজীবন ও হেনরীকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তাও তার ব্যক্তিগত জীবনের দুর্ভাগ্যকে সামান্য কমাতে পারেনি। একমাত্র সন্তান মেয়ে মার্গারেট ৩৭ বছর বয়সে মায়ের মতোই যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্ত্রীকে হারানোর পর ও. হেনরি মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু মেয়ের মৃত্যুর পর তা একদম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পরে। নিজের একাকিত্ব কমাতে ১৯০৭ সালে সারাহ লিন্ডসে কোলম্যান নামে এক তরুণীকে বিয়েও করেন হেনরী। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ১৯০৮ সালে সে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। 

মৃত্যু: অতিরিক্ত মদপানের কারণে তার শরীর ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। ১৯০৯ সালের কথা; ডাক্তার জানান, তার লিভার প্রায় নষ্ট। জন্মভূমি গ্রিনসবরোতে ফিরে গেলেন তিনি। মনে আশা, আবহাওয়ার বদল হলে হয়ত শরীরের কিছুটা উন্নতি হতে পারে। কিন্তু ছয় মাস কেটে গেলেও কোনো উন্নতি হলো না। অগত্যা তিনি আবারও ফেরত গেলেন নিউ ইয়র্ক শহরে।

১৯১০ সালের ২ জুন, অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পরলেন ও হেনরী। বন্ধুরা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন, ভর্তি করা হলো। রাতে যখন নার্স কেবিনের লাইট নিভিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন ও হেনরী বলে উঠলেন, ‘দয়া করে লাইট জ্বালিয়ে দাও। অন্ধকারের মধ্যে আমি বিদায় নিতে চাই না’। তারপর সাদা বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কেটে গেল আরো দুটি দিন। অবশেষে এলো সেই ৫ জুন, সূর্যোদয়ের পর দিনের প্রখর আলোতে চলে গেলেন কোটি কোটি পাঠকের হৃদয় জয় করা লেখক ও হেনরী। তখন তার বয়স মাত্র ৫২।

আইরীন নিয়াজী মান্না
জামাইকা, নিউ ইয়র্ক