ঢাকা, শুক্রবার ২৬, এপ্রিল ২০২৪ ২১:২৯:৫৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি ছাড়াবে আগামী সপ্তাহে থাইল্যান্ডের গভর্নমেন্ট হাউসে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী চলতি মাসে তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা নেই গাজীপুরে ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু থাইল্যান্ডের রাজা-রাণীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ

কুমিল্লায় রানী ময়নামতির হারিয়ে যাওয়া প্রাসাদ

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:৩৬ পিএম, ১৩ নভেম্বর ২০২২ রবিবার

ফাইল ছবি।

ফাইল ছবি।

রানী ময়নামতীর কথা আমি প্রথম জানতে পারি কবি আল মাহমুদের কাছে। সম্ভবত বছর পনেরো আগে। সে সময় তিনি ছোটদের পত্রিকা কিশোর লেখা’য় একটি কিশোর উপন্যাস লেখেন; নাম ময়নামতীর নেকলেস। রানী ময়নামতীর একটি নেকলেস হারিয়ে যায় এবং এটিকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে চলে উপন্যাসের কাহিনি। উপন্যাসটি লেখার সময় আল মাহমুদ তার বাসায় বসে আমাকে সেই উপন্যাসের পটভূমি বলেন। বলেন কুমিল্লার ময়নামতীর সেই প্রভাবশালী রানীর গল্প।

রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী ময়নামতী ছিলেন প্রজ্ঞাবান, চৌকোস ও দয়াশীল। তার নামেই নামকরণ হয় কুমিল্লার ময়নামতীর। এখানেই এই রানীর প্রাসাদ।

কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলায় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পূর্ব পাশে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে সৌন্দর্যমন্ডিত রানী ময়নামতির প্রাসাদ অবস্থিত। কুমিল্লার লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের উত্তরাংশে অবস্থিত এই ‘প্রাসাদ’। স্থানীয়দের কাছে প্রাসাদ হিসেবে পরিচিত হলেও এটি আসলে একটি বৌদ্ধমন্দির বা বিহার। 

দশম শতাব্দীতে চন্দ্র বংশীয় রাজা মানিক চন্দ্র স্ত্রী ময়নামতির আরাম আয়েশের জন্য এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ধারণা করা হয়, ময়নামতি ইউনিয়নের প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটি ৮ম থেকে ১২শ শতকের এক প্রাচীন কীর্তি। 

ইতিহাস বলছে, ময়নামতী ছিলেন নাথ ধর্মের অনুসারী একজন সাধক। সাধন ব্রত পালন করে তিনি মহাজ্ঞান লাভ করেছিলেন। অগ্নি, জল আর বায়ু- এই তিন বস্তুকে জয় করে ময়নামতী লাভ করেন অমরত্ব। তার ছিল আড়াই অক্ষর জ্ঞানের শক্তি। রূপে-গুণে অতুলনীয় বঙ্গ হরিকেরের পূর্বে আরাকান রাজ্যের রাজা থাতোমিনথরের দুই কন্যা এলাচ সুন্দরী ও বিলাস সুন্দরীকে রাজা মানিকচন্দ্র তৃতীয় বিবাহের মাধ্যমে প্রাসাদে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। রানী ময়নামতী এই সংবাদ শুনে রাজার ওপর ক্ষুব্ধ হন। তৃতীয় বিয়ে করতে রাজাকে অটল দেখে রানী রাজাকে একটি শর্ত দিয়ে বলেন, 'ফেরুসা নগরে আমার জন্য আলাদা একটি কুটির নির্মাণ করে দিতে হবে। তৃতীয় রানী ঘরে আসার আগেই আমি ঐ কুটিরে চলে যেতে চাই।' রাজা রানীর দেয়া শর্তে এক বাক্যে রাজি হলেন এবং দু'বোনকে বিয়ের পূর্বেই রানীর জন্য কুটির নির্মাণ করে দেন। তৃতীয় ও চতুর্থ রানী ঘরে আসার আগেই রানী ময়নামতী ফেরুসা নগরে থিতু হন। সমতটের সমৃদ্ধ নগরী ছিল কমলাঙ্ক। স্বর্ণালঙ্কারের মতোই ছিল তার ঐশ্বর্য। রাজপ্রাসাদ, আনন্দ বিহার, শালবন বিহার, ভোজ বিহার, রূপবানমুড়া, ইটাখোলামুড়া, চারপত্রমুড়া, কোটিলামুড়া, ফেরুসানগর, রাজগঞ্জ, রানীর দিঘি ইত্যাদি স্থান এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। শ্রমণ, ভিক্ষু, ঋত্বিক, পুরোহিত, মালি, মুচি, চাষা, জেলে, গোপাল, সুতার, নাপিত, ধোপা, চাঁড়াল, পোদ্দার, বণিক, তস্কর, লস্কর সকল জাতি-পেশার মানুষ নিয়ে তার রাজ্য। কর্মই ধর্ম- এই মন্ত্রে চলেছে সমাজ। 

প্রায় ১০ একর জায়গা জুড়ে লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে সমতল থেকে ১৫.২৪ মিটার উচ্চতায় একটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের চূড়ার উপর রানী ময়নামতির এই প্রাসাদ। 

স্থানীয়দের মতে, এই স্থানতে একটি ক্রুশাকৃতির মন্দির ছিল।  পরবর্তীতে এটি সংস্কার করে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ যুগে ক্রমান্বয়ে ছোট আকারের একটি পূর্বমুখী মন্দির বানানো হয়। ১৯৮৮ সালে ভূমি সমতল থেকে ৩ মিটার গভীরে প্রাপ্ত একটি সুড়ঙ্গ পথের সামনে খননের মাধ্যমে এই প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া যায়। 

খননের করার সময় এখানে বেশ কিছু পোড়ামাটির ফলক এবং অলংকৃত ইট আবিষ্কৃত হয়েছে। খননের পরে বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, এই প্রাসাদটি ৮ম থেকে ১২শ শতকের প্রাচীন কীর্তি। রাণী ময়নামতির প্রাসাদ অপরূপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।

জানা যায়, ১৯৮৮ সালে এখানে খননকাজ শুরু হলে পাওয়া যায় চারটি নির্মাণ যুগের স্থাপত্য কাঠামো। প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া প্রত্নবস্তুগুলো অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের বলে অনুমান করা হয়। প্রাথমিকভাবে এখান থেকে নির্মাণ যুগের ৪টি স্থাপত্য, ৫১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫০০ ফুট আয়তনের বেষ্টনী প্রাচীর, পোড়ামাটির ফলক, মূল্যবান প্রত্নবস্তু ও অলংকৃত ইট আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে খনন করে পাওয়া গেছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের হাতিয়ার, জীবাশ্ম কাঠ, কালির দোয়াত, কলস, হাঁড়ি, বাটি, পানির পাত্র, লোহার কাস্তে, ঘর নির্মাণসামগ্রী, পেরেক, শাবল ইত্যাদি। ২০১৬ সালে তৃতীয় দফায় খনন শুরু হয়। 

প্রতিবছর ৭ বৈশাখ এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাসব্যাপী বৈশাখী মেলা আয়োজন করা হয়। দূর দূরান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী এই মেলায় ভিড় করেন।

কিভাবে যাবেন: রানী ময়নামতির প্রাসাদে যেতে হলে প্রথমেই কুমিল্লা শহর আসতে হবে। ঢাকা থেকে ট্রেন বা বাসে কুমিল্লা যেতে পারবেন। কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন হতে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী/গোধূলী, উপকূল এক্সপ্রেস, তূর্ণা ও পাহারিকা এক্সপ্রেস ট্রেনে কুমিল্লা যাওয়া যায়।

রাজধানীর সায়েদাবাদ বা কমলাপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে রয়্যাল কোচ, এশিয়া এয়ারকন, বিআরটিসি, প্রিন্স, এশিয়া লাইন, তৃষার মতো নন এসি বা এসি বাসে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতে পারবেন। অথবা চট্টগ্রাম বা ফেনীগামী বিভিন্ন বাসে কুমিল্লা যাওয়া যায়। বাসভেদে ভাড়া লাগবে ১৭০ থেকে ৩০০ টাকা। বাস থেকে কুমিল্লার কোটবাড়ি বিশ্বরোড বা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট গেইট নেমে অটোরিকশা দিয়ে ময়নামতি সাহেব বাজার এলাকার কাছে অবস্থিত রানী ময়নামতির প্রাসাদ যেতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন: কুমিল্লার কান্দিরপাড়, শাসনগাছা ও স্টেশন রোড এলাকায় বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। এদের মধ্যে হোটেল সোনালী, হোটেল ভিক্টোরিয়া আবাসিক, আমানিয়া রেস্ট হাউজ, হোটেল ড্রিম ল্যান্ড, মাসুম রেস্ট হাউজ, হোটেল মেলোডি, হোটেল নূর অন্যতম।

কোথায় খাবেন: রানী ময়নামতির প্রাসাদ যাওয়ার পথে মিয়ামি রিসোর্ট, জমজম হোটেল, হক ইন রেস্টুরেন্ট ও পিসি রেস্তোরার মতো বেশকিছু রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এছাড়াও কুমিল্লা শহরে ইরিশ হিল হাইওয়ে হোটেল, সৌদিয়া হোটেল, ঝাল বাংলা রেস্তোরা, হোটেল ময়নামতি, উজান হাইওয়ে, আনোয়ার হোটেল, সাকিব হোটেল এবং লিজা হোটেলসহ বিভিন্ন মানের অসংখ্য রেঁস্তোরা আছে। তবে অবশ্যই কুমিল্লার মনোহরপুরের মাতৃভাণ্ডারের বিখ্যাত রসমালাই ও রসগোল্লা, ভগবতীর পেড়া, মিঠাই এর মালাই চপ ও মাতৃভূমির মালাইকারির স্বাদ নিতে ভুলবেন না।

ফিচার ইমেজ: নাদিম আহসান তুহিন