ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ৬:৩৫:১৭ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া ট্রেনে ঈদযাত্রা: ৭ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু গাজায় নিহত বেড়ে ৩২ হাজার ৪৯০ অ্যানেস্থেসিয়ার ওষুধ বদলানোর নির্দেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঈদ কেনাকাটায় ক্রেতা বাড়ছে ব্র্যান্ড শপে বাঁচানো গেল না সোনিয়াকেও, শেষ হয়ে গেল পুরো পরিবার

‘তুমি তো এক আশ্চর্য্য মানুষ হে’

সেলিম জাহান | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৮:৫৪ এএম, ৯ জানুয়ারি ২০২২ রবিবার

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

দক্ষিন আফ্রিকার কেপ টাউন শহরটি আফ্রিকা মহাদেশের নীচে একেবারে শেষ মাথায়। ঐ যে, উত্তমাশা অন্তরীপের কাছে। প্রথম সেখানে গিয়েছিলাম ১৯৯৭ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন উপস্হাপনের জন্যে। সে অনুষ্ঠানে উপস্তিত ছিলেন দক্ষিন আফ্রিকার তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি থাবো বেকী। শেষ গিয়েছিলাম বছর চারেক আগে - ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে।

১৯৯৭ সাল থেকে বিশ বছর বাদে ২০১৭ সালের যাত্রা অবশ্য ভিন্নতর। ২০১৭ সালে আমণ্ত্রিত হয়েছিলাম দু'টো স্মারক বক্তৃতা দেয়ার জন্যে। সেবারে মানব উন্নয়ন ও সক্ষমতা সমিতির বার্ষিক সভা বসেছিল কেপ টাউনে। সমিতির কর্ণধার বিশিষ্ট বন্ধু বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রাভি কানভুর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ঐ বছরের মাহবুবুল হক স্মৃতি বক্তৃতা দেয়ার জন্য : বিষয়বস্তু 'সবার জন্য মানব উন্নয়ন - গড় ও পরিমানের অতিক্রান্তিতে'।

সেই সঙ্গে আমন্ত্রণ এসেছিল নাদিন গর্ডিমার স্মৃতি সংস্হা থেকে কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালের নাদিম গর্ডিমার স্মারক বক্তৃতা দিতে। বিষয়বস্ত 'একবিংশ শতাব্দীর দক্ষিন আফ্রিকা'। উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ নাদিন গর্ডিমারের সঙ্গে আমার জানা শোনার কথা সম্ভবত: জানতেন এবং সেই সঙ্গে বিষয়বস্তুর কারনেও হয়তো আমাকে প্রাসঙ্গিক ব্যক্তি বলে ভেবেছিলেন।

নাদিন গর্ডিমারের সঙ্গে প্রথম দেখা ও পরিচয় ১৯৯৭ সালেই। না দক্ষিন আফ্রিকায় নয়, মালির রাজধানী বামাকো তে। জাতিসংঘের উদ্যোগে 'মানুষ ও মানুষের সংস্কৃতি' শীর্ষক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সন্মেলনে। এক অধিবেশনে তিন মূল বক্তার তিনজন বক্তার একজন ছিলেন নাদিন গর্ডিমার, একজন মালির বিখ্যাত গায়িকা উমু সাঙ্গারে এবং আমি।

ছোটখাটো ব্যক্তিত্বময়ী সুদর্শনা নাদিন গর্ডিমারকে দেখে খুব ভালো লেগেছিল। তার ৬ বছর আগে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সাহিত্যে। তাঁর কিছু কিছু সাহিত্যকর্ম পড়ার আছে আমার। চমৎকার বলেছিলেন তিনি। প্রীত হয়েছিলাম তাঁর সাথে পরিচিত হয়ে, কিন্ত সত্যিকারের মুগ্ধ হয়েছিলাম উমু সাঙ্গারের গান শুনে। কি গলা!

আমার বক্তব্য নাদিন গর্ডিমারের ভালো লেগেছিল-উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন অধিবেশন শেষে চায়ের টেবিলে। খোলাখুলি ভাবেই বলেছিলেন যে অর্থনীতিবিদ ও জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তার কাছ থেকে অমন সাহিত্য ও সংস্কৃতিধর্মী বক্তব্য তিনি আশা করেন নি। মৃদু ঠাট্টাও করেছিলেন এই বলে যে, বক্তৃতায় নোবেল পুরস্কার থাকলে তিনি আমাকে মনোনীত করতেন। আমি একাধারে যেমন বিব্রত হয়েছিলাম তেমনি আপ্লুতও হয়েছিলাম। অস্বীকার করবো না, আমার অহমিকাও স্ফীত হয়েছিল।

কথা মোড় ঘোরানোর জন্যে তাঁর সাহিত্য কর্মের কথা পাড়লাম। কি কি বই পড়ছি তাঁর, সেটা জানালাম। তিনি মৃদু হাসলেন। বোধহয় এ জাতীয় কথা তিনি প্রায়শই শোনেন। এক পর্যায়ে স্মিতহাস্যে বললেন, 'অতো প্রশংসা কোর না আমার। জানো তো দক্ষিন আফ্রিকায় আমাকে নিয়ে বিতর্ক আছে'। আমি সে বিতর্কের মূল কথা বললাম এবং তাঁর বই ধরে সে বিতর্কের প্রানকেন্দ্রে যেতে চাইলাম।

এবার তিনি নড়েচড়ে বসলেন। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। তারপর শুরু হল দীর্ঘ আলোচনা, দক্ষিন আফ্রিকার ইতিহাস, বর্ণবাদ, তাঁর বেড়ে ওঠা ঐ সমাজে, তাঁর চিন্তা-চেতনার বিবর্তন। কোথা দিয়ে যে দু'ঘন্টা কেটে গেল টেরই পেলাম। বিদায় নেবার জন্য যখন উঠে দাঁড়ালাম। তখন তিনি বললেন, 'দাঁড়াও তোমাকে একটা জিনিস দেই'। বলে তাঁর ঝোলা থেকে বার করলেন তাঁর বই - My Son's Story. কলমের মুখ খুলে বললেন, 'বইটা তোমাকে দিচ্ছি। বল, কি লিখবো?'

আমি হেসে বললাম, 'আপনি বরং বইটা আমার স্ত্রীকেই লিখে দিন। সে আমার চাইতেও আপনার বেশি ভক্ত এবং আপনার স্বাক্ষর করা বই পেলে আমার চাইতেও বেশি খুশি হবে'। তিনি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বললেন, 'তুমি তো এক আশ্চর্য্য মানুষ হে'। তারপর ওর নাম জেনে খসখস করে লিখে দিলেন একটানে। হাত মেলানোর পরে বললেন, 'আবার দক্ষিন আফ্রিকায় এলে যোগাযোগ কোর।'।

কয়েকবছর পরে জোহানেসবার্গ গিয়েছিলাম। ফোন করেছিলাম কেপ টাউনে। শরীর ভালো ছিল না নাদিন গর্ডিমারের। তবু ফোন ধরেছিলেন, কথা বলেছিলেন তিরিশ মিনিটের মতো। আমি তাঁকে 'মিস গর্ডিমার' বলে সম্বোধন করায় তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'তুমি আমাকে নাদিন বলেই ডাকতে পারো'। অভিভূত হয়েছিলাম। তাঁর নতুন লেখা সম্পর্কে বলেছিলেন, আমাদের নতুন প্রতিবেদনের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন, এমন কি আমাদের কন্যাদ্বয়েরও খোঁজ নিয়েছিলেন। আমি তাঁর মানবিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম।

আজ থেকে ৪ বছর আগে এই দিনে-অর্থাৎ ২০১৭ সালের ৮ জানযারী নাদিন গর্ডিমার স্মারক বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমি যখন কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন ‘নাদিন’ বলেই তাঁকে আমি আখ্যায়িত করেছিলাম। কারন ও নামেই তাঁকে সম্বোধন করতে তিনি বলেছিলেন। তা না করলে হয়তো তিনি অন্য কোন জগত থেকে বলে উঠবেন, 'তুমি তো এক আশ্চর্য্য মানুষ হে' - যদিও সম্পূর্ণ ভিন্নতর প্রেক্ষিতে।

সেলিম জাহান: অর্থনীতিবিদ ও লেখক।