ঢাকা, বুধবার ২৪, এপ্রিল ২০২৪ ১২:০৪:৫৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
‘পদ্মশ্রী’ গ্রহণ করলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কাতার-বাংলাদেশ ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই কয়েক ঘণ্টায় ৮০ বারেরও বেশি কেঁপে উঠল তাইওয়ান ঢাকা থেকে প্রধান ১৫টি রুটে ট্রেনের ভাড়া যত বাড়ল মাকে অভিভাবকের স্বীকৃতি দিয়ে নীতিমালা করতে হাইকোর্টের রুল আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করেছি : শেখ হাসিনা নতুন করে ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি

তেভাগা আন্দোলনের পুরোধা ইলা মিত্রর মৃত্যুদিন আজ

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৫:০৯ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২২ বৃহস্পতিবার

ইলা মিত্র

ইলা মিত্র

তেভাগা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং সংগ্রামী কৃষক নেতা ইলা মিত্র’র মৃত্যুদিন আজ ১৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার। বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। ইলা মিত্র ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।

ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় ইলা মিত্র ছিলেন ইলা সেন। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বৃটিশ সরকারের অধীন বাংলার একাউন্টেন্ট জেনারেল। তাদের আদি নিবাস ছিল তৎকালীন যশোরের ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকুরির সুবাদে তারা সবাই কলকাতায় থাকতেন।

কলকাতায় শহরেই তিনি বেড়ে ওঠেন, লেখাপড়া করেন কলকাতার বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে স্নাতক শ্রেণীতে বি.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। পরে ১৯৫৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন।

কৈশোরে তিনি খেলাধুলায় তুখোড় ছিলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্য জুনিয়র অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। সাঁতার, বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায়ও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনিই প্রথম বাঙালি মেয়ে যিনি ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক বাতিল হয়ে যাওয়ায় তার অংশগ্রহণ করা হয়নি। খেলাধুলা ছাড়াও গান, অভিনয়সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী।

ইলা সেন যখন বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বি.এ সম্মানের ছাত্রী তখন থেকেই তার রাজনীতির সাথে পরিচয় ঘটে। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার রাজনীতিতে প্রবেশ। সময়টা ছিল ১৯৪৩ সাল, ইলা সেন কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হলেন। হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে ঐ বছরই মহিলা সমিতি আন্দোলন শুরু করে। সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি সনাতনপন্থীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনেক প্রচার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নামক সংগঠনের মাধ্যমে নারী আন্দোলনের এই কাজ করতে করতে তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।

১৯৪৫ সালে ইলা সেনের বিয়ে হয় দেশকর্মী কমিউনিস্ট নেতা রমেন্দ্র মিত্রের সাথে। রমেন্দ্র মিত্র মালদহের নবাবগঞ্জ থানার রামচন্দ্রপুর হাটের জমিদার মহিমচন্দ্র ও বিশ্বমায়া মিত্রের ছোট ছেলে। বিয়ের পর বেথুনের তুখোর ছাত্রী ইলা সেন হলেন জমিদার পুত্রবধু ইলা মিত্র। কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন শ্বশুরবাড়ি রামচন্দ্রপুর হাটে। হিন্দু রক্ষণশীল জমিদার পরিবারের নিয়মানুসারে অন্দরমহলেই থাকতেন ইলা মিত্র। তখনও তিনি মা হননি তাই হাতে অফুরন্ত অবসর। এই বন্দী জীবনে মুক্তির স্বাদ নিয়ে এলো গ্রামবাসীর একটি প্রস্তাব। রমেন্দ্র মিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়ির কাছেই কৃষ্ণগোবিন্দপুর হাটে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল খোলা হলো। গ্রামের সবাই দাবি জানালেন তাদের নিরক্ষর মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবার দায়িত্ব নিতে হবে বধুমাতা ইলা মিত্রকে। বাড়ি থেকে অনুমতিও মিললো। কিন্তু বাড়ির চার'শ গজ দূরের স্কুলে যেতে হয় গরুর গাড়ি চরে। মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়ে স্কুলটি শুরু হলেও ইলা মিত্রের আন্তরিক পরিচালনায় তিনমাসের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০-এ। আর এর মধ্যে তিনি হেঁটে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি লাভ করতেও সক্ষম হন। সংগ্রামী নেত্রী এভাবেই অন্দর মহল থেকে বের হয়ে এসে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন বৃহত্তর সমাজ সেবার কাজে। হয়ে ওঠেন এলাকার রানীমা। এ সময়ে তিনি স্বামী রমেন্দ্র মিত্রের কাছে জমিদার ও জোতদারের হাতে বাংলার চাষীদের নিদারুণ বঞ্চনা শোষণের কাহিনী শোনেন। আরো শোনেন এই শোষণের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের প্রচেষ্টার কথা।

কমিউনিস্ট রামেন্দ্র মিত্র এর আগেই জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য ও মোহ ত্যাগ করে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। রমেন্দ্র মিত্র, ইলা মিত্রকে তাদের কাজে যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। ছাত্রী জীবনেই ইলা মিত্র কমিউনিস্ট আদর্শের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাই স্বামীর আদর্শ ও পথ চলার সাথে সহজেই নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছিলেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন ইলা মিত্র।

তেভাগা আন্দোলন ও ইলা মিত্র : তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে হলে সে সময়ের ভূমি ব্যবস্থা বিষয়ে জানা প্রয়োজন। বাংলার গ্রামীণ সমাজে বৃটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত ভূমির মালিক ছিলেন চাষীরা। মোগল আমল পর্যন্ত তারা এক-তৃতীয়াংশ বা কখনো কখনো তার চেয়েও কম ফসল খাজনা হিসাবে জমিদার বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রদান করতেন। বৃটিশ শাসন আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষীদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা জমির পরিমাণ ও উর্বরতা অনুযায়ী বৃটিশদের খাজনা দিত। জমিদারদের সাথে ফসল উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। এরা পত্তনি প্রথার মাধ্যমে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নিত। এই জোতদার শ্রেণী কৃষকের জমি চাষ তদারকি ও খাজনা আদায়ের কাজ করতো। ফসল উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষকেরা বহন করলেও যেহেতু তারা জমির মালিক নন সে অপরাধে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো 'আধিয়ারী'। জোতদারি ও জমিদারি প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য জোতদাররা এদের দাসের মতো ব্যবহার করে। উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে একসময় কৃষককে বাধ্য করা হয় অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে। ফলে কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সর্বস্বান্ত হয়ে এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক পরিণত হন আধিয়ার আর ক্ষেত মজুরে। জমিদার-জোতদারদের এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় 'সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি'। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় 'ফাউন্ড কমিশন'। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষীদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়া জনসাধারণের কাছ থেকে হাটের 'তোলা' ও 'লেখাই' সহ নানা কর আদায় করা হতো। এসব বন্ধের জন্য আন্দোলন জোরদার হয়। চল্লিশের দশকে এসব আন্দোলনেও ইলা মিত্র নেতৃত্ব দেন।

১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ বাংলা ১৩৫০ সনে সমগ্র বাংলায় দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত। এ দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকের ওপর শোষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এসময়কার অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে মরিয়া হয়ে ওঠে শোষিত কৃষকেরা। তিনভাগের দুইভাগ ফসল কৃষকের এই দাবি নিয়ে বেগবান হয় তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে দিনাজপুরে কমরেড হাজী দানেশের প্রচেষ্টায় সূচিত হয় এক যুগান্তকারী তেভাগা আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি প্রান্তিক চাষীদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে জোরদার করতে থাকে। পার্টি থেকে রমেন্দ্র মিত্রকে গ্রামের কৃষক সমাজের মধ্যে কাজ করার দায়িত্ব দিয়ে কলকাতা থেকে নিজ গ্রাম রামচন্দ্রপুর হাটে পাঠানো হয়। এ সময় স্বামীর সাথে ইলা মিত্র সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কৃষক সংগঠনের সাথে যুক্ত হন।

১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টি দাঙ্গা বিদ্ধস্ত এলাকায় সেবা ও পুনর্বাসনের কাজ করতে এগিয়ে আসে। এসময় ইলা মিত্র নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্স্ত গ্রাম হাসনাবাদে পুনর্বাসনের কাজে চলে যান। তখন নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করছিলেন। ইলা মিত্রের এই সাহসী পদক্ষেপ সে সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর মিত্র পরিবারের জমিদারি অঞ্চল রামচন্দ্রপুর হাট পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ হিন্দু পরিবার সংখ্যালঘূ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভারতে চলে যায়। কিন্তু ইলা মিত্রের শাশুড়ি এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে ইলা মিত্র ও রমেন্দ্র মিত্র পূর্ব-পাকিস্তানেই রয়ে গেলেন। পাকিস্তান হবার পরও তেভাগা আন্দোলন অব্যাহত থাকে। পূর্ব-পাকিস্তানের অনেক স্থানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন হয়। মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন হলে তারা কঠোর হাতে এই আন্দোলন দমন করে। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পার্টির শীর্ষ স্থানীয় হিন্দু নেতাদের প্রায় সকলকেই দেশ ছাড়া করা হয়। সরকারের এই দমননীতির ফলে কমিউনিস্ট ও কৃষক আন্দোলনের নেতারা আত্মগোপন করে কাজ করতে থাকেন। ইলা মিত্র এবং রমেন্দ্র মিত্রও নাচোলের চণ্ডীপুর গ্রামে আত্মগোপন করে থাকেন।

লেখালেখি : জেলখানার চিঠি, হিরোশিমার মেয়ে, মনে প্রাণে-২ খণ্ড, লেনিনের জীবনী, রাশিয়ার ছোট গল্পসহ বেশ কয়েকটি রুশ গ্রন্থ অনুবাদ করেন ইলা মিত্র।

পুরস্কার : হিরোশিমার মেয়ে বইটির জন্য তিনি 'সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু' পুরস্কার লাভ করেন। অ্যাথলেটিক অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ভারত সরকার তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মানে "তাম্রপত্র পদক" এ ভূষিত করে সম্মানিত করে।

সূত্র : উইকিপিডিয়া