ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৮, এপ্রিল ২০২৪ ২২:৪৬:৪৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
জাতির পিতা বেঁচে থাকলে বহু আগেই দেশ আরও উন্নত হতো টাইমের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় বাংলাদেশের মেরিনা নান্দাইলে নারী শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা তীব্র গরমে জনজীবনে দুর্ভোগ, বাড়ছে জ্বর-ডায়রিয়া কারাগার থেকে সরিয়ে গৃহবন্দী অবস্থায় সুচি কৃষকরাই অর্থনীতির মূল শক্তি: স্পিকার মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নজর রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

প্রসঙ্গ শিশুসাহিত্য: কবিতা পুত্র হলে ছড়া তার পিতা

জাহাঙ্গীর আলম জাহান | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:৪৯ এএম, ১৯ নভেম্বর ২০২১ শুক্রবার

জাহাঙ্গীর আলম জাহান

জাহাঙ্গীর আলম জাহান

সাহিত্য করা সবার কাজ নয়। সবাই করেও না। যারা করে তারা সংখ্যালঘু। কবি বা সাহিত্যিকের সংখ্যা জনসংখ্যার তুলনায় একেবারেই সামান্য। সামান্যরাই সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু হয়েও কবিরা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করেন। একজন কবি বা লেখক তার সাহিত্যকর্মে সত্য-সুন্দরের কথা যেমন বলেন, তেমনি ধারণ করেন সমগ্র মানবগোষ্ঠির স্বপ্নকেও। সংখ্যা-বিচারে কবিরা নগণ্য হয়েও এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি। এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে তাদের কথা যারা সৃষ্টিশীল কাজ করেন, অথচ সংখ্যার বিচারে হাতেগোনা, একেবারেই নগণ্য। সেই নগণ্যদের হাতেই নির্মিত হয় সুন্দরের স্বপ্ন। এরা স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দ্যাখান। তাদের স্বপ্নের ডানায় ভর করেই এগিয়ে যায় সভ্যতা, এগিয়ে যায় সমাজ। নান্দনিক সৌন্দর্যের উপমা তো তৈরি করেন কবিরাই। যুগে যুগে কবিদের হাতেই তৈরি হয়েছে সুন্দরের আখ্যান। আমরা প্রতিদিন কথনে, বচনে কিংবা লেখায় যে সকল শব্দ ব্যবহার করি, কবিরা তা দিয়েই নির্মাণ করেন কবিতার শরীর। অর্থাৎ কবিতার জন্য শব্দ হচ্ছে প্রথম উপাদান। শব্দের মালা গেঁথেই কবির হাতে রচিত হয় কবিতার পঙক্তি। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত শব্দই কবির ব্যবহার্য শব্দ। অথচ সেই সাধারণ শব্দটি যখন কবি তার কবিতায় গেঁথে দেন তা অন্যরকম ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়। একটি শব্দই কবিতায় হাজারো শব্দের দ্যোতনা তৈরি করে। শব্দটি নিজেই হয়ে ওঠে বাঙময়, ব্যাপক অর্থের সমষ্টি। এখানেই সাধারণ মানুষের সাথে একজন কবির তফাৎ। সংখ্যালঘু হয়েও এখানেই কবি অনন্য, অসাধারণ। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, কবি কে? এই প্রশ্ন অনেক পুরনো। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বহু আগেই প্রশ্নটির জবাব এভাবে দিয়ে রেখেছেন, শব্দের সঙ্গে শব্দের বিবাহসংঘটনের ঘটক মাত্রেই কবি নন। কবি হবার জন্য কল্পনাশক্তি অত্যাবশ্যক, সে-কথা খুবই সত্য। একজন কবি তার কল্পনাশক্তির মাধ্যমেই সামান্যকে অসামান্য করে তোলেন। এ-রকম ভুরিভুরি নজির বিশ্বসাহিত্যে রয়েছে।
কবি শুধু কবিতাই লেখেন না, ছড়াও লেখেন। যারা ছড়া লেখেন তারা মূলত কবিতাই লেখেন। কবিতার আদি প্রকরণ হচ্ছে ছড়া। সুতরাং ছড়ালেখককে নিছক ছড়াকার বলে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। ছড়াকাররাও কবি। তাদেরকে 'কবি' অভিধা দিলে কবিতার কোনো ক্ষতি নেই। অথচ ছড়ালেখককে কবির মর্যাদা দিতে অনেকেরই আপত্তি। এ আপত্তির যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবুও কবির বারান্দা থেকে ছড়ালেখককে সরিয়ে দেওয়ার অযৌক্তিক চেষ্টা চলছে। এটি সঙ্গত নয়। সঙ্গত নয় কবি ও কবিতার স্বার্থেই।
ছড়া হচ্ছে সাহিত্যের সর্বপ্রাচীন উপাদান। লৌকিক ছড়ার হাত ধরেই কবিতার উদ্ভব। কবিতা যদি পুত্র হয়, ছড়া তার পিতা। পিতাকে অস্বীকার করলে পুত্রের পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সুতরাং ছড়ার প্রতি অবজ্ঞা দেখানো সুরুচি-বিরোধী। অবজ্ঞা পরিহার করলে ছড়া এবং কবিতা দুটোরই মঙ্গল। 
সমাজের প্রচলিত লোকছড়াগুলো মূলত শিশুমনোরঞ্জনি কথামালার সমষ্টি। ঘুমপাড়ানি ছড়াই ছিল লোকছড়ার মূল বৈশিষ্ট্য। তবে শিশুতুষ্টির মোড়কে অনেক লোকছড়ায় অনিয়ম-অনাচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ ধ্বনিত হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। খুব কৌশলে একটু ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে অনিয়ম-অসঙ্গতির কথা লোকছড়ায় বলা হয়। অথচ সাদা চোখে এগুলোকে শিশুমনোরঞ্জনি ছড়া বলেই অনেকে ভেবে থাকেন। 
খোকন খোকন ডাক পাড়ি
খোকন গেছে কার বাড়ি
আয় রে খোকন ঘরে আয়
দুধমাখা ভাত কাকে খায়।
উপরের ছড়াটিকে শিশু-উপযোগী লোকছড়া বলেই কেউ কেউ ধরে নিয়েছেন। কিন্তু একটু গভীর বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখলে এর মধ্যে আমরা কঠিন বক্তব্যের আভাস লক্ষ করি। খোকনকে তার মা ডাকছে। ডাকছে কেন? দুধভাত খাবার জন্য। না খেলে কী হবে? কাক এসে সব ভাত খেয়ে যাবে। ছড়ার এই মা নিছক কোনো মা নয়। এই মা হচ্ছে দেশমাতা। আর খোকন হচ্ছে দেশের জনগণ। দুধভাত মানে দেশের সম্পদ। আর কাক হচ্ছে সেই অশুভ শক্তি বা বর্গিদস্যু; যারা অনেকদিন লুণ্ঠন করেছে আমাদের সম্পদ। দেশমাতা তাই দেশের জনগণকে বর্গিদস্যুর হাত থেকে দেশের সম্পদ রক্ষার জন্য জাগরণের আহ্বান জানাচ্ছে। এই হচ্ছে এ ছড়ার মূল বক্তব্য। একে নিছক শিশুমনোরঞ্জনি ছড়ার পর্যায়ে বিবেচনা করা ঠিক নয়। একই রকম আরও অনেক ছড়া আমাদের লোকসমাজে ছড়িয়ে আছে। যেমন,
খোকা ঘুমুল পাড়া জুড়ুল বর্গি এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব কিসে
ধান ফুরুল পান ফুরুল খাজনার উপায় কী
আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।
এ ছড়ায় বর্গির কথা সরাসরিই বলা হয়েছে। কিন্তু ‘বুলবুলি’ প্রতীকে যার কথা বলা হয়েছে- কে সে? এই বুলবুলি হলো জোতদারের লেঠেল। যারা বকেয়া খাজনার দায়ে জোর করে কৃষকের ফসল কেড়ে নিত। ঘরে আহার্য নেই। তাই পাওনাদারের দেনা শোধের জন্য ‘রসুন বোনা’ বা আবার ফসল ফলানোর অজুহাত দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই প্রতীকী ব্যঞ্জনায় বঞ্চনার কথা, বেদনার কথা আমাদের লোকছড়ায় প্রকাশ পেয়েছে। 
যাকে আমরা লোকছড়া বলছি প্রকৃত অর্থে এগুলোই আমাদের আদি কবিতা। সৃষ্টিলগ্নে কবিতার আদল ছিল পদ্যময়। অন্ত্যমিল ছিল কবিতার ভূষণ। গদ্যছন্দের আবিষ্কার তো সেদিনের কথা। ছড়ার বক্তব্যকে কীভাবে আরও বিমূর্ত করা যায় সে ভাবনা থেকেই গদ্যছন্দের উদ্ভব। উদ্ভব আধুনিক কবিতারও। ছড়ার শরীর ভেঙেই সৃষ্টি হয়েছে কবিতার প্রকরণ। তাই যারা কবিতা লেখেন তারা যেমন কবি, যারা ছড়া লেখেন তারাও কবি। অর্থাৎ ঘুরেফিরে সেই কথাই আসে, কবিতা পুত্র হলে ছড়া তার পিতা।
ছড়া এখন দ্বি-ধারায় বিভক্ত। একটি নিতান্তই শিশুতোষ ধারা, অন্যটি বক্তব্যধর্মী ধারা। শিশুতোষ ধারায় ফুল-পাখি-নদী-চাঁদ-প্রকৃতিই মূল উপজীব্য। আবার উপদেশধর্মী শিশুছড়ারও উপস্থিতি পাওয়া যায়। বিপরীতে বক্তব্যধর্মী ছড়ায় পাওয়া যায় ঘটমান অনিয়ম-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তীব্র ঝাঁজ। এ ধারার মধ্যে খোঁচাত্মক ও স্যাটায়ারধর্মী ছড়াও একটি বিশেষ প্রকরণ। এগুলোকে অনেকে সমকালীন কিংবা রাজনৈতিক ছড়া বলেও আখ্যায়িত করেন। 
শিশুতোষ ছড়ার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিশুমনে আনন্দের সঞ্চার করা। এ ধরনের ছড়া যারা লিখবেন তাদের মধ্যে শিশুর মনস্তত্ত্ব বোঝার যোগ্যতা থাকতে হবে। শুধু মনস্তত্ত্ব বুঝলেই চলবে না; শিশুতোষ ছড়ায় সহজ বাক্য ও সহজ শব্দের প্রয়োগ ঘটানোর মানসিকতাও থাকতে হবে। কঠিন, দুর্বোধ্য এবং অপ্রচলিত শব্দ শিশুদের ছড়ায় না থাকাই শ্রেয়। যে শব্দের সাথে শিশুদের পরিচয় নেই কিংবা তারা উচ্চারণ করতে অক্ষম, সে-রকম শব্দ ছড়ায় ব্যবহার করলে সে ছড়া শিশুরা পড়তে চাইবে না। জোর করে পড়াতে চাইলে তাদের মধ্যে অযথা ছড়াভীতি তৈরি হবে। তাই যথাসাধ্য সহজ ও প্রচলিত শব্দই শিশুতোষ ছড়ায় ব্যবহার করা উচিত। এছাড়া যুক্তবর্ণ-নির্ভর শব্দও শিশুর জন্য উপযোগী নয়। ‘ঙক্ষ’ ‘ঙ্ঘ’ ‘ণ্ড’ বা এ জাতীয় যুক্তবর্ণ দেখলে শিশুরা ভয় পায়। এসব বর্ণের উচ্চারণ শিশুর জন্য একটু কঠিনই বটে। তাই শিশুদের জন্য গল্প-ছড়া-রসকথা যা-ই লেখা হোক-না কেন তাতে এ জাতীয় যুক্তবর্ণ পরিহার করতে পারলে লেখাটি শিশুদের কাছে সুখপাঠ্য হতে পারে। রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের লেখা ‘বাকবাকুম পায়রা/মাথায় দিয়ে টায়রা/বউ সাজবে কাল কি/চড়বে সোনার পালকি’ অথবা সুকুমার রায়ের লেখা ‘বাবুরাম সাপুড়ে/কোথা যাস বাপু রে/আয় বাবা দেখে যা/দুটি সাপ রেখে যা’ ছড়া দুটি শিশুরঞ্জনি ছড়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ দু’টি ছড়া পড়ে শিশুকালে আমরা যেমন আনন্দ পেয়েছি, আজকের শিশুরাও একইরকম আনন্দ উপভোগ করে। 
কারণ কী? কারণ একটিই; তা হচ্ছে দুটো ছড়াই সুখপাঠ্য এবং সাবলীল। পড়তে গেলে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে পড়ে ফেলা যায়। ছড়া দুটোতে নেই কোনো অপ্রয়োজনীয় শব্দের বাহুল্য অথবা অপ্রচলিত ও খটমটে শব্দের উপস্থিতি। এমনকি উচ্চারণ-দুঃসাধ্য যুক্তবর্ণও এ দুটো ছড়ায় ব্যবহার করা হয়নি। এ-রকম আরও অজস্র শিশুরঞ্জনি ছড়ার উদাহরণ দেওয়া যাবে; যেগুলো শিশুরা পড়ে মজা পায় এবং বারবারই পড়তে চায়। সুতরাং শিশুতোষ ছড়া লেখার সময় ছড়া রচয়িতাকে এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। তা নইলে হাজার ছড়া লিখেও শিশুর মনোজগতে ঠাঁই পাওয়া যাবে না; অথবা প্রকৃত শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও নিজের অবস্থানকে সংহত করা সম্ভব হবে না। 
গত কয়েক দশক ধরে ছড়ার প্রকরণে সমকালীনতার প্রভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠেছে। ছড়া এখন শুধুই শিশুতুষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বক্তব্যধর্মী ঝাঁঝালো ছড়ার দিকেই এখন ছড়া রচয়িতাদের মনোযোগ বেশি। সমাজের নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছড়া যেন তীক্ষè তরবারির মতোই ঝল্সে উঠছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ ধরনের ছড়ার জন্য পৃথক কলামও এখন প্রকাশ করা হয়; যা ছড়াসাহিত্যিকদের প্রতি পত্রিকাগুলোর আনুকূল্য বা পৃষ্ঠপোষকতার মানসিকতাকেই প্রমাণ করে। এসব কলামে সারা দেশের অনেক ছড়াকার ছড়া লিখছেন। সব ছড়াই মানের দিক থেকে উৎরে যাচ্ছে সেটি বলা যাবে না। কারণ সমকালীন ছড়া যদি একেবারেই কালিক বা স্থানিক হয়ে যায় সে ছড়ার আবেদন কখনোই স্থায়ী হয় না। একটি সমকালীন ছড়াকে কালিক ও স্থানিক আবহের বাইরে শাশ্বত চারিত্র্যে উত্তীর্ণ করার কৌশল প্রযুক্ত করতে হবে। তবেই ছড়াটি সমকালীন হয়েও হয়ে যাবে চিরন্তন এবং তার আবেদনও হবে শাশ্বত ও সর্বকালীন। কবি আল মাহমুদের ‘ঝালের পিঠা’ ছড়ায় আমরা সেই প্রবণতা লক্ষ করি। যেমন-
ঝালের পিঠা ঝালের পিঠা/কে রেঁধেছে কে/
এক কামুড়ে একটুখানি/আমায় এনে দে।/
কোথায় পাব লঙ্কাবাটা/কোথায় আতপ চাল/
কর্ণফুলির ব্যাঙ ডাকছে/হাঁড়িতে আজকাল।
এ ছড়ায় সহজ-সরল শিশুরঞ্জনি শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে, উপস্থাপনার কৌশলটিও শিশুমনস্তত্ত্ব-নির্ভর। তা সত্ত্বেও ছড়ার মধ্যে একটি পরাবাস্তব সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। যে হাঁড়িতে ভাতের চাল ফোটার কথা, তাতে যদি ব্যাঙের ডাক শোনা যায় তাহলে বুঝতে হবে, ছড়াটি শিশুতোষের আঙ্গিকে তৈরি হলেও এর মধ্যে কঠিন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। দুর্ভিক্ষ আর দারিদ্র্যের চিত্রই এ ছড়ার মূল উপজীব্য। অন্যদিকে সুকুমার বড়–য়ার ‘শেয়ালমন্ত্রী’ ছড়াটির কথাও আমরা স্মরণ করতে পারি-
শেয়াল নাকি লোভ করে না/পরের কোনো জিনিসটার/
কী পরিচয় দিল আহা/কী সততা, কী নিষ্ঠার/
তাই সে হলো বনের মাঝে/এডুকেশন মিনিস্টার।
উপরের দুটো ছড়াই সরল বাক্য দিয়ে শুরু হয়েছে। অথচ ছড়ার শেষের দিকে একটি অদ্ভুত মোচড় আমরা দেখতে পাই। এই মোচড়কেই বলা হয় ছড়ার ম্যাজিক। আধুনিক ও সমকালীন ছড়ায় এ-রকম ম্যাজিক দেখানোটা খুবই জরুরি। যারা সেটা যত ভালোভাবে পারেন তারাই হন তত ভালো ছড়াশিল্পী। তাই ছড়া লেখার সময় এ ধারণাটি মাথায় রাখা একান্ত কর্তব্য। ক্ষণস্থায়ী আবেদনের লেখা লিখলে তা একসময় সাহিত্যে টিকবে না। কাজী নজরুলের সেই উক্তিটি সকলের মনে রাখতে হবে, ‘যাহা বিশ্বসাহিত্যে স্থান পায় না, তাহা স্থায়ী সাহিত্য নহে। খুব জোর দু’দিনের আদর লাভের পর তার মৃত্যু হয়’ (দ্রষ্টব্য: বাঙলা সাহিত্যে মুসলমান)। 
একশ্রেণির মানুষ আছেন যারা ছড়া রচনার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব খুঁজে পান না। তারা মনে করেন, সাহিত্যের সকল শাখার মধ্যে সবচেয়ে সহজতর শাখা হচ্ছে ছড়া। ছড়া পড়া যেমন সহজ, ছড়ার বক্তব্য উপলব্ধিতে যেমন গভীর চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না, তেমনি ছড়া রচনাও বুঝি অতি সাধারণ একটি কাজ। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। ছড়া যত সহজে পড়ে ফেলা যায় কিংবা যত সহজে ছড়ার বক্তব্য অনুধাবন করা সম্ভব, একটি প্রকৃত ছড়া রচনা করা ঠিক ততটাই কঠিন। গতানুগতিক ধারায় শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাক্যের শেষে ধ্বনিগত মিল দেওয়া হয়তো সহজ, কিন্তু প্রাঞ্জল কৌশলে ছড়ার শেষে মোচড়ের খেলা দেখানো অথবা ম্যাজিক সৃষ্টি করা খুবই কঠিন। আমরা এ জাতীয় ছড়াকেই প্রকৃত ছড়ার মর্যাদায় বিবেচনা করি।
পূর্বেই বলা হয়েছে, ছড়ার নির্যাস থেকে কবিতার উদ্ভব। অর্থাৎ ছড়া আর কবিতা একে অপরের পরিপূরক। আঙ্গিকগত বৈপরীত্য ছাড়া ছড়া আর কবিতার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য বা বিরোধ নেই। ছড়া লিখতে যেমন কঠিন অধ্যবসায় প্রয়োজন, কবিতার ক্ষেত্রেও তার বিকল্প নেই। ছড়ার মতো কবিতাও শিল্পের একটি কঠিন স্তর। এ সমাজে কবিতা লেখাকেও অনেকে সহজ মনে করে। অনুভূতির কিছু সুবিন্যস্ত বাক্য সাজালেই কবিতা হয়ে যায় না। কবিতার মধ্যেও থাকতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ এবং উচ্ছ্বাস। থাকতে হবে আলোছায়াময় মূর্ত বা বিমূর্ত ভাবাবেগ। ছন্দ-উপমা-উৎপ্রেক্ষা, শব্দের যথার্থ প্রয়োগ আর বক্তব্যের গভীরতাও কবিতার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। সব মিলিয়ে স্নিগ্ধ ও সাবলীল উপস্থাপনায় কবিতার শরীর নির্মাণ করতে হয়। এসবের যথাযথ মিশেলে একটি সুখপাঠ্য ও অর্থবহ কবিতা রচনা করা খুব সহজ কাজ নয়। সুতরাং কবিতাকেও সহজ ভাবার কোনো কারণ নেই। 
উঠতি বয়সে কবিতা লেখার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে প্রেমে বাড়তি সুবিধা পাবার আশায় অনেক তরুণ-তরুণীই একসময় কাব্যপ্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এটি ক্ষণিকের মোহ। মোহ কেটে গেলে তারা আর কবিতার পথে হাঁটে না। প্রৌঢ়ত্বে এসে এ জাতীয় ব্যক্তিরাই বলেন, ‘একসময় আমিও লিখতাম’। এদের এক সময়ের লেখা যে মৌলিক কোনো লেখা নয় এবং এগুলো যে কবিতার নামে সস্তা প্রেমের কচকচানি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ধ্যানে-অনুধ্যানে যার মধ্যে কবিতার বসতি নেই তিনি যত লেখাই লিখুন, সাহিত্যের মূল্যায়নে সে লেখা অর্থহীন বাক্যের সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনো কোনো ছড়ালেখকের মধ্যেও এ প্রবণতা কাজ করে। গল্প-উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যেও এ-রকম কিছু লোকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, সাহিত্য সিজনাল কোনো বিষয় নয়। মৌসুম এলে সাহিত্য করব, মৌসুম চলে গেলে পরের মৌসুমের জন্য অপেক্ষায় থাকব- এ মানসিকতা দিয়ে বাণিজ্য হতে পারে; সাহিত্য নয়। 
ছড়া ও কবিতার পারস্পরিক মেলবন্ধনে আমাদের সাহিত্য থেকে এ জাতীয় সিজনাল লেখকদের অনাচার দূর করা সম্ভব। মৌলিক সৃষ্টির প্রয়োজনে শিল্পের উপযুক্ত চর্চাই পারে এসব অনাচার থেকে সাহিত্যকে রক্ষা করতে। ছড়া এবং কবিতার মাধ্যমেই গড়া যেতে পারে সেই প্রতিরোধের দেয়াল। সাহিত্য করে যারা অমরত্ব প্রত্যাশা করেন তাদেরও মনে রাখতে হবে, অমরত্ব থাকে সৃজনশীলতার মধ্যে, শ্রেয়বোধের মধ্যে। যেখানে সৃজনশীলতা আছে সেখানেই অমরত্বের স্থায়িত্ব। সুতরাং যোগ্য নির্মাণকর্মীর মতো মৌলিক সাহিত্য নির্মাণের পথই হতে পারে স্থায়িত্ব অর্জনের পথ। সে পথে হাঁটতে চাইলে বিনাপ্রশ্নে মৌলিকত্বের পথে আসতে হবে। মৌলিকত্ব অর্জনের জন্য পড়াশুনা ও অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। না পড়ে যারা খ্যাতির শিখড় স্পর্শ করতে চান তারা শুধু বোকাই নন; বোকার হদ্দ। এই বোকারাই বোধহয় ছড়া আর কবিতার মধ্যে বিভাজন-রেখা তৈরি করে ছড়াকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান। যোগ্য কবিতা লেখক ছড়াকে কখনও অযোগ্য ঘোষণা করেন না। তারা কবিতার চাষ করলেও ছড়াই যে কবিতার প্রথম স্তর সেটি স্বীকার করতে কার্পণ্য করেন না। সে কারণেই তারা জানেন এবং মানেন যে, কবিতা পুত্র হলে ছড়া তার পিতা।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: লেখক ও ছাড়াশিল্পী।