বীর মুক্তিযোদ্ধা তাহরীমা চৌধুরীর অজানা কাহিনি
অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪প্রকাশিত : ০৪:২১ পিএম, ২ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার
পরিবারসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা তাহরীমা চৌধুরী। পুরাতন ছবি।
১৯৭১ সাল, দেশ উত্তাল। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে। কিশোরী তাহরীমা চৌধুরী, বয়স মাত্র ১৪ বছর। চারদিকে বাঙালির কঠিন অবস্থা দেখে তার মন কেঁদে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে উৎসর্গ করেন৷ যোগ দেন সেবাকেন্দ্রে। হাসপাতালে দেখা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত দেহের সেই করুণচিত্র আজও ভেসে ওঠে চোখের কোণে৷
ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় ১৯৫৬ সালের ২০ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন তাহরীমা চৌধুরী৷ বাবা শহীদুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন স্কুল শিক্ষক৷ মায়ের নাম আমেনা খাতুন৷
১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন তাহরীমা৷ ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হত্যা-নির্যাতন শুরু হওয়ার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে থাকে৷
যুদ্ধের সময়ের ভয়ঙ্কর দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাহরীমা চৌধুরী বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে যখন ছিলাম তখন দেখেছি–বৃষ্টির মতো আকাশ থেকে গুলিবর্ষণ করা হতো৷ বাড়ির চালগুলোতে ছোট ছোট ছিদ্র হয়ে হয়ে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেত৷ এরপর একদিন আমাদের গ্রামে পাক বাহিনী হামলা করে। গোটা গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়৷ আর পিপিলিকার মতো লাইন ধরে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু গ্রামের দিকে কিংবা ভারত সীমান্তের দিকে ছুটতে থাকে৷’
তিনি আরও বলেন, ‘লোকে প্রাণ বাঁচাতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামের দিকে ছুটতো, এমন দৃশ্য দেখতাম সব সময়৷ এমনও অনেক দিন গেছে, ভাত খেতে বসেছি....এমন সময় পাক সেনারা গ্রামে আসছে খবর পেয়ে খাওয়া ফেলে পালিয়ে গেছি। পালিয়ে গিয়ে হয়ত অন্য কোনো বাড়িতে অথবা অন্য গ্রামে চৌকির নিচে লুকিয়ে থেকেছি৷ তবুও আমরা দেশে থাকার অনেক চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে৷'
শেষ পর্যন্ত পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে কীভাবে আগরতলা যান এ প্রসঙ্গে তাহরীমা চৌধুরী বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতের ঘটনা জানার পর আমাদের ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া শহর একদম নীরব হয়ে যায়৷ শহর ছেড়ে সবাই গ্রামের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে৷ তখন বাবাও আমাদের নিয়ে আখাউড়ার গঙ্গাসাগর গ্রামে চলে যান৷ কিন্তু সেখানে গিয়েও দেখি গঙ্গাসাগর, আখাউড়া, কসবা এলাকাগুলোতে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে৷ সে সময় আগুনের লেলিহান শিখা, বুলেট এবং গোলার প্রচণ্ড আওয়াজ....সে কি কঠিন অবস্থা তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়৷’
তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় বাবা আমাদের নিয়ে আগরতলা চলে যান৷ সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আমতলী নামে একটি গ্রামে পৌঁছাই আমরা৷ সেখানে এক হিন্দু বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চাই। এ সময় একজন নারী এসে বলেন, আপনারা যদি রাতে থাকতে চান, তাহলে এই গোয়াল ঘরে থাকতে পারেন৷ গোয়ালের একদিকে তিনটি গরু বাধা ছিল৷ আর অন্যদিকে কিছুটা জায়গা ফাঁকা৷ আমি, আমার তিন বোন, ছোট ভাই এবং বাবা-মা ওই গোয়াল ঘরে রাত কাটাই৷ পরের দিন আমরা আগরতলার হাঁপানিয়া শিবিরে গিয়ে উঠি৷’
এই শিবিরে থাকতে থাকতেই একদিন নারী নেত্রী ফোরকান বেগম এবং মিনারা বেগমের সাথে দেখা হয় তাহরীমা চৌধুরীর৷ তারা দুজন এই শিবিরে গিয়ে তাহরীমা এবং অন্যান্যদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করেন৷
এ প্রসঙ্গে তাহরীমা বলেন, ‘নারীনেত্রী ফোরকান আপা এবং ঝুনু আপাকে আমি দেখতাম। তারা শিবিরে শিবিরে ঘুরে তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ দিচ্ছেন৷ ফোরকান আপা আমাদের বললেন, আমাদের দেশের জন্য অনেক ছেলে মারা যাচ্ছে, যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হচ্ছে৷ তোমরাও দেশের জন্য কিছু করো৷ তোমরা সেবিকা হিসেবে কাজ করলে হয়ত আমাদের ছেলেরা আবার সুস্থ হয়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য লড়তে পারবে৷ ফোরকান আপার কথাগুলো আমার ভালো লাগে, মনে গেঁথে যায়। তাই তো, দেশ রক্ষায় আমারও দায়িত্ব আছে। আমি ঘরে ফিরেই বাবাকে আমার ইচ্ছের কথা জানাই৷ সব শুনে বাবাও অনুমতি দিলেন। দেড়ি না করে পরদিনই আমি ফোরকান আপার দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে হাজির হই৷'
তারপর হাপানিয়া শিবির থেকে তাহরীমাসহ চৌদ্দজন মেয়ে জিবি এবং বিএম হাসপাতালে গিয়ে নার্সিং স্কোয়াডে যোগ দেন৷ সেখানে তারা প্রথমে সেবিকা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন৷
এ কাজের কথা স্মরণ করে তাহরীমা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা হাসপাতালে গিয়ে দেখি ভেতরে, বাইরে, বারান্দায়, বিছানায়, মেঝেতে শত শত আহত নারী-পুরুষ৷ আমার বয়স তখন মাত্র ১৪ বছর৷ আমার পক্ষে এসব দৃশ্য দেখে সহ্য করা খুব কঠিন ছিল৷ তবুও নিজেকে সামলে নেই৷ এই হাসপাতালে আমাদের ওষুধের মাফ-জোখ, কীভাবে ড্রেসিং করতে হয়, কীভাবে সেলাই করতে হয়, হাড় ভেঙে গেলে কীভাবে প্লাস্টার করতে হয় এসব শেখানো হয়৷ আমরা প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত হাসপাতালে কাজ করতাম৷ এভাবে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের উদয়পুর শিবিরে পাঠানো হয়৷'
হাসপাতালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাহরীমা চৌধুরী বলেন, ‘একদিন দেখলাম একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরাধরি করে আনা হচ্ছে৷ তার পেটটা গামছা দিয়ে বাঁধা৷ এরপরেই দেখি আরো একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে আনা হলো৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাঁচ-ছয় জন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে হাসপাতালে আনা হয়৷ তাদের মধ্যে দ্বিতীয় ছেলেটির পায়ে সেলাই করার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হলো৷ সেলাই করার জন্য পায়ে হাত দিয়ে দেখি, তার পায়ের হাড়টি নেই৷ গোলার আঘাতে উড়ে গেছে৷ চামড়াটা শুধু ঝুলছে৷ ক্ষত থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে৷ তার এরকম অবস্থা দেখে আমার প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা৷ মনে হলো আমার মাথার ওপর থেকে আকাশটা সরে গেছে৷ তবে কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলাম৷ এরপর আমি তার পায়ে ঝুলে থাকা চামড়া সেলাই করি এবং ড্রেসিং করে দিই৷ এছাড়া এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছি যাদের হাত নেই, চোখ নেই কিংবা পেটের ভুড়ি বের হয়ে গেছে৷ তখন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের যে আহাজারি, চিৎকার আর কষ্টগুলো দেখেছিলাম এখনও তা চোখের সামনে ভাসে৷'
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন করে লেখাপড়া শুরু করেন তাহরীমা চৌধুরী৷ ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল গার্লস হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন৷ এরপরেই তার বিয়ে হয়ে যায়৷ এরপরও প্রথমে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকায় এবং পরে ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরি করেছেন৷ এছাড়া নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটিতে থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন তাহরীমা৷ বর্তমানে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি৷ ২০০২ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ পেলেও মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পেতে সময় লেগেছে আরো ৫/৬ বছর৷
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কতোটা মূল্যায়ন হয়েছে জানতে চাইলে এক মেয়ে ও দুই ছেলের মা বীর মুক্তিযোদ্ধা তাহরীমা চৌধুরী বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের কোন মূল্যায়ন হয়নি৷ বিশেষ করে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো মূল্যায়নই হয়নি৷'
কৃতজ্ঞতা : ডয়চে ভেলে।
- ‘পদ্মশ্রী’ গ্রহণ করলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
- কেউ হিট স্ট্রোক করলে কী করবেন?
- সালমান আমার জীবন: ঐশ্বরিয়া
- দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় পুড়ছে যশোর-চুয়াডাঙ্গা
- গোপালগঞ্জে সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন
- দিনাজপুরে সজনের ডাটার বাম্পার ফলন
- জয়পুরহাটে পাকিস্তানী হানাদাররা প্রথম গণহত্যা শুরু করে ২৫ এপ্রিল
- কাতার-বাংলাদেশ ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই
- বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড
- কয়েক ঘণ্টায় ৮০ বারেরও বেশি কেঁপে উঠল তাইওয়ান
- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কাতারের আমির
- কেএনএফের আরও ৩ নারী সহযোগী গ্রেপ্তার
- ঢাকায় কাতারের আমির, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক আজ
- ঢাকা থেকে প্রধান ১৫টি রুটে ট্রেনের ভাড়া যত বাড়ল
- মাকে অভিভাবকের স্বীকৃতি দিয়ে নীতিমালা করতে হাইকোর্টের রুল
- খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের মেয়াদ আরো বাড়ল
- ২৯ ফেব্রুয়ারি বা লিপ ইয়ার নিয়ে ১০টি মজার তথ্য
- জমজমাট ফুটপাতের ঈদ বাজার
- জাপার সভায় গান গাইলেন রওশন এরশাদ
- দেশে ধনীদের সম্পদ বাড়ছে
- এবার বাংলা একাডেমি গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার পাচ্ছেন যারা
- গুলবদন বেগম: এক মুঘল শাহজাদির সাহসী সমুদ্রযাত্রার গল্প
- বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দল ঘোষণা
- যে বিভাগে বিচ্ছেদের হার বেশি
- রোমান্টিক যুগের অন্যতম কবি জন কিটস
- ৭ই মার্চ পরিস্থিতি, কেমন ছিলো সেই দিনটি
- ঘরের মাটিতে হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ
- সদরঘাট ট্র্যাজেডি: সপরিবারে নিহত সেই মুক্তা ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা
- শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণের নেপথ্যে
- দিনাজপুরে ব্যাপক পরিসরে শিম চাষের লক্ষ্য