ঢাকা, বুধবার ২৪, এপ্রিল ২০২৪ ৯:২৫:০২ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
‘পদ্মশ্রী’ গ্রহণ করলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কাতার-বাংলাদেশ ১০ চুক্তি-সমঝোতা সই কয়েক ঘণ্টায় ৮০ বারেরও বেশি কেঁপে উঠল তাইওয়ান ঢাকা থেকে প্রধান ১৫টি রুটে ট্রেনের ভাড়া যত বাড়ল মাকে অভিভাবকের স্বীকৃতি দিয়ে নীতিমালা করতে হাইকোর্টের রুল আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করেছি : শেখ হাসিনা নতুন করে ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি

মুক্তিযোদ্ধা হেলেন চর থেকে চরে ছুটেছেন হানাদারের তথ্যের সন্ধানে

অনু সরকার | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:১৮ পিএম, ৪ এপ্রিল ২০২১ রবিবার

বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা হেলেন করিম৷ ছবি সংগৃহীত।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা হেলেন করিম৷ ছবি সংগৃহীত।

মাত্র তিন মাসের ছোট্ট শিশুকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন মির্জা হেলেন করিম৷ নানা কৌশলে পাকসেনা এবং রাজাকারদের উপর হামলা চালাতে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে৷ টাঙ্গাইলের চর থেকে চরে ছুটে গেছেন হানাদারদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে। গোলা-বারুদ আর বুলেটকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন বীরদর্পে।  

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সময় বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী ছিলেন তিনি৷ কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন৷ তবে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মহিলা পরিষদের সাথে কাজ শুরু করেন৷

১৯৫৮ সালে টাঙ্গাইলে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম মির্জা হেলেন করিমের৷ তার বাবা মির্জা শুকুর আহমেদ এবং মা আনোয়ারা খাতুন৷ টাঙ্গাইলে জন্ম হলেও বাবার চাকুরির সুবাদে ঢাকাতেই বড় হয়েছেন এবং বসবাস করছেন হেলেন৷  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে৷ এরপর টাঙ্গাইলে যুদ্ধের জন্য স্বেচ্ছাসেবী দল তৈরির ডাক আসলে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল চলে যান তিনি৷

নিজের তিন মাসের ছেলেকে বাড়িতে রেখে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নেন হেলেন৷ টাঙ্গাইলের গয়লাহোসেন চরে এপ্রিলের শেষের দিকে প্রশিক্ষণ শুরু করেন তিনি৷ সেখানে ছেলেদের পাশাপাশি পাঁচজন মেয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ যুদ্ধের নয় মাস টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলেন৷

প্রথমদিকে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বন্দুক নিয়ে চর অঞ্চল এবং নদীর তীরবর্তী এলাকায় সতর্ক পাহারা দিতেন তারা৷ পাকসেনা এবং রাজাকারদের গতিবিধি লক্ষ্য করতেন৷ এর মধ্যে রাজাকাররা জানতে পারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব নারী যোদ্ধাদের তথ্য৷ ফলে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানায় অবস্থিত পাকসেনাদের ঘাঁটি থেকে আট-দশটা গানবোট নিয়ে এসে ওই চর এলাকা ঘিরে ফেলে একদিন৷ সেদিন আত্মরক্ষার জন্য পুরুষ যোদ্ধাদের সাথে ফায়ার করতে করতে নারী যোদ্ধারাও এলাকা থেকে সরে পড়েন৷

কিন্তু এ সময় মনোয়ারা নামের এক নারী যোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং ধর্ষিত হন৷ এই ঘটনার পর কোম্পানি কমান্ডার ইদ্রিস আলী নতুন করে মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভাবেন। তিনি মেয়েদের কাছ থেকে বন্দুকগুলো ফিরিয়ে নেন এবং তাদের অন্যভাবে কাজে লাগানোর জন্য ভাবতে শুরু করেন৷ শুধুমাত্র হেলেনের উপর দায়িত্ব পড়ে সিরাজগঞ্জ এবং টাঙ্গাইলের চর অঞ্চলে গ্রেনেড পারাপার করার৷

এসময় ওই অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকারদের অবস্থান ও পরিকল্পনা জানার জন্য গোয়েন্দাগিরির কাজ শুরু করেন হেলেন করিম৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাঁড়ির ভেতর গ্রেনেড ভর্তি করে তার উপর ডিম সাজিয়ে নিয়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পৌঁছে দিতেন তিনি৷ একদিন গরীব গ্রাম্য মেয়ের ছদ্মবেশে নৌকায় করে পাকসেনা এবং রাজাকারদের সাথে এক নৌকায় গ্রেনেড নিয়ে নদী পাড় হয়েছেন হেলেন৷ শত্রুরা তার পরিচয় এবং গন্তব্য জানতে চাইলে তাদের নানা কৌশলে উত্তর দিয়ে সফলভাবে লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন এই সাহসী যোদ্ধা৷

এক সাক্ষাৎকারে সে সময়ের দুঃসাহসী ঘটনার কথা জানান হেলেন করিম৷

তিনি বলেন, নৌকায় রাজাকাররা আমাকে জিজ্ঞেস করতো ডিমের হালি কতো৷ আমি সাহস করে উত্তর দিতাম৷ তখন জিজ্ঞেস করতো, ওপারে তোমার কে থাকে? আমি বলতাম, আমার স্বামী থাকে৷ তখন তারা বলতো, ও সেজন্যই যাচ্ছো৷ আমি বলতাম, হ্যাঁ৷ তখন তারা আর কিছু বলতো না৷

তিনি আরও বলেন, একদিন দুইজন পাকসেনা আর তিনজন রাজাকার নৌকায় উঠেছে৷ আমিও ওই নৌকায় আছি৷ ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কোথায় নামবে? আমি মুক্তিবাহিনীর ভাইদের আগে বলে দেয়া নির্দিষ্ট জায়গার নামই বললাম। সেখানে না নামলে আমি তো আবার রাস্তা চিনতে পারবো না৷ ফলে তারা আমাকে সেখানে নামানোর জন্য তীরে নৌকা ভিড়ালো৷ যেই আমি নৌকা থেকে নেমে গেছি অমনি সেখানে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর ব্রাশফায়ার করেন৷ তাৎক্ষনাত দুইজন পাকিস্তানি সেনা এবং একজন রাজাকার সেখানেই মারা যায়৷ অন্য দুইজন রাজাকারকে ধরে আনা হয়৷ তারা পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ শুরু করে৷

একাত্তরের উত্তাল সময়গুলোতে দিনের পর দিন এভাবে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ঘুরে ঘুরে শত্রুপক্ষের খবর এনে দিতেন বীর নারী হেলেন৷ তার তথ্যের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধারা সফল অভিযান চালাতেন৷ যুদ্ধের শেষের দিকে হেলেন করিমের সংকেত অনুসরণ করে বেলকুচি থানার শক্ত ঘাঁটিতে হামলা চালান মুক্তিবাহিনী৷ সেদিন ৫ থেকে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়৷ আনোয়ার নামের একজন সেনা আত্মসমর্পণ করে৷ এই একশানের পর থেকেই ওই অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে৷

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা হেলেন৷ এক সময় তার বাসাতেই গঠিত হয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী৷ উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি৷ খেলাঘরের সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য৷ মহিলা আওয়ামী লীগের ঢাকা উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলেন করিম৷