ঢাকা, শনিবার ০৪, মে ২০২৪ ৯:১০:০৯ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
জনগণ তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করুক: প্রধানমন্ত্রী সবজির বাজারে স্বস্তি নেই যুদ্ধকে ‘না’ বলতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছি ভারী বর্ষণে মহাসড়কে ধস, চীনে ২৪ প্রাণহানি রাজবাড়ীতে ট্রেন লাইনচ্যুত, রেল যোগাযোগ বন্ধ

সৌমিত্র আমার প্রথম নায়ক: শর্মিলা ঠাকুর

বিনোদন ডেস্ক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১১:১৭ পিএম, ১৫ নভেম্বর ২০২০ রবিবার

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সিনেমার শুটিং-এ।  ফাইল চিত্র।

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সিনেমার শুটিং-এ। ফাইল চিত্র।

অপুর সংসার ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিষেক হয়েছিল তাঁরও। সেই ছবির অপর্ণা কলম ধরলেন তাঁর প্রথম নায়ক অপুকে নিয়ে। বলছি ভারতে স্বনামধন্য অভিনয় শিল্পী শর্মিলা ঠাকুরের কথা। প্রিয় অভিনেতার প্রয়াণে আনন্দবাজার পত্রিকায় তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই লেখাটি তুলে ধরা হলো এখানে।

একটা বন্ধ দরজা। অপু সেটা খুলে দিয়ে অপর্ণাকে বলবে, “এসো।”

আমি দাঁড়িয়ে। ক্যামেরা ইত্যাদি নিয়ে পরিচালক মানিকদা (সত্যজিৎ রায়)-সহ পুরো ইউনিট। মানিকদা ‘অ্যাকশন’ বলে ওঠার আগেই তিনি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন, “নার্ভাস লাগছে?”

আমি বললাম, “নাহ্।”

কারণ, কখনও মনে হয়নি, আমি একটা বড় ছবিতে অভিনয় করছি। মনে হয়নি, ছবির পরিচালক এক বিরাট মাপের মানুষ। আর আমার পাশে দাঁড়ানো নায়ক মানুষটিও আমার চাইতে ১০ বছরের বড়।

সেই প্রথম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ। ছবিটি ‘অপুর সংসার’। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কিংবদন্তি। যে ছবির কিছু কিছু শট চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

যেমন বিয়ের পর ফুলশয্যার রাতে অপু আর অপর্ণা। ব্যাকগ্রাউণ্ডে মাঝির ভাটিয়ালি গানের সুর। খাটের এক পাশে অপর্ণা দাঁড়িয়ে। অপু তাকে নিজের কথা বলছে। অথবা সকালে ঘুম থেকে ওঠার দৃশ্য। অ্যালার্ম ঘড়ির আওয়াজ। অপুর চাদরে অপর্ণার আঁচল বাঁধা। আটকাচ্ছে। অপর্ণা ছাড়িয়ে অপুকে হালকা চাপড় মারে। অপু ঘুম ভেঙে শুয়ে রয়েছে। হাতে অপর্ণার চুলের কাঁটা। দূরে অপর্ণা উনুন ধরাচ্ছে। কিম্বা অপর্ণা চুল বাঁধছে। অপু চৌকাঠে বসে। অপু অপর্ণাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘‘তোমার অনুশোচনা হয় না?’’ অপর্ণা বলছে, সে অত শক্ত কথা বুঝতে পারে না। অপু বলছে, ‘‘আফসোস হয় না?’’ অপর্ণা ইয়ার্কি মেরে বলছে, ‘‘হয়। বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হলে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা যেত।’’ আর অপু বেরিয়ে যেতে চাইছে কাজের লোকের খোঁজে।

সেই ছবিতে ওই শটগুলোর মধ্য দিয়ে আমাদের আলাপ। সেই থেকে বন্ধুত্ব। বয়সের পার্থক্য থাকলেও সৌমিত্রর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বে কোনও কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অনেকগুলো ছবিই তো করেছি ওঁর সঙ্গে। ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘বর্ণালী’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘আবার অরণ্যে’...।

কিন্তু সৌমিত্রর সঙ্গে আমার প্রথম ছবির (আমার জীবনেরও প্রথম ছবি) প্রথম শটের মুহূর্তটাই কেমন যেন প্রতীকী বলে মনে হয়। একটা দরজা খুলে আমাকে নায়ক বলছেন, “এসো।” শুরু হচ্ছে আমার স্ক্রিন কেরিয়ার। আর শুরু হচ্ছে এমন একটা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব, যিনি একই সঙ্গে অভিনেতা, লেখক, কবি, চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী, আবৃত্তিকার। কী নন! ফুটবল থেকে কবিতা, ক্রিকেট থেকে গিরিশ ঘোষ, যে কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন, এমন মানুষের দেখা কমই পেয়েছি। মানিকদা, তপনবাবু, অসিতবরণ, অকালে চলে যাওয়া ঋতুপর্ণ আর অবশ্যই সৌমিত্র। আমাদের যে খুব নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এমন নয়। কিন্তু যখনই কথা হয়েছে, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গে গড়িয়ে গিয়েছে আড্ডা। কারণ, সৌমিত্র ছিলেন সেই বিরল এক মানুষ, যিনি যে কোনও সময়ে যে কোনও বিষয়ে অনর্গল কথা বলে যেতে পারতেন।

‘দেবী’-তে ওঁর সঙ্গে আমার এক সঙ্গে খুব বেশি দৃশ্য ছিল না। কিন্তু সেই দৃশ্যটি ভুলতে পারিনি এখনও, যেখানে স্বামী উমাপ্রসাদ স্ত্রী দয়াময়ীকে বলছে তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে। দয়াময়ী রাজি হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে, সে যদি সত্যিই দেবী হয়, তবে পালিয়ে গেলে তো স্বামীর অকল্যাণ হবে! এ সেই দেবী আর মানবীর অনিবার্য দোলাচল। স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’। তখন গরমকাল। পালামৌয়ের যে অরণ্যে শ্যুটিং হয়েছিল, সেই সিপাডহর নামের জায়গাটায় আমাদের ১ মাস থাকতে হয়েছিল। গরমে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! আমাকে একটা আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছিল। রবিদা, শুভেন্দু, শমিত একটা ঘরেই ডর্মিটারি করে থাকত। সৌমিত্র, মানিকদা, তিনু আনন্দ থাকতেন অন্য একটা বাড়িতে। কাবেরীদি আর সিমির জন্য একটা সত্যিকারের ডাকবাংলোর ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। আমার ঘরে একটা কুলার থাকলেও রবিদাদের সেই ঘরটায় কিছুই ছিল না। প্রবল গরমে ওঁরা নিজেদের নাম বদলে ফেলেছিলেন। ‘রবি-পোড়া’, ‘শমিত-ভাপা’ এমন সব নামে পরিচয় দিতেন। গরম এড়িয়ে সকালে আর বিকেল-সন্ধেয় শ্যুটিং হত। বাকি সময়টায় দারুণ আড্ডা। বেশিরভাগ দিনই আড্ডার মধ্যমণি হতেন সৌমিত্র। কী বিষয় নিয়ে যে কথা হত না! থিয়েটার, ফুটবল, গান। আর মানিকদা যোগ দিলে তো কথাই নেই! মনে আছে, রাতে হাতির ডাক শুনতে পেতাম। এক সন্ধেয় সবাই গিয়েছিলাম সাঁওতাল পল্লিতে। ওখানকার মেয়েদের সঙ্গে নেচেছিলাম মনে আছে। সেই সব অভিযানেও কিন্তু আমাদের সঙ্গী ছিলেন সৌমিত্র।

ওই ব্যাপারটাই আবার ফিরে পেয়েছিলাম গৌতম ঘোষের ‘আবার অরণ্যে’-র শ্যুটিংয়ে। ছবির বিষয় ছিল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র চরিত্রদের একটা রি-ইউনিয়ন। বাস্তবেও সেটা ছিল আমাদের পুনর্মিলন। একটা চা বাগানের বাংলোয় ছিলাম। আবার সৌমিত্রর সঙ্গে লম্বা আড্ডা। বিষয় থেকে বিষয়ে ঘুরে যেত সময়। অহীন্দ্র চৌধুরী, শিশির ভাদুড়ি, গিরিশ ঘোষ থেকে উত্তমকুমার। আমার মনে হত, সৌমিত্রর সেই কথাবার্তাকে একটা রেকর্ডিংয়ে ধরে রাখা গেলে বেশ হয়। আমাদের সঙ্গে তো টেপ রেকর্ডারও ছিল। কিন্তু কেন যে করা হয়নি! মনে আছে, সৌমিত্র সেই সময়ে নাতির জন্য ছোট ছোট কবিতা বা ছড়া লিখতেন। চমৎকার সে সব লেখা। আমাকে শোনাতেন নতুন কিছু লিখলেই। সেই সফরে অন্য এক সৌমিত্র আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছিলেন। গৌতম তাঁর ছবিতে যা দেখাতে চেয়েছিলেন, তার খানিক বেশিই পেয়েছিলাম আমরা।

সৌমিত্রর সঙ্গে করা আরেকটা ছবি ‘বর্ণালী’। অজয় করের পরিচালনা। আশ্চর্য এক ছবি! এক রাতের গল্প। ভুল করে এক পরিবারকে নেমন্তন্ন করে বসে নায়ক। সেই পরিবারের মেয়ের চরিত্রেই ছিলাম আমি। এই সেদিনও ছবিটা আবার দেখলাম। সত্যজিতের ক্যামেরার বাইরেও কী সাবলীল সৌমিত্র! আসলে উনি চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে জানতেন। ভার্সেটাইল। মনে পড়ছে ‘কোনি’-র কথা। সরোজ দে-র পরিচালনা। এক সাঁতার শিক্ষকের ভূমিকায় প্রৌঢ় সৌমিত্র। কিন্তু সেখানেও কী সাংঘাতিক বিশ্বস্ত অভিনয়! সেই ছবি যখন জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হল, তখন জুরি বোর্ডে ছিলাম আমি। চেয়েছিলাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মানটা সৌমিত্রই পান। কিন্তু সে বছর সেই সম্মান পেয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ। গৌতম ঘোষের ‘পার’ ছবির জন্য। সেটাও অবশ্যই একটা দারুণ ছবি। ওসি গাঙ্গুলির ‘কিনু গোয়ালার গলি’-তেও আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু সে ছবির খুঁটিনাটি এখন আর আমার মনে নেই। ছবিটা পরে দেখাও হয়নি।

ত্রুফো-জাঁ পিয়ের লিউ, আকিরা কুরোসাওয়া-তোশিরো মিফুন, ফেদেরিকো ফেলিনি-মার্চেল্লো মাস্ত্রোয়ানি এবং সত্যজিৎ-সৌমিত্র— এগুলো এখন রূপকথা। ত্রুফোর ‘ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’-সহ বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন লিউ। যেমন মিফুন ‘রশোমান’, ‘সেভেন সামুরাই’-সহ কুরোসাওয়ার ১৬টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সত্যজিতের ‘অপু’ এবং ‘আঁতোয়া দইনেল’ চরিত্রের মধ্যে অত্যন্ত জোরাল আত্মজৈবনিক সংযোগ আছে। আসলে এই অভিনেতারা প্রত্যেকেই ছিলেন পরিচালকের ‘অল্টার ইগো’। এই চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে এই পরিচালকেরা তাঁদের অতীতে বিচরণ করেছেন। এক অর্থে তাঁদের বিকল্প হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বলেই ডাকাবুকো পরিচালকেরা এই অভিনেতাদের উপর নির্ভর করতেন।

সত্যজিতের অপু তো শুধু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপু’ নয়। সেখানে যখন অপু তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে, তখন মানিকদার সঙ্গে তাঁর মায়ের সম্পর্কের ছাপ স্পষ্ট। মানিকদা-সৌমিত্র সম্পর্কটা ওই মাত্রায় পৌঁছেছিল। সেই জন্যই আমার মনে হয়, এই মূল্যায়নটা একেবারেই যথাযথ। মানিকদা ওঁকে নিয়ে অনেক ছবি করেছেন। তবু মনে হয়, আরও যদি কয়েকটা ছবি সৌমিত্রকে নিয়ে করে যেতেন! আসলে সৌমিত্র-মানিকদার কেমিস্ট্রিটাই ছিল অন্যরকম। মানিকদার সবচেয়ে কাছের মানুষদের মধ্যে সৌমিত্র অবশ্যই একজন। মানিকদা আর সৌমিত্র— দু’জন মিলেই একটা কিংবদন্তি। একটা রূপকথা।

সৌমিত্রর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার গল্প বলতে বসলে শেষ হবে না। একেবারে কাজপাগল মানুষ। সেটা শ্যুটিংয়ের সময় বার বার টের পেতাম। ওই বয়সেও কী দারুণ অ্যাক্টিভ! এখনও সমান ভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শ্যুট করতে গিয়েই তো শেষমেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন!

সৌমিত্রর সঙ্গে আউটডোরের শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতার একটা বড় স্মৃতি হল ওঁর গান। জনসমক্ষে পারফর্ম করতেন না। কিন্তু নিয়মিত গলা সাধা বজায় রাখতেন। ‘আবার অরণ্যে’-র শ্যুটিংয়ের সময়েও দেখেছি ভোরবেলা উঠে ব্যায়াম করছেন। সেই সঙ্গে চলেছে গলা সাধা। গানটাও যেন ব্যায়াম করারই অঙ্গ। আমার মায়ের সঙ্গেও সৌমিত্র-দীপাবৌদির খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মা প্রায়ই নিমন্ত্রিত হতেন ওঁদের পার্টিতে। মায়ের কাছ থেকেও সৌমিত্রর গল্প শুনতাম।

সৌমিত্র বড়মাপের অভিনেতা। খুব বড়মাপের অভিনেতা। এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু শুধু তো অভিনয় নয়। তাঁর লেখালেখি, তাঁর কবিতা, কাব্যপাঠ, বিপুল পড়াশোনা আর সব কিছুকে ছাপিয়ে তাঁর একটা শিশুর মতো মন ছিল। শিশুর মতো বিস্ময়াবিষ্ট হতে পারতেন ওই বয়সেও। শিশুর মতোই একটা হাসি ছিল। সবমিলিয়ে এমন একটা মানুষ, যাঁকে ঘিরে বিস্ময় যেন ফুরোয় না। মনে হয়, বিভূতিভূষণের অপুর মতোই ছিলেন সৌমিত্র। বিস্মিত হতে জানতেন। বিস্মিত করতে জানতেন।