ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ১:১৭:১৩ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
আজ আসছে না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা পেছাল খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে জুবাইদা রহমান ‘শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের ইতিবাচক সাড়া নেই’ বেশির ভাগ সবজিই ৬০-৮০ টাকার ওপরে বন্যায় সহায়তা: বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী

নারীর প্রতি এতো বৈষম্য কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৪৪ পিএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বুধবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বস্তিতে দেখা হলো শিউলি আক্তারের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। বয়স ১৯। গার্মেন্টসে কাজ করেন, মাসে পান আট হাজার টাকা। একই লাইনে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ সহকর্মীর বেতন ১০ হাজার টাকা। শিউলি ক্ষোভভরা কণ্ঠে বলেন–‘আমি দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করি, সে-ও করে। তার বেতন বেশি যখন জিজ্ঞেস করি, তখন ম্যানেজার বলে, পুরুষরা সংসার চালায়, তাদের বেশি দিতে হয়। তখন মনে হয়, আমি কি সংসার চালাই না?’ শিউলির অভিজ্ঞতা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়, বরং বাংলাদেশের সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যের নগ্ন বাস্তবতার প্রতিফলন।

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ’ বা সিডও (কনভেনশন অন দ্য ইলিমিনেশন অব অল ফরমস অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট উইম্যান) সনদে স্বাক্ষর করে। কিন্তু আজও নারীরা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইনে বৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘আইন বলছে নারী-পুরুষ সমান। সমাজ ও নীতিনির্ধারক কাঠামো নারীর পূর্ণ সমতা দিতে সাহসী হয়নি। ফলে বৈষম্য আইন ও জীবনের মাঝে এক গভীর ফারাক তৈরি করেছে।’

সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র

নারীর প্রতি বৈষম্য শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়; সহিংসতার পরিসংখ্যানে এর ভয়াবহতা প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৯৩৭ জন। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৫২৫ জনে। এর মধ্যে ৪৮১টি ধর্ষণ, ১০৬টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ১৭টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই (জানুয়ারি থেকে জুলাই) এক হাজার ৭৯০ নারী ও কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে ৪০৫টি ধর্ষণ, ১১৭টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ১৮টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানাচ্ছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটেছে ৩২২ নারীর।

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, বিয়ে থেকে বের হওয়ার ক্ষমতায় নারী-পুরুষের অসম অবস্থান পুরুষকে বৈষম্যমূলক ক্ষমতা দেয়। পরিবারে নারীর বৈষম্য কর্মক্ষেত্রেও তাদের পিছিয়ে রাখে, তৈরি করে এক ‘ঝুঁকিপূর্ণ চক্র’। ২০১০ সালের পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন নারী-শিশুর সুরক্ষায় গুরুত্বপূরর্ণ পদক্ষেপ ছিল। অথচ বাস্তবে এর প্রয়োগ সীমিত। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা যায়, অনেক সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পারিবারিক সহিংসতাকে ‘ঘরের বিষয়’ মনে করে। অন্য আরেক প্রতিবেদন জানিয়েছে, ৭২ শতাংশ নারী কখনোই অভিযোগ করেন না, আর মাত্র ৩ দশমিক ১ শতাংশ মামলার রায় ভুক্তভোগীর পক্ষে যায়। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া, দুর্নীতি এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আইনের কার্যকারিতা প্রায় অকেজো করে রেখেছে।

কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য

শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, পুরুষের শ্রমশক্তি অংশগ্রহণ ৮১ শতাংশ, নারীর মাত্র ৪২ শতাংশ। একই কাজে নারীরা গড়ে পুরুষের তুলনায় ৩৭ শতাংশ কম মজুরি পান। গার্মেন্টসে প্রায় ৮০ লাখ নারী কাজ করেন। নেতৃত্বে নারীর উপস্থিতি ১০ শতাংশেরও কম।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত

মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি বেড়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ঝরে পড়ার হার এখনও বেশি। বাল্যবিয়ে ও দারিদ্র্য এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। এদিকে, মাতৃমৃত্যুর একটি বড় কারণ হলো প্রসবকালীন নিরাপদ চিকিৎসা সেবার অভাব। চট্টগ্রামের সোনিয়া বেগম (ছদ্মনাম, বয়স ১৭) বলেন, ‘কভিডে স্কুল বন্ধ থাকায় আমাকে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে মারধরের শিকার হয়ে গ্রামে ফিরে আসি। পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ পাইনি।’

নারীরা কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে জনপরিসর পর্যন্ত প্রতিনিয়ত হয়রানি ও কটূক্তির মুখে পড়ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, ‘ক্লাসে ভালো করলে অনেকে বলে, স্যারের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তখন বুঝি, মেধা দিয়েও নিজেকে প্রমাণ করা যায় না।’ ঢাকার মিরপুরের শিরিন আক্তারকে (ছদ্মনাম, বয়স ২৫) স্বামীর হাতে নির্যাতনের পর কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। থানায় গেলে পুলিশ বলে, ‘এটি পারিবারিক ব্যাপার, আপস করুন।’ শিরিন হতাশাভরা কণ্ঠে বলেন, ‘আইন আছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের মতো নারীর জন্য ন্যায়বিচার কত দূরের কথা।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক রক্ষণশীলতা, আইনের ফাঁকফোকর, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া, অর্থনৈতিক কাঠামো, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব–এসবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ টিকিয়ে রাখার মূল রসদ।

মনস্তাত্ত্বিক আধিপত্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, ‘নারীর প্রতি আমাদের সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি, এর মূলে লুকিয়ে আছে নারীর প্রতি অপমান, অসহিষ্ণুতা, অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত রাখার মানসিকতা। যারা নিজ নিজ পেশায় সফল হয়েছেন বা সমাজের জন্য, দেশের জন্য অবদান রেখেছেন, তারা যেমন বিভিন্ন ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ির শিকার হন; তেমনি সাধারণ নারী রাস্তাঘাট, পরিবার, সমাজ–সর্বত্র বৈষম্য ও আক্রমণের শিকার হন। নারীরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। এই নিরাপত্তার অভাব থেকে তারা নিজের কর্মকাণ্ড সীমিত রাখেন। দেখা যায় যে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা অনেক সময় কাজে যাচ্ছেন না; অথবা সমাজের জন্য যে কন্ট্রিবিউশন রাখতে পারেন, তারা সেই ক্ষেত্রে অনেক সময় পিছিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি আমরা দেখছি যে, নারীরা তাদের দিকে ছুড়ে দেওয়া বিভিন্ন অপবাদ মাথায় রেখেও সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, অনেক নারী সম্পদের অধিকার থেকেও বঞ্চিত, এটিও মাথায় রাখতে হবে। এটিও এক ধরনের নির্যাতন, যেটিকে আমরা বলি ‘অর্থনৈতিক নির্যাতন’। এই বিষয়গুলো সার্বিকভাবে দেশের নারী-শিশুদের মধ্যেও একটি মানসিক প্রভাব রাখে যে, তাদের যোগ্যতা কম, তাদের ক্ষমতা কম। পুরুষই তাদের সবকিছুর নির্ধারক–পুরুষের ইচ্ছাতেই তাদের ভাগ্য, পেশা, কাজ নির্ধারিত হবে। এ ধরনের একটা নির্ভরশীলতা তাদের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রেও নারীকে দেখা যায় পুরুষের ওপর নির্ভরশীল থাকতে। এটি তাদের নির্যাতনের পথও সহজ করে দেয়। অর্থাৎ, আর্থিকভাবে দুর্বল নারীকে নির্যাতন করা যায় সহজে। এই চক্রের কারণেই নারী একদিকে যেমন ক্ষমতায়িত হতে পারছে না, অপরদিকে তার নির্যাতনের পথটা আরও সহজ হয়। নারীকে অধিকার বঞ্চিত করে রাখা, দমিয়ে রাখা অনেক সহজ হয়।

সমাধানের পথ

সিডওতে রাখা সংরক্ষণ প্রত্যাহার করতে হবে; দ্রুত অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন জরুরি; যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন ও বৈষম্যবিরোধী আইন করতে হবে; নারীর জন্য সমান মজুরি ও নেতৃত্বের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ বিনিয়োগ দরকার; সবচেয়ে জরুরি হলো মানসিকতার পরিবর্তন। নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নয়, পূর্ণ মর্যাদার নাগরিক হিসেবে দেখতে হবে।

বাংলাদেশ নারীর উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়েছে–এ দেশ নারী সরকারপ্রধান দেখেছে; সবক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান; কিন্তু একইসঙ্গে বৈষম্য, সহিংসতা ও ন্যায়বিচারের অভাবও ভীষণ স্পষ্ট। ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন তো এটি ঘিরেই যে, বাংলাদেশের সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। এবং সরকারের নীতিগুলোতে যে প্রতিফলন হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে–সেগুলোর বাস্তবায়ন করাটাই আমাদের আন্দোলনের মূল বিষয়। সম্পদ-সম্পত্তি উত্তরাধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করাসহ সংসদে নারী প্রতিনিধি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আসবে। তবে সংরক্ষিত আসন থাকবে। কিন্তু সরাসরি নির্বাচন হবে সংরক্ষিত আসনে। এ ছাড়াও গৃহকর্মে নারীর মূল্যায়ন করতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করাও আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে আইনের ব্যবস্থাটাকে আরও নারীর প্রতি সংবেদনশীল করে তোলা জরুরি। কারণ, নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকহারে বাড়লেও আইন সেভাবে আমাদের সহায়তা করছে না। একটা মেয়ে বিচার চাইতে গেলে আদালতে ওই নারীকে বিচারক অপমানজনক মন্তব্য করছেন। এসব প্রতিনিয়ত হচ্ছে, আর তা পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশে নারীর সমতা প্রতিষ্ঠিত করাটা এখন সময়ের দাবি।’ 

এই বিভাগের জনপ্রিয়