ঢাকা, শুক্রবার ২৯, মার্চ ২০২৪ ১১:৪০:১২ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
সেতু থেকে খাদে পড়ে বাসে আগুন, নিহত ৪৫ রমজানের অর্ধেকেও কমেনি মাছ ও মাংসের দাম ঈদযাত্রা: ৮ এপ্রিলের ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে আজ বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া

‘অপারেশান সার্চলাইট’ জাহান্নামের দরোজা খুলে দিয়েছিল: পাক মেজর

বাসস | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৩২ এএম, ২৫ মার্চ ২০২২ শুক্রবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট চালানোর সময় পাকিস্তানি সামরিক বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আড়ি পেতে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, সেই রাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাঙালিকে হত্যা করাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।
বিশ্বের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতকে একটি বিরল ঘটনা হিসাবে রেকর্ড করা হয়েছে যখন একটি দেশের সামরিক বাহিনী একটি কুখ্যাত অভিযানের নামে একই দেশের ঘুমন্ত বেসামরিক জনগণের ওপর অতর্কিত নৃশংস হামলা চালিয়েছিল।
সেদিন সারা দেশে বাঙ্গালী নিধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত দু’জন সিনিয়র কমান্ডারসহ অন্তত তিনজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা পরে এই বিষয়ে লিখেছেন, এদের তৃতীয়জন মেজর সিদ্দিক সালিক অপারেশন সার্চলাইটের প্রস্তুতি পর্বের কথা খুবই বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
মেজর সিদ্দিক সালিক তার বহুল আলোচিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে ওই দিনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘জাহান্নামের দরোজা হাট করে খুলে দেয়া হয়েছিল।’ তবে, অপর দুই সিনিয়র কমান্ডার প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত তাদের নিজ নিজ বইতে দৃশ্যত পাক বাহিনীর নৃংশসতার কথা গোপন করে ঘটনার বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন।     
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতেন সালিক। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের কথা স্মরণ করে বলেন, ওই রাত ছিল অন্য যে কোন স্বাভাবিক প্রশান্তিময় বসন্ত রাতের মতই।
তিনি লিখেছেন, তারার আলোয় মোড়া সেদিনের ঢাকা নগরী ছিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঢাকায় বসন্তের রাত যতটা হতে পারে ততটাই মনোরম ছিল সেই রাত। রাতের পরিবেশ আর যাই হোক গণহত্যার উপযুক্ত ছিল না।
সালিক জানান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে শীর্ষ কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে ঢাকা ক্যান্টমেন্টে দুটি সদর দপ্তর স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে ‘অপারেশন সার্চ লাইট-এর নীলনকশা তৈরি করা হয়।
রাও ফরমান আলীকে ঢাকা শহর ও এর আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয় এবং মেজর জেনারেল রাজাকে দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানের বাদবাকি অঞ্চলের দায়িত্ব।
সালিক লিখেন, লেফটেন্যাট জেনারেল টিক্কা খান ও তার স্টাফদের ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কর্মসূচির অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করতে সেকেন্ড ক্যাপিটালের মার্শাল ল’ হেডকোয়ার্টারে রাত কাটানোর কথা ছিল।
তিনি লিখেন, তার মতো জুনিয়র অফিসাররা মার্শাল ল’ এডমিনিস্টেটর্স হেডকোয়ার্টারে জড়ো হয়েছিলেন। তারা লনে সোফা ও ইজিচেয়ার পেতে বসে এবং রাতভর জেগে কাটানোর জন্য চা ও কফির ব্যবস্থা করেছিলেন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, টিক্কা খানের ‘আউটডোর অপারেশন্স রুম’-এর বাইরে ওয়াল্যাস ফিট করা একটি জিপ রাখা হয়। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে প্রথমবারের মতো জিপে সেট করা ওয়াল্যাসটি শব্দ করে ওঠে।
সালিক বলেন, ঢাকার স্থানীয় কমান্ডার হামলার সময় এগিয়ে আনার অনুমতি চান। কারণ, অন্য পক্ষ অর্থাৎ বাঙালি বিক্ষোভকারীরা প্রতিরোধের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং তখন ঘটনাস্থলে সকলেই বারবার তাদের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তখনও কলম্বো ও করাচির মাঝপথে ছিলেন। জেনারেল টিক্কা তখন সিদ্ধান্ত দিলেন ‘ববিকে (ব্রিগেডিয়ার আরবাব) যতক্ষণ পারা যায় অপেক্ষা করতে বলো।’
সালিক লিখেছেন, সৈন্যদের রাত একটা বাজার আগেই তাদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে বলা হয়েছিল। তবে, তারা পথে দেরি হতে পারে আশংকা করে রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট থেকে রওনা হতে শুরু করে।
তিনি বলেন, রেডিও, টেলিভিশন স্টেশন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও স্টেট ব্যাংকের নিরাপত্তা দিতে যে সকল সৈন্য শহরে ছিল তারা নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই তাদের অবস্থান নিয়েছিল।
সালিক বলেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়া প্রথম সারির সৈন্যরা ফার্মগেটে বাধার মুখে পড়ে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক কিলোমিটার দূরে ফার্মগেটে রাস্তার ওপর একটি বিশাল গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা হয়। পাশের ফাঁকা জায়গায় ভাঙা পুরনো গাড়ি ও নষ্ট স্ট্রিম রোলার ফেলে রাখা হয়।
তিনি উল্লেখ করেন, জেনারেল টিক্কা খানের সদর দপ্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নগীর ব্যারিকেড দেয়া দিক থেকে কয়েকশ’ আওয়ামী লীগারের জয় বাংলা শ্লোগান তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি তাদের জোরালো শ্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম।
সালিক বলেন, ১৫ মিনিট পরে জয়বাংলা শ্লোগানের ধ্বনি মিইয়ে আসে। দৃশ্যত সামরিক অস্ত্রের জয় হয়েছে এবং সেনারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে।
সালিক স্মরণ করেন, যখন প্রথম গুলি চালানো হয় ঠিক সেই মুহূর্তে সরকারি পাকিস্তান রেডিও’র তরঙ্গে কাছাকাছি আরেকটি বেতার তরঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের অস্পষ্ট কণ্ঠ শোনা গেল।’
বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড লোশাকের পরবর্তী সময়ের একটি লেখার প্রসঙ্গ টেনে সালিক লেখেন, ‘শুনে মনে হচ্ছিল, আর বাস্তবেও অবশ্যই তা-ই, শেখ (মুজিব) একটি পূর্ব-রেকর্ডকৃত বার্তায় পূর্ব পাকিস্তানকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ ঘোষণা করেছেন।
জেনারেল রাজা পরে তার লেখা ‘এ স্ট্রেনজার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় সেই সন্ধ্যার কথা স্মরণ করে বলেন, তিনি ও ফরমান আলী একটি মুভি দেখতে সস্ত্রীক গ্যারিসন সিনেমা হলে গিয়েছিলেন।
রাজা সিনেমা হলে স্বাভাবিক উপস্থিতিই দেখতে পেলেন। কিন্তু বিরতির সময় আলো জ্বালানোর পর তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন যে সকল বাঙালি সিনেমা হল ত্যাগ করেছে।
তিনি উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্টের প্রস্থান ও এর প্রভাব এবং চলমান সংকট মোকাবেলায় আলোচনা যে ব্যর্থ হয়েছে তা আর গোপন বিষয় ছিল না।
তিনি বলেন, সৈন্যরা ব্যারাকে প্রস্তুত হলো এবং স্বাভাবিক পদাতিক সৈন্য ছাড়াও আমরা পিটি৭৬  ট্যাংকের একটি বাহিনী প্রস্তুত রাখলাম। আমরা হার্ড টাগের্টের জন্য কিছু ১০৬ এমএম রিকয়েললেস রাইফেলও প্রস্তুত রাখলাম।
রাজা উল্লেখ করেন, ঢাকার বাইরের অভিযান পরচিালনার দায়িত্বে থাকা আমার সদরদপ্তর পুরোপুরি সক্রিয় ও প্রস্তুত। কিন্তু আমার জন্যে অপেক্ষা করা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর।
তিনি লিখেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবিত গ্রেফতারের দায়িত্বপ্রাপ্ত থ্রি কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের লেফেটেন্যান্ট কর্নেল জেডএ খান তার প্রায় চল্লিশ জনের একটি বাহিনী নিয়ে তাদের মিশন সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল।
রাও ফরমান আলী তার ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ নামক বইতে উল্লেখ করেন, কোন মারাত্মক দাঙ্গার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে কারফিউ জোরদারে বেসামরিক সরকারকে সহায়তা দিতে যে ধরনের অভিযান চালানো হয়, ‘অপারেশান সার্চলাইট’ সে ধরনের সাধারণ কোন সামরিক অভিযান ছিল না। এখানে পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণই ভিন্ন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, বিদ্রোহ দেখা দেয়ার প্রেক্ষিতে সরকারি কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
ফরমান আলী বলেন, তিনি ও জেনারেল রাজা যদি অভিযান বাস্তবায়নে কোন দুর্বলতা দেখান তাহলে দায়িত্ব ছিনিয়ে নিতে ইফতেখার জানজুয়া ও এ ও মিঠা খানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ডেকে পাঠানো হয়।
ফরমান আলী বলেন, অন্য দুই জেনারেল- ওমর ও খুদা দাদ - সেই সময় ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন, যখন সবাই আগুনের মতো জ্বলছিল এবং ফরমান ও খাদিমকে ‘তাদের নরম মনোভাব’-এর জন্য উপহাস করছিল।
সিদ্দিক সালিকও তার কথা সমর্থন করে লিখেন, জেনারেল ইয়াহিয়া কিছুদিন আগে মেজর জেনারেল ইফতিখার জানজুয়া ও মেজর জেনারেল এ ও মিঠাকে খাদিম ও ফরমানের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে ঢাকায় পাঠান। তারা অভিযান চালাতে অস্বীকার করলে যেন এ দুজনকে দায়িত্ব দেয়া যায়।  
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ওয়ারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থায় আড়িপাতার মাধ্যমে জানা যায়, পাকিস্তানের ওই রাতের অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল যতো বেশি সংখ্যক সম্ভব বাঙালি হত্যা করা।