ঢাকা, বুধবার ০৮, মে ২০২৪ ২:৫৯:৩০ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ জিম্মি মুক্তিতে হামাসের সম্মতির পরও গাজায় যুদ্ধবিরতি অনিশ্চিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক রুটিনে ক্লাস শুরু আজ হজের ফ্লাইট শুরু ৯ মে পুলিৎজার পেল রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমস

আইন আছে, তবে দেশে পাখি শিকার বন্ধ হচ্ছে না

অনলাইন ডেস্ক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১০:৫৭ পিএম, ৪ জানুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার

মূলত হাওর অঞ্চলেই বেশি পাখি দেখা যায়।

মূলত হাওর অঞ্চলেই বেশি পাখি দেখা যায়।

দেশে বুনো পাখি শিকার আইনগতভাবে নিষিদ্ধ, কিন্তু তার পরেও পাখি ধরা কিংবা বাজারজাতকরণ যেন কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। আইন মানছে না কেউ।

পাখি গবেষকরা বলছেন, মাংসে ভিন্ন স্বাদের খোঁজে অনেকেই পাখি শিকার করে থাকেন। আর তাদের চাহিদা থাকার কারণেই অনেকে পাখি শিকার করে সেগুলো বাজারজাত করে থাকে।

তবে, তারা বলছেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাখি শিকারের ঘটনা কমে আসলেও সেগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি।

বরং গত কয়েক বছরে বিষ প্রয়োগ করে পাখি শিকারের ঘটনা বেড়েছে। এতে করে এক সাথে বিপুল পরিমাণ পাখি মারা সম্ভব হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পাখি নিধন বন্ধ করতে এরইমধ্যে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা।

বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে যেসব পাখি শিকার করা হয় তার মধ্যে পরিযায়ী পাখির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

সংস্থাটি বলছে, শীতকালে সাময়িক সময়ের জন্য বিপুল পরিমাণ পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে, বিধায় মানুষ এগুলো শিকারও বেশি করে থাকে।

বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিগত বছরের প্রথম ১১ মাসে বন্যপ্রাণী উদ্ধারে মোট ২৯২টি অভিযান চালানো হয়েছে। এসব অভিযানের মাধ্যমে ৩ হাজার ৯২টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে পাখি রয়েছে ২৩৩৩টি।

পাখি গবেষক সারোয়ার আলম দীপ জানান, পরিযায়ী পাখির মধ্যে হাঁস ও সৈকত পাখিই উল্লেখযোগ্য। সৈকত পাখির মধ্যে গুলিন্দা, বাটাম, জিরিয়া প্রজাতির পাখি রয়েছে। জিরিয়া পাখির একটি পরিবার। এর আওতায় ৮-১০ প্রজাতির পাখি রয়েছে।

হাঁস পাখির মধ্যে রয়েছে ল্যাঞ্জা হাঁস, পিয়ং হাঁস, ভূতিয়া হাঁস, নীল-শির হাঁস, গিরিয়া, চখা-চখি উল্লেখযোগ্য। পরিযায়ী পাখি ছাড়াও দেশী বক, ডাহুক, ঘুঘু, হরিতালের মতো দেশী বুনো পাখিও শিকার করা হয়।

কোথায় সবচেয়ে বেশি পাখি আসে?
বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে দুই ধরনের পাখি রয়েছে। একটি হচ্ছে জলচর পাখি। যার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের হাঁস ও সৈকত পাখি রয়েছে। আর আরেকটি হচ্ছে বিভিন্ন জাতের ছোট ছোট পাখি।

জলচর পাখি গণনার জাতীয় সমন্বয়কারী ইনাম আল হক বলেন, এ ধরনের ছোট ছোট পাখি বাংলাদেশে কত আসে তার সঠিক কোন হিসাব নেই। কারণ এদের সংখ্যা এতো বেশি থাকে যে তা গণনা করা সম্ভব নয়। তবে ধারণা করা হয় অন্তত কোটি খানেক হবে।

“এই পাখি সারা দেশে আসে, প্রতিটি গাছে। যার কোন হিসাব নাই। এগুলো কেউ হিসাব করেও না।”

সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে বলে জানান তিনি। কারণ এখানে থাকা গাছে যে পোকা হয়, সেগুলো খেয়েই বেঁচে থাকে এরা।

প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে জলচর পাখি গণনা করা হয়। ২৫ প্রজাতির বুনো হাঁস বাংলাদেশে আসে। এছাড়া ৫০ প্রজাতির সৈকত পাখি আসে। এগুলো মূলত হাওর এলাকা এবং উপকূলের কাঁদাচর ও ঘোলাপানিতে এই জলচর পাখিগুলো বেশি আসে।

পাখি গবেষক সারোয়ার আলম দীপু বলেন, প্রায় ৩০ প্রজাতির হাঁস রয়েছে। প্রতিবছর তিন থেকে সাড়ে তিন লাখের মতো হাঁস পাখি বাংলাদেশে আসে। আর সৈকত পাখির মধ্যে এক থেকে দুই লাখের মতো পাখি আসে। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখের মতো জলচর পাখি বাংলাদেশে আসে।

সবচেয়ে বেশি জলচর পাখি হাকালুকি হাওর এলাকায় আসে। এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি শিকারও করা হয়। এখানে পাখি শিকারে বিষ প্রয়োগ করা হয়। সবচেয়ে বেশি হাঁস পাখি মারা যায়। এছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকা, বাইক্যা বিল এলাকায় প্রচুর পাখি আসে। তবে এই দুই এলাকায় শিকার কম হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুর পাখি আসে। তবে সেখানে পাখি মারার হার কম। তারপরেও প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজারের মতো পরিযায়ী পাখি মেরে ফেলা হয়।

সারোয়ার আলমের মতে, ধানের সাথে বিষ মিশিয়ে পাখি মারার কারণে অনেক বেশি পাখি মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে অনেক বিরল প্রজাতির পাখিও রয়েছে।

বুনো পাখির প্রতি আকর্ষণ কেন?
পাখি গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বুনো পাখি ধরা, মারা, খাওয়া ও পরিবেশন করা কমে এসেছে। কিন্তু এটা এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

২০১২ সালে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী অপরাধ বিষয়ক আইন হওয়ার আগে দেশে নির্বিচারে পাখি মারা হতো। সেসময় এয়ারগানের মতো বন্দুক দিয়ে পাখি মারার প্রচলন ছিল বলে জানান পাখি গবেষক সারোয়ার আলম দীপু।

আইন পাস হওয়া এবং ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কারণে পাখি-মারা-ধরা, কাছে রাখার মতো বিষয়গুলো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা হওয়ার কারণে এটি কমে এসেছে বলেও জানান তিনি।

“এখনো পাখি ধরা-মারা হয়, কিন্তু আগের তুলনায় অনেক কম।”

আলম বলেন, দুর্গম এলাকাগুলোতে এখনো ব্যাপকভাবে পাখি মারা হয়। সেখানে পাখি মারতে বিষ-টোপ ব্যবহার করা হয়। যেসব পাখি মারা হয় তার মধ্যে পরিযায়ী পাখি সবচেয়ে বেশি। এছাড়া কিছু দেশী জলচর পাখিও রয়েছে।

তিনি বলেন, সব মানুষ পাখি মারতে চায় না। সাধারণত যারা উৎসব করতে চায়, কিংবা যারা শৌখিন মানুষ তারা দলবেঁধে পাখি শিকারে নামে।

তবে কোন পাখির মাংসেই কোন ধরনের ঔষধি গুণ নেই। শুধু মাংসের কারণেই পাখি মারা হয়।

পরিযায়ী পাখি যেহেতু এক সাথে থাকে, তখন অনেকে পাখি মারতে আগ্রহী হন।

“এটা হলো উৎসাহ বা শৌখিনভাবেই পাখি মারা হয় আরকি। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে বা অন্য অঞ্চলে যেসব প্রভাবশালী লোকজন তাদের সাথে পাখি শিকারিদের যোগাযোগ থাকে। কারণ এরা নিয়মিত পাখি খায়,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, “যাদের কাছে টাকা আছে, তারা শীতের মৌসুমে একবার-দুইবার করে পাখি খায় আরকি। এটা ট্র্যাডিশনালই চলে আসতেছে।”

জলচর পাখি গণনার জাতীয় সমন্বয়কারী ইনাম আল হক বলেন, মানুষ খাবারেও বৈচিত্র্য খোঁজে এবং এ কারণেই তারা বুনো পাখির মাংস খেতে চায়।

তিনি বলেন, বুনো পাখির মাংস সুস্বাদু নয়। কারণ যেসব পাখি মাছ খায় তাদের মাংসে এক ধরনের গন্ধ থাকে। পোকা ও মাছ যেসব পাখি খায় তাদের মাংসেও গন্ধ থাকে।

“রান্নার সময়েও মাংসের এই গন্ধ দূর করতে অনেক চালাকি করতে হয়। এতো কিছুর পরও মানুষ খেতে চায় শুধু বৈচিত্র্যের খোঁজে।”

তিনি বলেন, “প্রতিদিন যে মুরগি খায়, একদিন বুনো হাঁস খেলো। সেজন্যেই এই আগ্রহটা রয়ে গেছে।”

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, যারা বুনো হাঁস শিকার, রান্না, পরিবেশন এবং যারা খান- তাদের সবাই আইন লঙ্ঘন করেন। বেশিরভাগ সময়েই তারা জানেন যে এটা অন্যায় কাজ।

মি. হক বলেন, মানুষ তার শিকারের স্বভাব থেকেই পাখি শিকার করতো। এটা দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে।

পাখি শিকারের একটি কারণ ছিল এর সহজলভ্যতা। পাখি বিশারদ ইনাম আল হক বলেন, পাখি শিকার করলে যেহেতু খরচ হয় না তাই নিম্নবিত্তরা আগে কৌশলে পাখি শিকার করতো। তবে তার পরিমাণ কম ছিল কারণ পাখি শিকারটা তখন সহজ ছিল না।

“এটা গরীব ও অলস লোকের কাজ ছিল যে সে বন থেকে একটা পাখি ধরবে এবং সেটা সে হয় খাবে না হয় বিক্রি করবে খুব কম দামে।”

তবে বন্দুক ও এয়ারগান আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে পাখি মারাটা সহজ হয়ে গেছে। ফলে যে কেউই চাইলে পাখি শিকার করতে পারতো এবং এক সাথে বেশি পাখি শিকার করাটা তখন সহজ হয়ে গিয়েছিল।

ফলে ধনী পরিবারের যারা বন্দুক ও গুলি কেনার সামর্থ্য ছিল তাদের কাছে পাখি মারাটা একটা বিলাসিতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

“একটা পাখি মারতে হয়তো হাজার টাকা খরচ হয়ে গেলো কিন্তু তারপরও তারা খুশি, কারণ এটা বিলাসিতায় পরিণত হয়েছিল।”

বর্তমানে পাখি শিকার শুধু মাংস খাওয়া ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই বলে জানান তিনি।

এয়ারগান না থাকলেও এখন বিষ প্রয়োগ করে পাখি শিকার করার প্রবণতা বেড়েছে বলে জানান মি. হক। এর ফলে খুব অল্প খরচে বিষ দিয়ে অনেক বেশি পাখি মারা হয়। পরে সেগুলো বাজারে মাংস হিসেবে বা রান্না করে বিক্রি করা হয়।

পাখি বিশেষজ্ঞ শরিফ খান বলেন, বাংলাদেশে পাখি শিকার করা হয় শুধুমাত্র মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে। এর পেছনে আর তেমন কোন কারণ নেই বলে জানান তিনি।

“মাংস বৈচিত্র্যের জন্যে, ওইটা খাওয়ার জন্যে ওইটা করে, আর কোন কারণ নাই।”

তিনি বলেন, পাখিদের মধ্যে পরিযায়ী পাখি যেহেতু বছরের দুই-তিন মাসই পাওয়া যায়, তাই এসব পাখি শিকারে আগ্রহ বেশি।

“এটা একটা ঐতিহ্য হয়ে গেছে। ধরেন মেয়ে বাড়ি, শাশুড়ি বাড়ি, জামাই বাড়ি আগে পাখি-টাখি দিতো। এটা একটা ঐতিহ্য ছিল। এটা এখন কমে গেছে।”

আবার গ্রামীণ এলাকার কোথাও কোথাও বুনো টিয়া, ঘুঘু বা ময়না ধরে পোষার প্রবণতাও দেখা যায়। যদিও এ ধরনের প্রবণতা বর্তমানে অনেক কমে এসেছে।

বন্ধ হচ্ছে না কেন?
পাখি বিশারদরা বলছেন, যে পরিমাণ অপরাধের ঘটনা কর্তৃপক্ষের হিসাবে উঠে আসে তা মোট সংঘটিত অপরাধের এক দশমাংশেরও কম।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস বিবিসি বাংলাকে বলেন, দেশের যেকোন জায়গায় বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত যেকোন অপরাধের খবর পেলেই সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন তারা।

এছাড়া দেশের যে অঞ্চলগুলো হটস্পট হিসেবে পরিচিত সেখানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সহায়তায় জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হয়।

“কারণ আমরা সব সময় রুট লেভেলে পৌঁছাতে পারি না, তাই আমরা ভলান্টিয়ারের হেল্প নিয়ে থাকি।”

তবে এরপরও বুনো পাখির শিকার বন্ধ না হওয়ার বিষয়ে মি. বিশ্বাস বলেন, “বন্ধ হচ্ছে না কারণ এটা আসলে এক ধরনের ক্রাইম। যেসব জায়গায় এ ধরনের ক্রাইম ঘটে, যারা ঘটায় তাদের বিচারের আওতায় আনা।”

তিনি বলেন, তারা তাদের ইউনিট থেকে এ ধরনের ক্রাইমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। বন্যপ্রাণী বা বন্যপাখি শিকার ও নিধন বিষয়ক অপরাধ কমিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এবং মোবাইল কোর্টের সহায়তায় অপরাধের সাথে জড়িতদের তাৎক্ষণিক সাজার আওতায় আনা হয়।

“আমরা আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সব জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করি।”

পাখি শিকারের বিষয়ে মি. বিশ্বাস বলেন, বুনো পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিকার বা নিধনের মুখে পড়ে পরিযায়ী পাখি। এর কারণে হিসেবে তিনি বলেন, “সাময়িকভাবে এই পাখিগুলো যেহেতু আসে, এবং কিছু দিন পর আবার চলেও যায়, সার্বক্ষণিক থাকে না, তাই মানুষ এই ক্রাইমটা করতে চায়।”

তবে পাখি নিধনের ঘটনা আগের তুলনায় কমে এসেছে বলে জানান তিনি।