ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৮, মার্চ ২০২৪ ১৬:২১:৫৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
বিশ্বে প্রতিদিন খাবার নষ্ট হয় ১০০ কোটি জনের বাসায় পর্যবেক্ষণে থাকবেন খালেদা জিয়া ট্রেনে ঈদযাত্রা: ৭ এপ্রিলের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু গাজায় নিহত বেড়ে ৩২ হাজার ৪৯০ অ্যানেস্থেসিয়ার ওষুধ বদলানোর নির্দেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঈদ কেনাকাটায় ক্রেতা বাড়ছে ব্র্যান্ড শপে বাঁচানো গেল না সোনিয়াকেও, শেষ হয়ে গেল পুরো পরিবার

আম্মা: স্বর্গ থেকে এসে আবার স্বর্গেই ফিরে গেছে

শাহানা হুদা | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:৫১ এএম, ১৩ জানুয়ারি ২০২২ বৃহস্পতিবার

ছবি: শাহানা হুদার ফেসবুক থেকে।

ছবি: শাহানা হুদার ফেসবুক থেকে।

আম্মা দুই বছর আগে চলে গেল একদম কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘুমের মধ্যে। এত আরামের মৃত্যু আমাদের অনেকের কাম্য হলেও কয়জন পাবো এভাবে চলে যাওয়ার স্বাদ, জানিনা। তবে আম্মা পেয়েছে। 
জীবনে নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আম্মা তার নিজের বাসায় প্রবেশ করার পর শান্তিতে চোখ বন্ধ করেছে। আম্মার খুব আশংকা ছিল নিউকলোনির সেই বাসাটি, যে বাসাটিতে সে নতুন বউ হয়ে ঢুকেছিল ১৯৬৪ সালে, রিনোভেশনের পর সেখানে আবার ঢুকতে পারবে কিনা? 
আব্বার সংসারে আম্মার জীবনে সুখ আর শান্তি অকুন্ঠ পরিমাণে থাকলেও, আরাম-আয়েশ, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা খুব একটা ছিল না। আব্বার সাংবাদিকতার জীবন ছিল চ্যালেঞ্জিং। নানাধরণের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে এই দম্পতিকে। 
সীমিত আয়ে আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আব্বা-আম্মার হয়তো ভালোই থাকতো। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। বিয়ের পর থেকেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আম্মা-আব্বার ছিল সরাইখানা টাইপ সংসার। একমাত্র ঈদের দিন ছাড়া আমরা দুই ভাইবোন ও আব্বা-আম্মা, এই চারজন এক সাথে ভাত খাইনি।
নিউকলোনির ছোট বাসা, সাংবাদিকতার সংগ্রামী জীবন, নিয়মিত অনিয়মিত বেতন-ভাতা, একধরণের টানাটানির মধ্যেও আমাদের বাসায় অগণিত মানুষ থেকেছে, পড়াশোনা করেছে, চাকরি খুঁজেছে, চাকরি পেয়েছে, ব্যবসা করেছে, বেড়াতে এসেছে, চিকিৎসার জন্য এসেছে, বিদেশযাত্রা করেছে, বিদেশ থেকে এসেছে। 
গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ এসেছে আব্বার কাছে কাজের প্রয়োজনে, ঠিক একজন রাজনীতিবিদের কাছে যেমন আসে। আমাদের বাসার কোন অতিথি স্থায়ী, কেউ স্বল্প স্থায়ী, কেউবা অস্থায়ী ছিল। এদের আহার বাসস্থান সব ছিল এই কলোনির বাসায়। আর আম্মাকেই ব্যবস্থা করতে হতো সংসার খরচের সীমিত টাকা থেকে।
আমাদের বাসায় কোন ড্রয়িংরুম ছিল না। ছিল না মাস্টার বেডরুম বা চিল্ড্রেন’স রুম। ছিল না পড়াশোনার জন্য কোন জায়গা। সব ঘরই ছিল গেস্টরুম বা বেডরুম। দিনে রাতে মিলিয়ে ২০/২২ জনের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হতো আম্মাকে। নিজের শোয়ার ঘরও সকাল হওয়া মাত্রই আব্বার লোকজনের জন্য ছেড়ে দিতে হতো। 
ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখেছি এই বাসা সবার, বিছানাও আমাদের একার নয়, পড়ার টেবিলও শেয়ার করতে হবে, খাবার ভাগ করে খেতে হবে। মুরগি বা মাছ রান্না হলে এক টুকরা  পাবোই এরও কোন নিশ্চয়তা থাকবে না। সব মেনে নিয়ে থাকতে হবে। আমরা তাই ছিলাম। এর ফলে আমাদের যে একটা সোশালাইজেশন হয়েছে, একথা মানতেই হবে। 
ঈদ-পর্ব ছাড়া আম্মার তেমন কোন ভাল কাপড় খুব একটা কেনা হয়ে উঠতো না। সত্যিকার অর্থে আম্মার কোন ব্যক্তিজীবন ছিল না। পুরোটাই ছিল মায়ের জীবন, সংসারের দায়িত্ব বহণকারী নারীর জীবন, স্বামীর সাথে পথ হাঁটার জীবন। 
আব্বা যেভাবে মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে, আম্মা স্ত্রী হিসেবে সেই হাতকে আরো বহুগুণ শক্তিশালী করেছে।
আম্মাকে দেখেছি তার খন্ডকালীন অবসরে পেপার ও ম্যাগাজিন পড়তে, রেডিওতে নাটক শুনতে, ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনতে এবং মাঝেমধ্যে চোখে রোদ চশমা লাগিয়ে নিউমার্কেটে যেতে। 
আব্বার সাথে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়াটা ছিল আম্মার কাছে খুব আনন্দের স্মৃতি। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় বসে সবাই মিলে হাসি-গল্প করা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় পারিবারিক বিনোদন।
আম্মা মাঝেমাঝে বিরক্ত হলেও এই সরাইখানা টাইপ বাসাটার সব মানুষের থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য অনেক ব্যবস্থাই আম্মাকে করতে হতো। আমাদের কারো পড়াশোনাই হতো না আম্মার শাসন ছাড়া। 
আব্বা চলে যাওয়ার পর ঢাকা শহরের এই কঠিন জীবনেও আম্মা কাউকে ফিরিয়ে দেয়নি। তার কাছে যখন, যা ছিল তাই দিয়েই সাহায্য সহযোগিতা করেছে। সবসময় আল্লাহকে ডেকেছে। আমাদের সৎ পথে থাকার কথা বলেছে। 
আমি জানি আম্মা যে দায়িত্ব পালন করেছে তার সারাটা জীবন ধরে, তার শতভাগের একভাগও এখন আর কেউ করবে না, করেও না। এমনকী আমিও এত বড় দায়িত্ব পালন করবোনা, তা নিশ্চিত। আমরা সবাই এখন নিজের সংসার নিয়ে একা শান্তিতে থাকতে চাই। 
সত্যি কথা বলতে চারপাশে পরিচিত মানুষের মধ্যে সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, ভালবাসাহীনতা, কূপমণ্ডকতা ও অসহযোগিতার মনোভাব দেখে দেখে আম্মাকে মনে হয় স্বর্গলোক থেকে আসা একজন মানুষ। যে স্বর্গ থেকে এসে আবার স্বর্গেই ফিরে গেছে।