ঢাকা, শনিবার ২০, এপ্রিল ২০২৪ ১৭:২২:৪৬ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউ পুড়ে ছাই, রক্ষা পেল ৭ শিশু সবজির বাজার চড়া, কমেনি মুরগির দাম সারা দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন প্রধানমন্ত্রী চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি শিশু হাসপাতালের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে

চেনা বামণের পৈতা লাগে না: মাহাসরূপা টুবন

মাহাসরূপা টুবন | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৬:২৪ পিএম, ৯ জুলাই ২০২১ শুক্রবার

মা হাসিনা খাতুনের সাথে মাহাসরূপা টুবন

মা হাসিনা খাতুনের সাথে মাহাসরূপা টুবন

‘চেনা বামণের পৈতা লাগে না’-কথাটা বলতেন আমাদের বাবা। আমরা তখন মায়ের চাকরির সুবাদে গোপালপুরে থাকতাম, সালটা সম্ভবত ১৯৮৬-৮৭। আমাদের মা হাসিনা খাতুন তখন কেয়ার বাংলাদেশের ডব্লিউ ডিপি প্রোগ্রামের টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর ব্রাঞ্চের প্রোগ্রাম অফিসার ছিলেন। তাই পুরো অফিসের দায়িত্ব তার উপর থাকায় তাকে অনেকটা সময় অফিসে দিতে হতো। আর সেই জন্য আমরা চার ভাই-বোন যেমন সেল্ফ-ডিপেন্ডেন্ট ছিলাম তেমনি ছিলাম ভীষণ দুষ্টু। তবে লক্ষীও ছিলাম। বাইরের কারো সাথে ঝগড়া বা মারামারি করতাম না। 

কিন্তু মা যখন অফিসে থাকতেন আর বাবা যখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বাইরে যেতো তখন প্রায়ই আমরা চার ভাই-বোন খেলতে খেলতে মারামারি করতাম। মজার বিষয় হলো সেই মারামারির ধরণ ছিলো ভীষণ মজার। তখন মফস্বল শহরে দরজার সিকিউরিটি মজবুত করার জন্য এক ধরনের কাঠের চার কোণা লাঠি ব্যবহার করা হতো। সেটার নাম ডাঁশা। ওই ডাশা ছিলো আমাদের যুদ্ধের একমাত্র অস্ত্র। আমরা চারজন ঘরের মধ্যে দুই দলে ভাগ হয়ে যুদ্ধ করতাম। যুদ্ধের এক পর্যায়ে দল বদল হয়ে যখন কেউ একা হয়ে যেতো তখন  তার আত্মরক্ষার অবলম্বন ছিলো বিছানা। তিনজন যখন তিনদিক থেকে আক্রমণ চালাতো তখন যে একা থাকতো সে দৌড়ে বিছানার ওপরে উঠে ওই দরজার ডাশাটা (কাঠের লাঠি) চারদিকে ঘুরিয়ে নিজেকে রক্ষা করতো। 

যুদ্ধ শেষে বাড়িঘর খুব অগোছালো থাকতো। বাবা বাসায় এসে আমাদের তার আর্মি স্টাইলের শাস্তি দিতেন। একেকটা শাস্তি ছিলো ভয়ংকর লেভেলের। একটা শাস্তির ধরণ এখনো আমাদের চার ভাই-বোনের মনে আছে। বাড়ির উঠানে চারজনকে এক লাইনে দাঁড়া করিয়ে হাতের ওপর ভর করিয়ে পা দুটো দেয়ালের ওপরে উঠিয়ে রাখা হতো। যে পা নামিয়ে ফেলতো তার পায়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে দুই ঘা লাগিয়ে দিতেন বাবা। এই শাস্তি বাবা আমাদের প্রায়ই দিতেন। একদিন এই শাস্তির পরিমাণ এতোটাই মারাত্মক হয়েছিল যে পাশের বাসার আন্টি এসে আমাদের রক্ষা করেছিলেন। তিনি বাবাকে ইচ্ছেমত বকেছিলেন। আমাদের রাগী বাবা সেদিন আন্টিকে কিছুই বলেননি। কারণ সেদিন শাস্তি দিয়ে বাবাও ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। 

আহারে কোথায় হারিয়ে গেলো ছোটবেলার আমাদের ভাই-বোনদের সেই খুঁনসুটি! কোথায় হারিয়ে গেলো আমাদের সোনালি দিনগুলো! আর কোথায় হারিয়ে গেলেন আমাদের সেই প্রাণের প্রিয় আত্মভোলা, পরোপকারী বাবা! আমার বাবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গাজী মোশাররফ হোসেন বাবু। তিনি একজন সহজ-সরল, ভালো মানুষ ছিলেন। যে বাবা বাজার আনতে গিয়ে দরিদ্র মাছ ব্যবসায়ীকে চালান হারিয়ে কাঁদতে দেখে বাজারের সব টাকা ওই মাছওয়ালাকে দিয়ে আসেন। পরে মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার বাজার আনেন। আমাদের সেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বাবা যিনি মনে করতেন, ‘যুদ্ধ করেছি দেশকে মুক্ত করার জন্য, নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য নয়।’ আর তাই তো তিনি বলতেন, ‘চেনা বামণের পৈতা লাগে না।’  এ কারণেই কখনোই তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেতে চাননি। 

আমার বাবা ছিলেন মুজিব সৈনিক। একবার মায়ের পিড়াপিড়িতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘আমি কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ আনবো না।’ 

আমার বাবা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছুটি নিয়ে তিনি টাঙ্গাইলে চলে আসেন। এ সময় তিনি মির্জাপুর থানার গোড়ান গ্রাম ও আশেপাশের কয়েক গ্রামের যুবকদের বাঁশের লাঠি ও গাঁদা বন্দুক দিয়ে ট্রেনিং করিয়েছেন। আর তাইতো সনদ ছাড়াই ২০১০ সালের ১৪ জুন আমার বাবাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে। আমার বাবার কথায়ই ঠিক হয়েছিল। আসলেই চেনা বামণের পৈতা লাগে না।

কিন্তু বাস্তব যে বড় কঠিন। তাই তো আমার সংগ্রামী মা জীবন যুদ্ধের কষাঘাতে বাধ্য হয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম উঠিয়েছেন আমার বাবার। আর এ কাজে আমার মাকে সহযোগীতা করেছেন, আলম কাকা, মুকুল কাকা, আমাদের ছোট খালু টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খন্দকার আনোয়ার হোসেন, আমার ছোট বোনের স্বামী শেখ মঞ্জুর বারী মঞ্জু এবং আমাদের স্থানীয় এলাকাবাসী। আমরা তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।

স্যালুট আমার মাকে যিনি জীবনে কোনো কাজে হার মানেননি। স্যালুট আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে যিনি আমৃত্যু দেশের জন্য কাজ করেছেন। ওপারে ভালো থাকবেন বাবা। একজন মুক্তিযোদ্ধা ও একজন পরোপকারী মানুষ হিসেবে আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।