ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ১৩:০২:১২ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে হাসপাতালে প্রধান উপদেষ্টা খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতি গর্ব করবে : প্রধান উপদেষ্টা তলবের ১০ মিনিটেই হাজির জেডআই খান পান্না, চাইলেন নিঃশর্ত ক্ষমা ‘পরিবেশ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করছে সরকার’

দিল্লিতে প্রদর্শনী: ঢাকাই জামদানির ঐতিহ্যের জয়গান

অনলাইন ডেস্ক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:১০ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রবিবার

ছবি: সংগ্রহিত।

ছবি: সংগ্রহিত।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প ঢাকাই জামদানি নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। সেখানকার ন্যাশনাল ক্র্যাফটস মিউজিয়াম ও হস্তকলা অ্যাকাডেমিতে এই সপ্তাহান্তে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের জামদানির বিরল প্রদর্শনী। 

এতে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতি জগতের নামকরা ব্যক্তিত্বরা। এই আয়োজন শুধু শাড়ির প্রদর্শনী নয়, বরং বাংলাদেশের এক অনন্য শিল্প ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার এক বিরল প্রচেষ্টা।

এই প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছেন ভারতের নতুন নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি যখন উমরাওজান সিনেমার পরিচালক মুজফফর আলির সঙ্গে এই আয়োজন নিয়ে আলোচনা করেন, তখনই বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। 

পরিচালক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, আমি তো আসবই, আমি উমরাওজানে রেখাকে জামদানি পরিয়েছি... আর দিল্লিতে জামদানি নিয়ে কাজ হলে আমি আসব না? 

শেষ পর্যন্ত তিনি কথার মান রেখেছেন। প্রদর্শনী শুরু হয়েছে শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর), যার মূল উদ্দেশ্য— ভারতীয় শাড়িপ্রেমীদের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং এই শিল্পকে আরও ব্যাপক পরিসরে তুলে ধরা।

উদ্বোধনীতে মুজফফর আলি স্বয়ং হাজির হয়ে শাড়ির সম্ভার ঘুরে দেখেন। প্রতিটি জামদানির নকশা ও বুননের সূক্ষ্মতা খুঁটিয়ে দেখেন তিনি এবং প্রশংসা করতে ভোলেননি। শুধু তাই নয়, তাঁতিদের সঙ্গে ছবি তুলতেও ভিড় করেন। 

একইভাবে ভারতের নামী ইন্টিরিয়র ডিজাইনার সুনীতা কোহলি, যিনি রাষ্ট্রপতি ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মতো ঐতিহাসিক ভবন সাজিয়েছেন, তিনিও এই প্রদর্শনীর অন্যতম মেন্টর। তার উপস্থিতি এবং মূল্যায়ন এই আয়োজনকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

জামদানি এমন এক টেক্সটাইল, যা বুনতে লাগে ওস্তাদ ও সাগরেদ— অন্তত দু’জন তাঁতি একসঙ্গে কাজ না করলে এর সূক্ষ্ম নকশা সম্ভব নয়। প্রতিটি জামদানি বোনা হয় হাতে, যেখানে কোনো যন্ত্র বা পাওয়ার লুমের ব্যবহার নেই। একেকটি শাড়ি বুনতে লাগে সাত দিন থেকে শুরু করে সত্তর দিন। আবার কখনো তা ১৭০ দিন পর্যন্ত সময় নিতে পারে। এজন্যই জামদানিকে শুধু শাড়ি নয়, বরং ‘তাঁতে বোনা শিল্পকর্ম’ বলা হয়। 

রাষ্ট্রদূত হামিদুল্লাহ বলেন, ‘প্রতিটি জামদানি আসলে আলাদা একেকটা কবিতা।’

এই প্রদর্শনী কিউরেট করেছেন চট্টগ্রামের চন্দ্রশেখর সাহা ও রাজস্থানের চন্দ্রশেখর ভেডা। দুজনেই আহমেদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনের সাবেক শিক্ষার্থী এবং দীর্ঘদিনের বন্ধু। সাহা বহু বছর ছিলেন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ‘আড়ং’-এর প্রধান ডিজাইনার, আর ভেডা ভারতের ‘স্পাইডার ডিজাইন’-এর কর্ণধার। 

তাদের মতে, জামদানির আসল শক্তি হলো— এটি এখনো পুরোপুরি হাতে তৈরি। চন্দ্রশেখর ভেডা বলেন, ‘ফাস্ট ফ্যাশনের যুগেও জামদানি টিকে আছে, কারণ প্রযুক্তি কখনোই এই শিল্পকে প্রতিস্থাপন করতে পারেনি।’

জামদানির কারিগররা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শীতলক্ষ্যার তীরে এই কাজ চালিয়ে আসছেন। তাঁতিরা বিশেষ এক ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলেন, যা বাইরের কারও বোঝার উপায় নেই। জামদানির নকশা লুকিয়ে থাকে অঙ্কের ছন্দ, কবিতার লাইন আর রঙের মিশেলে— যার কোনো লিখিত নকশা থাকে না। এজন্য প্রতিটি জামদানি একক এবং অনন্য। চন্দ্রশেখর সাহা এটিকে বলেন ‘ওভেন আর্ট’— তাঁতে বোনা শিল্প।

ভারতের বাজারে ঢাকাই জামদানির ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন কলকাতার ব্যবসায়ী অর্পিতা ভাদুড়ী। 

তিনি বলেন, ‘আসল মসলিন এখন অতি দুষ্প্রাপ্য, কিন্তু জামদানির দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই।’ তাই এটি অনেকের কাছে ‘পুওর ম্যানস মসলিন’ নামে পরিচিত। 

তবে রাষ্ট্রদূত হামিদুল্লাহ সতর্ক করে দেন, ‘জামদানিকে কখনো মাস প্রোডাক্ট হিসেবে দেখা উচিত নয়, কারণ প্রতিটি জামদানির আলাদা গল্প আছে।’

বাংলাদেশ কি জামদানিকে কেবল আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য ব্যবহার করছে? 

এই প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত হামিদুল্লাহ বলেন, ‘আমার ব্র্যান্ডিং শব্দটায় আপত্তি আছে। বরং বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরার অন্যতম প্রতীক হিসেবে আমরা জামদানিকে ব্যবহার করছি।’

তার মতে, মানুষ যদি জামদানির সঙ্গে পরিচিত হয়, তবে এর বিরলতাই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করবে, আলাদা কোনো প্রচারণা ছাড়াই।

পদ্মার ইলিশ যেমন বাংলাদেশের পরিচিত প্রতীক, তেমনি জামদানিও এখন সেই জায়গায় জায়গা করে নিতে পারে। প্রদর্শনীতে অনেক দর্শকই মন্তব্য করেছেন— ‘মাছের রাজা ইলিশ না হয় না-ই বা পাওয়া গেল, কিন্তু শাড়ির রানি জামদানিতে লোভ তো দেওয়া যায়।’

ভারতের রাজধানীতে এই প্রদর্শনী শুধু শাড়ি বিক্রির উদ্দেশ্যে নয়, বরং দুই দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক সেতুবন্ধন হয়ে উঠেছে।

ঢাকাই জামদানি কেবল একটি শাড়ি নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্পের অনন্য পরিচায়ক। দিল্লির প্রদর্শনী সেই ঐতিহ্যকে নতুনভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের তাঁতিদের নিবেদিত সাধনা ও শীতলক্ষ্যার বিশেষ পরিবেশের কারণে এই শিল্প টিকে আছে আজও। তাই বলা যায়, জামদানি শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। 

তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা