ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৫, এপ্রিল ২০২৪ ২১:৪২:৪৫ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
যুদ্ধ কোনো সমাধান দিতে পারে না, এটা বন্ধ হওয়া উচিত: প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন মা আরও ৩ দিন হিট অ্যালার্ট জারি যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার বিল সিনেটে পাস

দেশভাগ: স্মৃতির আলোয় পারমধুদিয়ার বসু পরিবাস

তপতী বসু | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ১২:৫৩ এএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ বুধবার

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

আজ থেকে আশি, নব্বই বছর আগে খুলনা জেলার পারমধুদিয়া গ্রাম৷ আমার ঠাকুরদাদাদের সাত ভাইয়ের এক সাধারণ ঘর-সংসার। যেমনটা সেই সময় ছিল অনেকের৷ একটি পুকুর, তাতে নারকেল, তালগাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো ‘ঘাট’৷ সে ঘাটে বসে বসে ঠাকুরমায়েরা সাত জা বাসন মাজেন, কুটে রাখা মাছ-তরকারি, শাকসহ হাবিজাবি ধুয়ে আনেন৷ একটি ঢেঁকি, সেখানে পালা- পার্বণে চাল কুটে পিঠে বানানো হয়৷ উড়কি ধান ভেজে কোটা হয়  চিঁড়ে৷ তার সুবাস ছড়িয়ে যায় বাতাসে৷
মেঝো-সেজো ঠাকুরদার তরুণ ছেলেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোলকাতা, খুলনা, পিরোজপুরসহ এদিক ওদিক থাকেন৷ বাড়ির প্রয়োজনে বা উৎসবে  আবার সবাই একসাথ হওয়া৷  ‘গাছ তলার  পূজা’র সময়তো অবশ্যই৷ মাটির ঘর, পাতায় ছাওয়া কুটীর তখন  আনন্দ চেপে রাখতে পারেনা৷ খই ফোটার মতন ছিটকে যায় গুবাক সারির ফাঁক এড়িয়ে বামুন বা ঘোষ পাড়ায়৷ 
আশির দশকে আমি মায়ের কাছে বসে গল্প শুনতাম আমার সেই না দেখা ঠাকুরদা-ঠাকুমাদের৷  সন্ধ্যার আলো আর অন্ধকার আমাদের উঠানে লুকোচুরির আলপনা এঁকে যেতো! মায়ের গল্প বলার গুনগুন সুরে আমি আরো একটু এগিয়ে বসতাম তাঁর সাদা আঁচলের পাশে৷ না ছোঁয়া সেই পূণ্যভূমি আমার চোখে স্বপ্ন মাখিয়ে দিত৷ আধো গলার অস্ফূট স্বরে আমি জিজ্ঞাসা করতাম ‘তারপর...!’ 
কখনও মায়ের মুখে লাগত চাঁদের আলো! অসমাপ্ত গল্পের ফাঁকে একটুখানি পান মুখে দিয়ে মা কথা বলতেন, আবারো গল্প শুরু  করতেন৷   
আমার সাত দাদুর একজন ছিলেন সংষ্কৃত পণ্ডিত৷ তুলোট কাগজে চুবানো কালিতে তিনি ধীরে ধীরে লিখতেন কবিতা৷ সংষ্কৃত এবং সংষ্কৃত থেকে বাংলা অনুবাদে তিনি তখন অদ্বিতীয়।মাঝে মাঝে ডাক আসতো কোলকাতা থেকে৷ প্রায়ই যেতেন  সেখানে, আসবার সময় সাথে আনতেন এটা ওটা..৷
কোনো দাদু দেখতেন  চাষাবাদ- ‘ঠিক মতন ধান না উঠিলে ছেলেপিলে নিয়ে না খাইয়া মরিতে হইবে...!’  
আমার নিজের দাদু যিনি, তিনি সব কিছুতেই দাদাদের দিকে অলস মুখখানি তুলে রাখতেন৷ তাঁরা যা বলেন, তাতেই সায় তাঁর!  গৃহবাসী ন’দাদু, সংসারে সবার দিকে তাঁর সমান দৃষ্টি-ভালোবেসে ভালো রাখার৷ 
সবাইকে খাইয়ে প্রলম্বিত দুপুর গড়িয়ে যেতো শেষ বিকেলে৷ ঠাকুমায়েরা দল বেঁধে খেতে বসবেন৷ ন’দাদু জানতেন হাড়ি-কড়াই ঢনঢন৷ ছয় ভাই আর সবার সন্তানদের খাওয়া হলে তখন তিনি খেতে আসতেন৷ জানতেন সেদিন তরকারি-মাছ কোন কোন পদ রান্না হয়েছে৷ থালায় হাত দেবার আগেই নির্দিষ্ট করে একটা পদের আবদার করতেন৷ কারো তিনি দেওর-কারো ভাসুর৷ সবাই তাঁকে ভালোবাসেন৷ তাড়াতাড়ি নতুন করে নিভন্ত উনুনে তৈরি হোত মনোনীত রান্না৷ তিনি একটুখানি নিয়ে বলতেন, ‘এখন তোমরা  বসো, আমি তোমাদের খেতে দেবো...৷’ জানতেন, বৌদের জন্যে শেষ পাতে কিছুই থাকে না। তাই এমন মধুর ছলনা৷ 
নিজে জাল ফেলে মাছ ধরতেন। যতটুকু দরকার ধরা হলে উঠে আসতেন৷ বাড়িতে ছেলের সংখ্যা বেশি। তাদের পড়াশুনার দিকে তাঁর খেয়াল। তার খবরদারী সবার মেনে নিতে কোনো সমস্যা ছিলনা৷ এক কথায়, সেই সময়ে অনেক বাড়িতেই এমন সব দিনলিপি ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক ৷ 
এমন কত যে টুকরো গল্প আজও আমার স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল৷ বাস্তব কল্পনার চোখে আমি আরো অনেকটা এগিয়ে যাই৷ রাত গভীরে কোনো এক ঠাকুমা স্বামীকে বারবার জানাতেন, ‘এতো পরিশ্রমে কী লাভ!’ কোনো একজনের মনে ভাবনা, কোলকাতা থেকে আনা টাকা-পয়সা সবইতো জলস্রোতের মতন সংসার সমুদ্রে চলে যাচ্ছে...লাভ কী? ঠাকুরদাদারা সব শুনেও না শুনে নাক ডাকছেন৷ ‘যত যাই বলো, আমরাতো আলাদা হবোনা...৷’  সকালে আবার যে যার ভূমিকায় নিজেরা নিয়োজিত হতেন৷
তারপর একদিন, ১৯৪৭ সালের শ্রাবণ সন্ধ্যা নেমে এসেছে৷ শেষ বিকেলে যে বৃষ্টি নেমেছিল, বাঁশবাগানের জুলি দিয়ে সেই জল নেমে যাচ্ছে প্রবল বেগে ৷ নালি মুখে আমার কোনো এক কাকা পেতে রেখেছিলেন মাছ ধরার বৈইছ্নে৷ জলবোঁড়া আর পূঁটিমাছ বেঁধে সেখানে একসাথে৷  বড়ো ঠাকুমা তাঁর লাল পেড়ে শাড়িটা পরে তুলসী তলায় প্রদীপ তুলে ধরেছেন৷  সেই  সময়  ন’দাদু খড়মজোড়া খটখটিয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে সোনা দা? তুমি এমন অসময়ে!’
বাগেরহাট স্টেশনে নেমে নৌকা করে বাড়ি ফিরেছেন সেদিন আমাদের সোনাদাদু৷ সেদিন তাঁর হাত ছিল শূন্য, কারো জন্যে কিছু আনেননি ৷ বলা ভালো, আনতে পারেননি! খবরের কাগজ তখনও আসেনি, রেডিও নেই৷ তাই পারমধুদিয়া গ্রামের কোনো মানুষ জানতেন না এক মহা বিপর্যয়ের কথা৷  উচ্চ কণ্ঠেস্বরে একে একে এগিয়ে এসে গ্রামবাসী শুনলেন এক আশ্চর্য সংবাদ—‘দেশ ভাগ হয়ে গেছে’!
কবে কখন পারমধুদিয়ার বসু পরিবার ঘামে জলে, পাতায়-মাটিতে, হাসি আর কান্নায় বসতি গড়ে তুলেছিলেন৷ সেখান থেকে নাকি এবার চলে যেতে হবে অপরিচিতের দেশে৷ সেখানে কেন যাব আমরা...কে চেনে আমাদের...খাবো কী...! এমন অজস্র প্রশ্ন সে রাতে সেই মাটির ঘরের প্রদীপের আলোয় ঘুরতে লাগল! উত্তর দেবার জন্যে কোথাও কেউ সেদিন ছিল না। তারপরও আর কারো কাছে কোনো উত্তর মেলেনি!
কয়েক বছরের মধ্যেই সাত ভাইয়ের বসু পরিবার আর পারমধুদিয়ার ঘন জনবসতি খই ফোটার মতন ছিটকে গেলো এখানে- ওখানে-সেখানে৷ আর কোনোদিন তাঁরা একসাথ হতে পারেনি৷ ঠাকুমায়েরা বারবার বলেও ভালোবাসার-স্নেহের-মমতার   পাথরে আঁচড় কাটতে পারেননি৷ 
অথচ কোথা দিয়ে কীভাবে, কারা যে বসু পরিবারের মতন খান-রায়-শেখ পরিবারের বন্ধন পাথরের মতই টুকরো করে পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল! পঁচাত্তর বছর পর আজও অনেকের কাছে সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনা!