ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ১:২১:৪৬ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
আজ আসছে না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা পেছাল খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে জুবাইদা রহমান ‘শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের ইতিবাচক সাড়া নেই’ বেশির ভাগ সবজিই ৬০-৮০ টাকার ওপরে বন্যায় সহায়তা: বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী

নারী অভিবাসী: মরদেহ ফেরার লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৩:২৬ পিএম, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সোমবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদিন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামছে বিদেশফেরত অনেক প্রবাসী শ্রমিক। কেউ ফিরছেন সাফল্যের গল্প নিয়ে, হাতে এনেছেন পরিবারের জন্য সুখস্বপ্ন। আবার কারও ফেরা হয় নিথর দেহে, কাঠের কফিনে বন্দি হয়ে। কফিনের ঢাকনা খোলার পর পর্দার আড়াল থেকে শোনা যায় হাহাকার—“আমার মেয়েটা কি করে মারা গেল?”

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার নারী গৃহকর্মী, নার্স বা কারখানার শ্রমিক হিসেবে পাড়ি জমান আরব উপসাগরীয় দেশগুলো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। স্বপ্ন থাকে পরিবারকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করা, সন্তানের পড়াশোনা চালানো কিংবা একটি ঘর তৈরি করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেকেই জীবিত দেশে ফেরেন না।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) তথ্য বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে মোট ১৯ হাজার ৪৯৫ জন অভিবাসী শ্রমিকের মরদেহ বাংলাদেশে ফিরে আসে। এর মধ্যে নারী ছিলেন ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে—কারণ অনেকে বিদেশের মাটিতেই দাফন হন।

‘স্ট্রোক নয়, বোনকে খুন করা হয়েছে’

নরসিংদীর মাধবদীর সাজেদা আক্তার বয়সে ৫৬। সংসারের হাল ধরতে তিনি গিয়েছিলেন জর্ডানে। পরিবারের কাছে পাঠানো রিপোর্টে লেখা হয়—তিনি নাকি স্ট্রোক করে মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর ভাই নূর মোহাম্মদ বললেন, “আমার বোন তো একদম সুস্থ ছিল। হঠাৎ খবর এলো, সে নাকি ভবন থেকে পড়ে গেছে। এটা দুর্ঘটনা নয়, খুন করা হয়েছে।”

কফিন খুলে বোনের দেহে চোটের দাগ দেখে তাঁর সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। কিন্তু বিদেশের মাটিতে সেই মৃত্যুর কারণ আজও অধরা থেকে গেছে।

রামরুর সাম্প্রতিক এক জরিপে ১০০ মৃত নারী অভিবাসীর পরিবারের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা যায়, তাঁদের ৭৬ শতাংশ গৃহকর্মী ছিলেন। অর্ধেকের বেশি পরিবার আগে থেকেই জানত—প্রিয়জন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

মৃত্যুর সংখ্যা, অস্বাভাবিকতার হার

রামরুর গবেষণা জানায়, মৃত্যুর ৮৩ শতাংশই ঘটে শ্রমগ্রহণকারী এশীয় দেশগুলোয়। সৌদি আরবে, যেখানে ৬৭ শতাংশ নারী অভিবাসী কাজ করেন, সেখানে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি—৩৮ শতাংশ। জর্ডান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতেও মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

মৃত্যুর ৩২ শতাংশ ঘটে অপ্রাকৃতিক কারণে—যেমন নির্যাতন, দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা। অথচ অনেক মৃত্যুই পরে সরকারি কাগজে লেখা হয় ‘প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু’। ফলে পরিবারের প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে না।

রামরুর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, “আমাদের দেশে নারী অভিবাসীদের ৩১ শতাংশ অপ্রাকৃতিক মৃত্যু ভয়াবহ অস্বাভাবিক। মধ্যপ্রাচ্যেই এর হার বেশি। অথচ মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশে এমন মৃত্যুহার তুলনামূলক কম।”

‘মা আত্মহত্যা করতে পারে না’

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের লক্ষ্মী রানী দাস ছয় বছর লেবাননে কাজ করেছিলেন। একদিন পরিবারে খবর এলো—তিনি আর বেঁচে নেই। রিপোর্টে লেখা হলো, তিনি নাকি আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর ছেলে বলরাম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, “আমার মা এত কষ্ট সহ্য করেছে, সে আত্মহত্যা করতে পারে না। এটা নিশ্চিত ষড়যন্ত্র।” পরিবার আজও অপেক্ষা করছে—মায়ের মৃত্যুর আসল কারণ জানার।

অঙ্গ পাচার, অস্বচ্ছ রিপোর্ট

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য সেলিম রেজা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন ব্যবসার সঙ্গে অভিবাসী নারীর মৃত্যুর সম্পর্ক থাকতে পারে। তিনি বলেন, “অনেক সময় কর্মীদের কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গ বিক্রির অভিযোগ ওঠে। মৃত্যুর পরপরই কাগজে লিখে দেওয়া হয়—স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক। এসব নজরদারির জন্য দূতাবাসকে আরও সচেতন হতে হবে।”

মর্যাদা না থাকা মরদেহ গ্রহণে

প্রিয়জন হারানোর বেদনার সঙ্গে যুক্ত হয় মরদেহ ফেরত আনার জটিল প্রক্রিয়া। রামরুর গবেষণা বলছে, ৮০ শতাংশ পরিবার কাগজপত্র জোগাড়ে ভোগান্তির শিকার হয়। কখনো কখনো ৬ মাস পর্যন্ত মরদেহ ফেরত আসতে সময় লেগেছে।

বিমানবন্দরে এলোমেলোভাবে অন্যান্য কার্গোর মধ্যে মরদেহ রাখা হয়। পরিবারের জন্য অপেক্ষার কোনো মর্যাদাপূর্ণ স্থান নেই।

তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, “বিমানবন্দরে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করা দরকার। মরদেহ রাখার জন্য আলাদা সম্মানজনক এলাকা থাকতে হবে। প্রয়োজনে হিমঘরের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।”

বিরল ন্যায়বিচার : আবিরুন বেগমের গল্প

খুলনার পাইকগাছার মেয়ে আবিরুন বেগম ২০১৮ সালে সৌদি আরব যান গৃহকর্মী হিসেবে। গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনে তাঁর মৃত্যু হয়। ৫১ দিন পর পরিবার খবর পায়। মৃত্যুসনদে স্পষ্ট লেখা ছিল—হত্যা।

দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০২১ সালে রিয়াদের আদালত গৃহকর্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে শাস্তি মওকুফ হলেও পরিবার ন্যায়বিচারের একটি নজির দেখতে পায়।

এমন বিচারের ঘটনা বিরল। অধিকাংশ মৃত্যু আজও রহস্যের আড়ালে রয়ে যায়।

করণীয়: ময়নাতদন্ত, মানসম্মত মৃত্যুসনদ

বিশ্লেষকরা বলছেন, সন্দেহজনক মৃত্যু হলে গন্তব্য দেশ অথবা বাংলাদেশে ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা থাকতে হবে। মৃত্যুসনদে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ জরুরি। অস্পষ্ট শব্দ যেমন ‘প্রাকৃতিক মৃত্যু’ ব্যবহার না করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডে কারণ উল্লেখ করা দরকার।

নারী অভিবাসীদের অভিবাসন-পূর্ব প্রশিক্ষণ অনেক সময় কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ এই প্রশিক্ষণে তাঁদের শেখানো দরকার— শারীরিক ও যৌন সহিংসতার ঝুঁকি মোকাবিলা; দুর্ঘটনা এড়ানোর উপায়; গন্তব্য দেশের শ্রম কল্যাণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ; 

দীর্ঘস্থায়ী রোগ ব্যবস্থাপনা এবং সঙ্গে থাকতে হবে বাংলাদেশের দূতাবাসের নিয়মিত তদারকি।

পরিবারের প্রশ্ন : “আমরা কি শুধু কফিন পাব?”

অভিবাসী নারীর মৃত্যু মানে শুধু একজন শ্রমিকের মৃত্যু নয়—একটি পরিবার ভেঙে পড়া। সন্তানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হওয়া। স্বামী, ভাই বা বাবা-মার কাছে এক অমোচনীয় ক্ষত তৈরি হওয়া। কিন্তু এই মৃত্যুর তদন্ত, মর্যাদাপূর্ণ গ্রহণ, সঠিক ক্ষতিপূরণ বা রাষ্ট্রীয় সহায়তা না থাকায় পরিবারগুলো আরও অসহায় হয়ে পড়ে।

তাসনিম সিদ্দিকীর কথায়, “এই সমস্যা কোনো একটি দেশের নয়। প্রেরণকারী দেশগুলোকে একত্র হয়ে বৈশ্বিক ফোরামে বিষয়টি তুলতে হবে। অভিন্ন মৃত্যুসনদ, সঠিক তদন্ত ও মরদেহের মর্যাদাপূর্ণ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।”

বাংলাদেশি নারী অভিবাসীরা তাঁদের শ্রমে বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেন। অথচ তাঁদের মৃত্যু যখন ঘটে, তখন পরিবার পায় না উত্তর, পায় না মর্যাদা। প্রশ্ন জাগে—আমরা কি তাঁদের শুধু কফিনেই ফিরিয়ে আনব, নাকি তাঁদের নিরাপত্তা, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করব? একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু প্রবাসী নারীর রেমিট্যান্স নেওয়া নয়, তাঁর জীবন ও মৃত্যুর মর্যাদা রক্ষা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

এই বিভাগের জনপ্রিয়