ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৪৩:৪৮ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
আজ আসছে না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা পেছাল খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে জুবাইদা রহমান ‘শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের ইতিবাচক সাড়া নেই’ বেশির ভাগ সবজিই ৬০-৮০ টাকার ওপরে বন্যায় সহায়তা: বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী

নারীর ৫ ঘণ্টা কর্মঘণ্টা, পেছনের রাজনীতিটা আসলে কী

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৯:০৫ এএম, ২ নভেম্বর ২০২৫ রবিবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মধ্যরাতে এই নারী শিক্ষার্থীদের সাহস ও স্লোগানে যখন রাজপথ কাঁপছিল, তখন এই নারীদেরই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নানা ‘প্রতিকূলতা’র মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। গত এক বছর নারীদের খেলাধুলা, পোশাক থেকে শুরু করে চলাফেরা নিয়ে নানা বিরূপ ঘটনা আমরা দেখেছি। এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নারীদের মূল্যায়ন নিয়ে দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনেও নারীদের ‘আড়াল’ করার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাগুলোতে নারীরা ছিলেন অদৃশ্য।

দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক হওয়ার পরও নারীদের ছাপ আমরা যেমন ‘জুলাই সনদে’ দেখতে পাইনি, তেমনি নারীদের নিয়ে গঠিত কমিশনের সুপারিশও ‘ফাইলবন্দী’ হয়েছে। সর্বশেষ এ আলোচনায় যোগ হয়েছে নারীদের ‘কর্মঘণ্টা’ হ্রাসকরণ। ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান প্রকাশ্যেই বলেছেন, তাঁরা ‘ক্ষমতায়’ গেলে নারীদের অফিস-আদালতে কাজের সময় আট ঘণ্টা থেকে কমিয়ে পাঁচ ঘণ্টা করে ফেলবেন, যাতে তাঁরা বাসাবাড়িতে গিয়ে সন্তানের হক আদায় করতে পারেন।


এমন বাক্য শুনতে ভালো লাগলেও এতে বরং নারীদের গৃহ অনুরাগী হওয়ার পরোক্ষ ইচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি কিংবা তাঁরা হয়তো এমন একটি বাংলাদেশকে চাইছেন, যেখানে নারীদের কাজ ঘর সামলানো, সন্তান প্রতিপালন করা। যে ধারার বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়ারা দিনের পর দিন লড়াই করে নারীদের ঘরের বাইরে এনেছেন, তাঁদের এই জগতের সৌন্দর্য ভোগের সুযোগ এনে দিয়েছেন, সেই নারীদের আবার ঘরে ঢোকানোর ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাচ্ছি।

এই বক্তা হয়তো মনে করছেন, সন্তানের হক পূরণের জন্য নারীদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে ফেলা প্রয়োজন। কিন্তু এই বক্তা এটা মনে করেন কি না, সেই হক পূরণ তো বাবাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাহলে এখন কি বাবাদেরও পাঁচ ঘণ্টার কাজ করার সুযোগ মিলবে? কারণ, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তানের অধিকার মায়ের প্রতি বেশি থাকলেও একজন সন্তানের প্রতি মা-বাবা উভয়ের সমান হক আছে। কেবল ‘মায়েরা’ সন্তানকে লালন করবেন, বাবারা কেন করবেন না, তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন করবেন না?

নারীদের অধিকার ও সংগ্রাম নিয়ে কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে নারী অধিকারকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে গণমাধ্যম একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। নারীদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা নিয়ে সংগ্রাম করছে। এখন যদি নারীদের ক্ষমতায়নকে কেউ যদি পছন্দ না করেন, তাঁদের বিষয়ে নিজস্ব চিন্তাচেতনা কিংবা রাজনৈতিক দলের আদর্শিক চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটাতে চান, তাহলে সেটি তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়। তবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত ও সংগ্রামনির্ভর যাত্রায় নারীদের অংশগ্রহণকে সংকুচিত করার চেষ্টা কখনোই গ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না।

পুরুষের চেয়ে নারীদের দুর্বল ভাবার এই বিষয়টি বহুকাল ধরে চর্চিত হয়ে আসছে। ফলে বিশেষ দৃষ্টিকোণের মোড়কে নারীকে মুড়িয়ে দেওয়া আর পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা নারীদের প্রতি অবিচারের পথ তৈরি করবে।

ধরুন, আপনি একজন পুরুষ, আপনাকে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করে ঘরে ফিরতে হবে। বাসায় গিয়ে সন্তান ও স্ত্রীর খাবার তৈরি করতে হবে, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে হবে, তখন বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখবেন? আপনি কি বলবেন, আপনার স্ত্রী অফিসে কাজ করুক, আর আপনি দুর্বল বলে বাসায় এসে ঘরদুয়ার সামলাবেন? সেটা যদি না পারেন, তাহলে একজন নারী কীভাবে সেটা দেখবেন?

আসলে একটি সভ্য ও ইনসাফের রাষ্ট্র গঠন করতে চাইলে আপনাকে নারী-পুরুষ ভেদাভেদের কোনো সুযোগ নেই। নারীরা দুর্বল নন; বরং নারীদের কর্মদক্ষতা যেকোনো পুরুষের সমান বা বেশি। নারীদের মেধা কেমন, তা বোঝার জন্য পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলগুলোর দিকে তাকান, মেডিকেল কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ফলাফলগুলো পরখ করুন, দেখবেন ছেলেদের চেয়ে নারীরা এগিয়ে। নারীরা এখন আর মনে করেন না যে তাঁদের জন্ম হয়েছে চুলার পাশে থাকার জন্য, তাঁদের জন্ম হয়েছে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য; বরং নারী মনে করেন, সন্তান প্রতিপালনে দুগ্ধদান প্রাকৃতিক নিয়ম, যা তাঁকে করতে হবে। পুরুষদের সঙ্গে অফিস-আদালতে গিয়ে তাঁরা মনে করেন, এই রাষ্ট্র বিনির্মাণে তাঁদেরও দায়িত্ব রয়েছে।

বরং ওই বক্তার উচিত ছিল, নারীদের গর্ভাবস্থায় দাপ্তরিক ছুটির সময় বাড়ানো, পুরুষদের জন্য পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া, অফিস-আদালতে মায়েদের জন্য ‘ব্রেস্ট ফিডিং’ কর্নার স্থাপন করা কিংবা কর্মঘণ্টার মধ্যে দুই ঘণ্টা বিরতি রাখা, যাতে তিনি নবজাতক সন্তানের যত্ন নিতে পারেন।

তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় নারীরা যে সীমাহীন পরিশ্রম করার পরও পুরুষদের মতো বেতন-ভাতা পান না, তা নিয়ে কথা বলা। নারী ও পুরুষদের বেতন নিয়ে বৈষম্য না রাখা। এটা হলো ইনসাফের পরিভাষা। বিশেষ করে ঘরের বাইরে নারীরা যখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, যখন নারীদের টার্গেট করে পোশাকের রাজনীতি চলছে, তখন কর্মঘণ্টা নিয়ে নারীদের সম্মতিজ্ঞাপন তাঁদের ‘ঘরে ফেরানোর’ কৌশল কি না, তা অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে।

অন্যদিকে যাঁরা তাঁদের নিয়োগ দেবেন, তাঁরা নিশ্চয় পাঁচ ঘণ্টা কাজ করিয়ে আট ঘণ্টার বেতন দেবেন না। নারীরা তখন বাধ্য হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়বেন কিংবা ঘরে থাকতে বাধ্য হবেন। আমরা এ বিভেদের রাজনীতি দেখতে চাই না। সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করার সুযোগ নেই।

এই রাষ্ট্রগঠনে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে নারীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তাঁদের লোভ দেখিয়ে ঘরে বন্দী করার জন্য তাঁরা স্বাধীনতার সময় অস্ত্র ধরেননি। তাঁরা যদি পাকিস্তান কিংবা ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলের এ কথাগুলো একাত্তরে মেনে নিতেন, তাহলে দেশটার জন্য লাখ লাখ মা-বোন ধর্ষিত হতেন না।

রক্তের বিনিময়ে পাওয়া নারীদের সংগ্রামে যে দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে, সেই দেশে নারীদের নিয়ে কোনো ধরনের অবজ্ঞা গ্রহণযোগ্য হবে না। নারীদের নিরাপত্তার জন্য, তাঁদের কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষার বিষয়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নারী বোরখা পরবেন, নাকি সালোয়ার-কামিজ-শাড়ি পরবেন, সেটি একান্ত নারীর বিষয়। এটা পুরুষদের চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। পুরুষেরা রাজনীতি করছেন, রাষ্ট্র চালনা করছেন বলেই নারীদের তাঁদের করা নির্দেশনা মানতে বাধ্য করাতে হবে কেন?

নারীদের ‘নারী’ ভাববার সুযোগ নেই। তাঁদের ‘মানুষ’ হিসেবে দেখতে হবে মানুষের চোখে, কোনো পুরুষের চোখে নয়। আমরা মেয়েদের আর কোনো অমানিশার দিকে ঠেলে দিতে পারি না। বাংলাদেশ যে অন্ধকার ও কুসংস্কার ধারা থেকে বেরিয়ে আলোর পথে আসছে, সেই পথকে কণ্টকিত না করে; বরং বরং নারীর প্রতি সাহস ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে । তাহলে একটি সুন্দর বাংলাদেশ আমরা দেখতে পাব।