ঢাকা, সোমবার ২৯, এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০৮:৪১ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
কাটাখালী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হলেন রিতু আজ দেশে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী দেশের ইতিহাসে হিটস্ট্রোকে একদিনে ১৭ মৃত্যুর রেকর্ড ঢাকাসহ ৫ জেলার স্কুল-কলেজ বন্ধ আজ, প্রাথমিক খোলা বিপজ্জনক দাবদাহ থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন যেভাবে ফিলিপিন্সে সরকারি স্কুলে সশরীরে পাঠদান স্থগিত

নিঝুম দ্বীপের চিরবঞ্চিত নিঝুম নারীরা

আফরোজা নাজনীন | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:০৬ পিএম, ৯ জানুয়ারি ২০২৪ মঙ্গলবার

নিঝুম দ্বীপের চিরবঞ্চিত নিঝুম নারীরা।

নিঝুম দ্বীপের চিরবঞ্চিত নিঝুম নারীরা।

নিঝুম দ্বীপের নারীদের কথা যখন লিখতে বসলাম, কম্পিউটারে সেভ দিলাম নিঝুম নারী নামে। নিজের অজান্তে ভালো লাগলো। আসলে এ ধরনের সংজ্ঞা ছাড়া এখানকার নারীদের পরিচয় ফুটিয়ে তোলা যায় না। এখানকার নারীরা এ দ্বীপের মতই নিঝুম। পুরুষের রাগী চোখের কাছে একেবারে নমিত। চোখ মেলে তারা এ দ্বীপটিকেও হয়তো ভালোভাবে দেখেনি কোনো দিন। চারদিকে তাকিয়ে দেখার আগেই তাদের হয়তো চলে যেতে হয় অন্য কোথাও। অন্য কোন জেলায়। 

এ দ্বীপে বাল্যবিবাহ খুব সাধারণ বিষয়। মেয়ের বয়স দশ বছর হয়ে গেছে! এ বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে  চলে উপদেশ-বিয়ে দাও, বিয়ে দাও। এখানে বাল্যবিবাহের হার যেমন বেশি, তেমনি যৌতুকের হারও বেশি। আবার স্বামী পরিত্যাক্তার সংখ্যাও  অন্য জেলার চেয়ে বেশি। 

রিনা সুলতানার বয়স ১৬। বিয়ে হয়েছে ১৪ বছর বয়সে। স্বামী ফেনীর ছেলে কেরামতউল্লাহ। স্বামী তাকে ফেলে চলে গেছে। রিনার চোখে এখন ঘুমহীন রাত ও উদ্বেগের কালো ছায়া ক্রমশ দাগে পরিণত হয়েছে। স্বামী কোথায় গিয়েছে রিনা তা জানে না। তাকে তো সত্য কথা বলে যায়নি। যাবার বেলায় বলে গেছে, বাবার কাছে যাচ্ছি, তোমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাবো তো। তাই একটু গুছগাছ করে আসি। 

কেরামতের ফেনীর বাড়িতেও খোঁজ নেয়া হয়েছে। সে তার বাবার কাছে যায়নি। বিয়ের সময় কেরামত রিনার বাবার কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা যৌতুক নেয়। এ টাকার মধ্যে ভেঙ্গে ভেঙ্গে দশ হাজার করে টাকা নেয় কেরামত। বাকি দশ হাজার টাকা এক সাথে কেরামতের হাতে তুলে দেয় রিনার বাবা। এ টাকাই রিনার কপাল ভাঙ্গলো। টাকা হাতে পেয়ে কেরামত বললো বাড়ি যাবো। বাবার হাতে টাকাটা দেবো।  সেই যে গেল আর এলো না।

বাংলাদেশের আর দশটা গ্রামের মতোই এখানকার নারীরা অধিকার বঞ্চিত।  জন্ম নিয়েই তারা পায় অবহেলা। কোনমতে খেয়ে না খেয়ে তারা বড় হয়। শিক্ষা বলতে  আরবি শিক্ষার নামে ছেপারা পড়া। ছেপারা শেষ হওয়ার আগেই সে প্রচেষ্টাও বন্ধ। কারণ মেয়ে বড় হয়ে গেছে। বিয়ে নামক বিশৃঙ্খল জীবনের সাথে তাকে জড়িয়ে দেয়া হয়। 

বলা যায় পিছিয়ে থাকা একটি সমাজে যত রকমের নিয়ম ও কৌশল রয়েছে তার সবটাই বেঁধে রেখেছে এই গ্রামের নারী সমাজকে। এখানকার জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী তবুও  নিস্পেষিত হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্তচক্ষুর কাছে।  এ বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন নিস্পেষিত হচ্ছে অপুষ্টি, বাল্যবিবাহ, যৌতুক আর পুরুষের বহুবিবাহের শৃঙ্খলে। 

দরিদ্র বাবা-মা মূলত কন্যার খরচ কমাতেই কন্যাকে অল্প বয়সে বিয়ে দেন। এখানে শতকরা ৯০ ভাগ মেয়ের বারো/তের বছর বয়েসে বিয়ে হয়। এ দেশে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ তা এখানকার বাবা-মায়েরা জানেন না। 

এ প্রসঙ্গে নিঝুমদ্বীপ বিদ্যা নিকেতনের শিক্ষক জাহিদুর রহমান জানান, এখানে  শিক্ষিতের হার এক শতাংশেরও কম। নিরক্ষর এসব মানুষ আইন বোঝেনা।  শুধু বোঝে মাথা থেকে বোঝা দূর করতে।

এখানকার মেয়েদের আরেক শত্রু বিশাল সমুদ্র। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। একবার সাগরে গেলে যদি আর ফিরে না আসে তাহলে কি হবে। তখন মেয়ের বিয়ে কিভাবে দেবে? যৌতুকের টাকা কোথায় পাবে? এ ভয় থেকেই বাবা সাগরে যাওয়ার আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যায়। তড়িঘড়ি বিয়ে হয় বলে যৌতুকও চেপে বসে পাথরের মতো। এখানে যৌতুক হিসেবে টাকা ছাড়াও রয়েছে গরু, ছাগল  ও মহিষ। অনেক সময় মাছও যৌতুক হয়ে যায়। যেমন সাগরে ধরা মাছ নতুন জামাইকে দেয়া হয়। সে মাছ বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা নেয়।

এখানে যৌতুক নিয়ন্ত্রণ করে দালালরা। দালাল যা বলবে তাই মেনে নেবে কন্যাপক্ষ। বাল্যবিবাহ বেশি বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেকার ও শ্রমিকরা এখানে আসে। এ ভিড় বেশি হয় ধানকাটার সময়ে। এ ছাড়া মাটি কাটার প্রয়োজনে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে গেলে বিয়ের সংখ্যাও বেড়ে যায়। 

এ প্রসঙ্গে দ্বীপের সবচেয়ে বড় মসজিদের ইমাম আব্দুর রহমান জানান, ধার কাটা মৌসুমে দিনে ৩/৪টি বিয়ে তো পড়াতেই হয়।

তিনি জানান, বিয়ে যেমন বেশি হয়, তালাকও তেমনি বেশি হয়। বিয়ের প্রধান কারণ যেহেতু যৌতুক, সে জন্যই যৌতুক নিয়ে টানাটানির কারণেই তালাক হয়। 

দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার হিসাব মতে, নিঝুম দ্বীপে স্বামী পরিত্যাক্তা নারীর সংখ্যা প্রায় হাজার খানেক। 

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মি মেরাজউদ্দীন জানান, শিক্ষা-দীক্ষা নেই বলেই  যৌতুককে উছিলা করে এ অঞ্চলে নারীদের ওপর নির্যাতন হয় বেশি।

যৌতুক নিয়ে বনিবনা না হওয়া বা টাকা পয়সা নিয়ে দর কষাকষি হলে তালাক হয়ে ওঠে অনিবার্য। তালাক দিয়ে সেসব পুরুষ এলাকা ছেড়ে চলে যায়। বছর ঘুরতেই দেখা যায় সে সব পুরুষ আবার দ্বীপে ফিরে আসে। ফিরেই আবার বিয়ে করে, সে বিয়েতেও হয়তো একটা গরু কিংবা কয়েক হাজার টাকা যৌতুক পায়। 

এভাবেই এখানকার নারীরা বিয়ে নামক প্রথার নিস্পেষনে জীবনের সব ধরনের স্বাভাবিকতা হারায়। মেয়ের বিয়ের যৌতুকের জন্য অনেক সময়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে। কারণ তারা মহাজন বা বেসরকারি সংস্থা কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কারো কাছ থেকে ঋণ নেয়। ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে মেয়ে বিয়ে দিয়ে মুক্ত হয় বটে, কিন্তু সুদের ভারে এক সময় দেউলিয়াও হয়ে পরে। এভাবে যৌতুক দিয়ে মেয়ে বিয়ে দেয়ার প্রবণতা এখানকার গুচ্ছগ্রামগুলোতে বেশি। বাতায়ন, শতফুল, বসুন্ধরাসহ প্রত্যেকটি গুচ্ছগ্রামে প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ পরিবারই ঋণ নিয়ে বিয়ে দেয়।

যতই অভাব হোক, বেশি সন্তান হলে বাবা-মায়েরা চিন্তামুক্ত থাকে। কারণ তারা মনে করে, সন্তান তাদের ভবিষ্যৎ ভরসা। তাদের কথা হলো,‘কহন ঝড় অইব, আর কয়ডারে লইয়া যাইবো ঠিক নাই। বেশি পোলা-মাইয়া হইলে মনে বল পাই।’   

দেখা গেছে, প্রতিটি পরিবারে কমপক্ষে পাঁচটি সন্তান রয়েছে।  কোনও কোনও ঘরে ১৪ থেকে ১৫টি সন্তানও আছে।  এদ্বীপে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি নেই। কোনও নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে আগ্রহী হলেও পরিবার পরিকল্পনা কর্মিরা এখানে আসে না। ফলে নারীরা কোনও পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে না।

মাজেদা বেগম। বয়স ৪০-এর কোঠায়। তার সাত ছেলে দুই মেয়ে।সিডরের ভয়াল রাতে মারা গেছে এক মেয়ে ও এক ছেলে। মাজেদার স্বামী জইনুদ্দিন (৬০) বলেন, অহনও চাই পরিবার আরও বাড়ুক। আবার কহন কেডা গাংয়ের (ঝড়- জলোচ্ছাস) প্যাডে যায়, কেডা জানে?

জানা গেছে, সারা বছরজুড়ে এ দ্বীপের নারীরা নানা রকম যন্ত্রণায় থাকেই, দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও তাদের সইতে হয় কষ্ট। বিশেষ করে সন্তানসম্ভবা মায়েদের সইতে হয় অর্বণনীয় কষ্ট।  এ কষ্ট আরো বেড়ে যায় সন্তান প্রসবের সময়। এমনও হয়েছে বাইরে ঝড়-জলোচ্ছাস বইছে। ঘরের ভেতরে প্রসব যন্ত্রণায় কাঁদছে মা। যেখানে সে আশ্রয় নিয়েছে সেখানেই বাচ্চা হয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছাসে নারী নৌকায়, আশ্রয়কেন্দ্রে, প্রতিবেশি কিংবা অচেনা কারও বাড়িতেও সন্তান জন্ম দেয়।  নিঝুম দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়, বন্যা, সাইক্লোন, সিড়র, নার্গিস ও আইলার সময় অনেক  নারী খোলা আকাশের নিচে সন্তান প্রসব করেছে এমন উদাহরণও রয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপি) জানায়, দুর্যোগে ৫ শতাংশ নারী প্রসবকালে কোনও সহায়তাকারী পায় না। সে নিজেই একা একা সন্তান প্রসব করায়। ৩৬ শতাংশ নারী নিজের ঘরের বাইরে সন্তান জন্ম দেয়। 

জরিপে আরো জানা যায়, দুর্যোগের সময় ২ শতাংশ নারী নৌকায়, ১২ শতাংশ নারী খোলা জায়গায়, ৬ শতাংশ নারী  আশ্রয়কেন্দ্রে, ১০ শতাংশ নারী প্রতিবেশির বাড়িতে, ৬ শতাংশ নারী আত্মীয়ের বাড়িতে সন্তান জন্ম দেয়। 

জানা গেছে, নিঝুম দ্বীপে কোন হাসপাতাল নেই। তাই বাড়িতেই সন্তান প্রসব বেশি হয়। সঙ্গে থাকে মা-খালারা।  প্রসবজনিত জটিলতায় পড়ে বেশির ভাগ মা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। কারণ ট্রলারে করে হাতিয়া বা অন্য উপজেলায় নিতে নিতেই মায়ের  মৃত্যু ঘটে। এখানে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার বেশি। 

এ দ্বীপে নারী  শিক্ষার হার খুবই কম। সার্বিক শিক্ষার হার এক শতাংশের নিচে। সে  ধারাবাহিকতায় নারী স্বাক্ষরতার হারও কম। এ গ্রামের কন্যাশিশু ও নারীরা প্রায় সবাই কোরান শরীফ পড়তে পারে। ছোটবেলা থেকেই মসজিদে যায় ছেপারা পড়তে। প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শতকরা ২০ জন ছাত্রী তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত যাওয়া আসা করে। তারপরই তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। 

স্থানীয় রাজনীতিবিদ মিরাজউদ্দীন জানান, এখানে তিনজন মেট্রিক পাশ নারী রয়েছে, তারা তিনজনই বিবাহিতা। স্বামীর কর্মস্থল সূত্রে তারা এখানে রয়েছে। ফেনীর মেয়ে সেলিনা আক্তার (মেট্রিক পাশ) গৃহবধূ। তিনি স্বামীর কাজ উপলক্ষে এ দ্বীপে বসবাস করছেন।  

জানা গেছে, এখানকার নারীরা খুবই পর্দানশীন। বোরখা তো পড়েই, একটু স্বচ্ছল পরিবারের নারীরা পায়ে মোজাও পড়ে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এখানকার নারী ও মেয়েরা শীত গ্রীস্ম সব সময়েই ছাতা ব্যবহার করে। আবার পথচলার সময়ে পুরুষের মুখোমুখি হলে ছাতা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে।