ঢাকা, শুক্রবার ১৯, এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫২:০৯ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
শিশু হাসপাতালের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে শিব নারায়ণ দাশের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক পরলোকে জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ন মানুষ এখন ডাল-ভাত নয়, মাছ-মাংস নিয়ে চিন্তা করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট

রোকেয়া হল : একাত্তরের নিরব সাক্ষী

ঝর্ণা মনি | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০১:২২ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সার্ভেন্ট কোয়ার্টার। সরু গলি আর ঘুপচি ঘরের মাটির দেয়াল সর্বত্র শুধু রক্ত আর রক্ত। তাজা টকটকে লাল রক্তে ভেসে গেছে মেঝের নিজস্ব রঙ। ছোপ ছোপ রক্তের মাঝে একাকী আপন মনে চিৎকার করছে একটি শিশু। তার সর্বাঙ্গে রক্তমাখা। হয়তো মা সুরাইয়া বেগমের রক্তও লেগেছিল তার গায়ে। সারা রাত হলের পানির ট্যাংকির নিচে আত্মগোপনে থাকা দারোয়ান মনিরুদ্দীন পরদিন রক্তসাগরে খুঁজতে গিয়েছিলেন প্রিয় স্বজনদের। একমাত্র কন্যা সুরাইয়ার এই অবুঝ শিশুটি ছাড়া আর কাউকে জীবিত পাননি তিনি। একাত্তরের ২৬ মার্চ সব হারানো মনিরুদ্দীনের একমাত্র আশ্রয় নাতনিটি নিয়েই বেঁচেছিলেন জীবনের শেষদিনগুলো।


বিভীষিকাময় ওই রাতে জগন্নাথ হল, জহুরুল হক হলের সঙ্গে সঙ্গেই তখনকার একমাত্র ছাত্রী হল রোকেয়া হলেও ট্যাংক, কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার দল পাকবাহিনী। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি দেশের সেনাবাহিনী সেই দেশেরই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে আক্রমণ চালাতে পারে এমন নজির ইতিহাসে নেই। বিশ্বকে হতবাক করে দিয়ে পাকবাহিনী সেই জঘন্যতম লজ্জাজনক কাজটি করেছিল। রোকেয়া হলে আক্রমণ চালিয়ে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। নিরস্ত্র-নিরপরাধ হলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তারা। ঢাকার তখনকার কাউন্সিল জেনারেল আর্চার কে ব্লুাডের ‘দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ থেকে জানা যায়, ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের ওপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে আর্মি ইউনিট ৮৮-এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সে সময় হত্যা করা হয়। ওই সময় এম এ ফাইন্যাল ইয়ারের ছাত্রী ছিলেন ফরিদা বেগম সাকি। কালরাতের বর্ণনায় তিনি বলেন, আমরা রাত ৮টার মধ্যে খাবার খেয়ে নিই। এরপর আমি ও আমার রুমমেট মমতাজ বেগম রুমে গিয়ে শুয়ে শুয়ে গল্প করি। রাত ১১টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। সাড়ে ১১টার দিকে গুলির শব্দ শুনতে পাই। দূরে কোথাও হচ্ছে ভেবে আমরা আর গা করি না। গুলির আওয়াজ আরো বেড়ে যাওয়ায় আমরা দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি পাক সেনারা হলের মূল ফটক ভেঙে ফেলেছে। এরপর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে। জগন্নাথ হল, জহুরুল হক হল থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল। অবিরাম গুলিবর্ষণে মনে হচ্ছিল একরাতেই বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেবে। প্রচণ্ড ভীত হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে প্রভোস্ট আখতার ইমামের বাসায় যাই। অনেক অনুনয় বিনয়েও তিনি আশ্রয় দিতে অস্বীকার করলে আবাসিক শিক্ষিকা সাহেরা বেগমের বাসায় আশ্রয় পাই। পরদিন রক্ত নদী পেরিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় পৌঁছি।


১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নিবাস রোকেয়া হলে কী ঘটেছিল এ সম্পর্কে ঢাকার সে সময়ের মার্কিন কনসাল জেনারেল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন পরবর্তীতে তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অবমুক্ত মার্কিন গোপন দলিলে জানা যায়, পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে ফ্যানের সিলিংয়ে ৬টি মেয়ের পা বাঁধা নগ্ন মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। ধারণা করা হয়েছে, তাদের ধর্ষণ করার পর গুলি করে ফ্যানের সঙ্গে পা ঝুলিয়ে দেয়। এছাড়া হলের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে।


শুধু হলের ছাত্রীদের ওপরই নয়, পাকসেনাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি হলের কর্মচারীরাও। সেই রাতে পাকিস্তানিরা হলের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে বেপরোয়া গুলি চালিয়ে মালী, দারোয়ান, পিওন, ঝাড়–দার ও তাদের পরিবারের মোট ৪৫ জনকে হত্যা করে। পরে মাটিতে পুঁতে রাখে। গণকবরের পর এর ওপর দিয়ে ট্যাঙ্ক চালিয়েছিল। বিজয়ের পর কবর খুঁড়ে ১৫টি মাথার খুলি ও আরো অনেক খুলির ভগ্নাবশেষ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত কঙ্কাল পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওই সময় কবর থেকে একটি ঘড়ি ও কয়েকগাছি চুড়ি পাওয়া গেছে। ঘড়িটি নাসিরউদ্দিন নামে এক ব্যক্তির। তার ভাই গিয়াসউদ্দিন হলের কর্মচারী ছিলেন। আরেক কর্মচারী আলী আক্কাসের মেয়ে রাশিদার হাতের কয়েকখানা চুড়ি পাওয়া গেছে। নমী নামক আরেক কর্মচারীর ভাইয়ের বউয়ের চুড়ি পাওয়া গেছে। নমীও সে রাতে নিহত হন। নমীর পরিবারের ৮ জনকে হত্যা করে উল্লাস করে নরপশুরা। শুধু নমীর ১৬ বছরের এক সন্তান রামশঙ্কর অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। নবম শ্রেণির ছাত্র রামশঙ্কর ঘরের খাটের নিচে বাক্সের পেছনে লুকিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন হানাদারদের রক্তলোলুপ দৃষ্টি এড়ানো যাবে। কিন্তু ঘাতকের এলোপাতাড়ি বুলেট তাকে বিদ্ধ করেছে। ডান কাঁধের একদিকে গুলি ঢুকে অপর দিকে বেরিয়ে গেছে। এরপর রামশঙ্কর যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন, তখনই এক খানসেনা তাকে দেখে ফেলে এবং মৃতের স্ত‚পে শুইয়ে রাখে। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রামশঙ্কর সেই কালরাতের বিভৎস্য বিবরণ দেন। তার ভাষায়, আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। আমি বুঝলাম আমাকে তারা অন্যদের সঙ্গে মাটিচাপা দেবে। একটু পর সবাই কী কাজে দূরে গেলে আমি সুযোগ বুঝে মৃতের মিছিল থেকে বেরিয়ে আসি। চারপাশে তখন অগণিত লাশ। আমি গুনতে পারিনি। মৃতের মিছিলে মা ও ছোট বোনের লাশ দেখেও দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলাম।


হলের বেয়ারা গিয়াসউদ্দিন পানির ড্রামে আত্মগোপন করে রক্তপিপাসুদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তবে চুনু মিয়া, সোলেমান খান, মোহাম্মদ খালেক, হাফিজুদ্দীন, নুরুল ইসলাম, আহমদ আলী, বাসুদেব ওই রাতেই নিহত হন।