ঢাকা, শনিবার ০৬, ডিসেম্বর ২০২৫ ১:২২:০৪ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
আজ আসছে না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা পেছাল খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে জুবাইদা রহমান ‘শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের ইতিবাচক সাড়া নেই’ বেশির ভাগ সবজিই ৬০-৮০ টাকার ওপরে বন্যায় সহায়তা: বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী

শ্রমবাজারে সংকট, চাকরি হারাচ্ছেন লাখো নারী

নিজস্ব প্রতিবেদক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০২:১৬ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি নারীরা শ্রমবাজার থেকে ছিটকে পড়ছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশে প্রায় ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ লাখই নারী। অর্থাৎ চাকরি হারানো মানুষের ৮৫ শতাংশের বেশি নারী, যা শ্রমবাজারে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। 

গত মে মাসে প্রকাশিত ‘জেন্ডারভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ইউএন উইমেনের সহযোগিতায় প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মসংস্থানের এই সংকোচন শুধু পরিবারগুলোর আয়কেই প্রভাবিত করছে না, বরং দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সামাজিক ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত ও সেবা খাতে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নারী শ্রমশক্তি অংশগ্রহণে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে। নেপালে এ হার প্রায় ৫০ শতাংশ, ভুটানে ৫৮, কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র ৩৭ শতাংশ। কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ কমে গেলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও ঝুঁকিতে পড়বে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘তৈরি পোশাক খাত, কৃষি, সেবা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ দেশের সামগ্রিক উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। তবে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেশের শ্রমবাজারে নারীরা যে ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন, তা শুধু উদ্বেগজনক নয়, বরং শ্রমবাজারে বিদ্যমান লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের নগ্ন প্রকাশ।’ 

নারীর জীবনে অভিঘাত

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৩০ লাখ নারী কাজ করেন। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত হলেও বৈশ্বিক ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় বহু নারী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন কিংবা কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। গাজীপুরের একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করতেন জেসমিন আক্তার (২২)। গত নভেম্বরে হঠাৎ জানানো হয়, ক্রয়াদেশ না থাকায় তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে এই বেতনে সংসার চললেও হঠাৎ চাকরি হারিয়ে হতবাক হয়ে যান তিনি। জেসমিন বলেন, ‘আগে মাসে ১২ হাজার টাকা পেতাম, এখন ছোট এক কারখানায় ৮ হাজার টাকায় কাজ করতে হচ্ছে। সেই টাকায় বাসা ভাড়া, মায়ের ওষুধ আর নিজের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’ 

আরেক কর্মী শিল্পী মালিক পক্ষের অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলায় চাকরি হারিয়েছেন এবং কালো তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এই অভিজ্ঞতাগুলোই নারীদের অরক্ষিত অবস্থার চিত্র তুলে ধরে। 

শ্রম অধিকার সংগঠন গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের তথ্য বলছে, গত এক বছরে প্রায় এক লাখ নারী শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। যাদের বড় অংশই বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে পাননি। 

গ্রামীণ অর্থনীতিতে পশ্চাদপসরণ 

শুধু শহর নয়, গ্রামীণ অর্থনীতিতেও শ্রমবাজার থেকে ছিটকে পড়ছেন নারীরা। কৃষিকাজে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে যেসব নারী যুক্ত থাকতেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে তাদের কাজের চাহিদা কমে গেছে। সিরাজগঞ্জের চরের নারী শ্রমিক রহিমা খাতুন বলেন, ‘আগে ধান কাটার সময় ডাকা হতো, এখন মেশিনে কেটে ফেলে। আমাদের আর দরকার হয় না।’

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ৩৭ শতাংশ। গত এক দশকে এ হার সামান্য বেড়েছিল, তবে করোনা মহামারির পর থেকে তা কমতে শুরু করে। বর্তমানে যে সংখ্যক নারী কর্মজীবনে রয়েছেন, তাদের বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক– গার্মেন্টস, কৃষি, গৃহকর্ম, ক্ষুদ্র ব্যবসা বা সেবা খাতে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দা ও সংকটে এসব খাতেই প্রথম ধাক্কা লাগে। ফলে কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার লড়াইয়ে নারীরা সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হন। 

মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘শ্রমবাজারে নারী এখনও প্রান্তিক অবস্থানে। উৎপাদন খাতের সংকোচন হলে সবার আগে নারীকেই ছাঁটাই করা হয়।’

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব 

নারী শ্রমশক্তির সংকোচন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ১ শতাংশ কমে গেলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রায় ০.৩ শতাংশ কমে যায়। ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘নারীর চাকরি হারানো শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, বরং সার্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ 

ইনোভেশন ফর ওয়েলবিং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান বলেন, কাজ শুধু রুটি-রুজির মাধ্যম নয়, জীবনের অংশ। নারীরা কাজ হারালে শুধু আর্থিক সংকট নয়, তাদের আত্মবিশ্বাস, সামাজিক পরিচয় ও মানসিক স্থিতি ভেঙে পড়ে। 

এই সংকট মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথমত, চাকরি হারানো নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক কর্মসূচি নিতে হবে, যাতে তারা আবার কর্মসংস্থানে যুক্ত হতে পারেন। 

দ্বিতীয়ত, শ্রমবাজারে নারীদের নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, সরকারি সহায়তা ও বাজারসংযোগ বাড়াতে হবে। সেলিম রায়হান বলেন, ‘শুধু সহানুভূতিশীল নীতি নয়, বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।’

এই বিভাগের জনপ্রিয়