ঢাকা, রবিবার ০৭, ডিসেম্বর ২০২৫ ৫:২৪:২৮ এএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
খালেদা জিয়ার অবস্থা এখনও উদ্বেগজনক আরও পেছাল খালেদা জিয়ার লন্ডনযাত্রা খালেদা জিয়ার এন্ডোসকপি সম্পন্ন, থামানো গেছে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ আগারগাঁওয়ে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ, নারীসহ দগ্ধ ৬ প্রবাসীদের নিবন্ধন ছাড়াল এক লাখ ৯৩ হাজার

আব্বু আমার সকল কাজের অনুপ্রেরণা

জীনাত জোয়ার্দার রিপা | উইমেননিউজ২৪.কম

আপডেট: ০১:৪৮ পিএম, ১৯ অক্টোবর ২০১৭ বৃহস্পতিবার

আব্বুর সাথে আমার অদ্ভূত এক হাইড অ্যাণ্ড সিক খেলা চলত, দাদুবাড়ি যাওয়া নিয়ে। জন্ম, বেড়ে ওঠা আর বন্ধুদের টানে প্রতি ঈদে আমি ঢাকা থাকতে চাইতাম। ঠিক একই কারণে আব্বু চাইত রাজবাড়ী যেতে। তার বাড়িতে যাওয়ার প্রবল আরেক টান আমার দাদী। ঈদ এলেই নানা বাহানা ধরতাম বাড়িতে না যাওয়ার জন্য। ততোধিক আগ্রহ নিয়ে তিনি আমাকে নানা লোভ দেখাতেন বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

কাভি খুশি কাভি গাম রিলিজের পর যে ঈদ এলো, আব্বুকে বললাম, বাড়ি যেতে পারি, আমাকে কারিনার মত শর্ট কামিজ কিনে দিতে হবে। যেনতেনটা দিলে হবে না। মার্কেটের সবচেয়ে দামিটা দিতে হবে। তখন যে দামে তিনি আমাকে জামা কিনে দিয়েছিলেন, তখন ঢাকার মোটামুটি অভিজাত এলাকায় তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটের ভাড়াও এর চেয়ে কম ছিল।

জীবনে প্রথমবার সেই আব্বুকে আমি, আমরা মিলে বাড়ি নিয়ে গেলাম। আব্বু দেখতেও পেলেন না।

আমার বড় বোন মারা যাওয়ার পর আমার জন্ম, আমি আমার আব্বুর কী ছিলাম, তা কখনও শব্দে লিপিবদ্ধ করতে পারব না। আমার আব্বু ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়, সাহস, শক্তি, আব্দারের জায়গা। তিনি আমার জীবনের সকল চাহিদা মিটিয়েছেন। কোনোদিন আব্বুর কাছে পিটুনি খাইনি। পড়াশোনার জন্য আম্মু মারলে তিনি উলটে আম্মুকে বলতেন, বাচ্চাদের মারলে তাদের বিকাশ ভাল হয় না। আমার বাচ্চাদের গায়ে তুমি হাত দিবা না। সবাই ফার্স্ট হলে ফেল করবে কে? আমার মেয়ে ফেল করলে করবে, তুমি কিছু বলবা না।

একবার বাণিজ্য মেলায় বর-বউ পুতুল দেখে বায়না ধরলাম কেনার। আম্মু কিছুতেই পুতুল কিনে দেবেন না। আমার মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না দেখে আব্বুও কেঁদে দিলেন। পরদিন রাতে আব্বু বাসায় ফিরলেন সেই পুতুল হাতে নিয়ে। আমার খুশি দেখে কে! আমি তরমুজ খুব পছন্দ করি বলে মৌসুম ছাড়াও তিনগুণ দামে তরমুজ এনে দিতেন আমার হাতে। সেই তরমুজ নিয়ে আমি সারা বাড়ি আনন্দে দৌঁড়াব, শুধু তাই দেখতে। টিফিনে আম্মু আমাকে প্রতিদিন পোলাও করে দিতেন। অন্য কিছু খেতাম না বলে। তাও আব্বুর কাছে বায়না থাকত, দশ টাকার। যা চাইতাম, তার দ্বিগুণ দিতেন। বলতেন, তোর আম্মুকে বলিস না। সরকারি চাকরির কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকতে হয়েছে তাকে। আমাদের ঢাকা ছাড়তে দেননি, পড়াশোনার কথা ভেবে। নিজে কষ্ট করেছেন, আমাদের সুখি করবেন বলে। আব্বু যেদিন বাসায় আসত আমরা দুই ভাই-বোন রাত জেগে বসে থাকতাম। আব্বুর কলিংবেল শুনলেই বুঝতাম, টানা বেজে চলত। আর আমরা নাচতে নাচতে হাসতে হাসতে দরজা খুলে দিতাম। আব্বু দুই হাতে আমাদের দুই ভাই-বোনকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিতেন।

ফেব্রুয়ারি এলে আব্বু আমাদের বইমেলায় নিয়ে যেতেন। টাকা বরাদ্দ করে দিতেন প্রতিবছর। সেই পরিমাণ টাকার বই আমরা কিনতে পারব। কী মজা!

শিল্পকলায় যাত্রাপালা এলে অফিস থেকে তিন ঘন্টার ছুটি নিয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন আব্বু। বাণিজ্য মেলার মাঠে সার্কাস এলে, আম্মুর আড়ালে আমাদের উস্কাতেন বায়না ধরতে। আম্মু কিছু বললেই বলতে, আহা! বাচ্চারা যেতে চায়। তারপর আমাদের সবাইকে বাইকে চাপিয়ে সার্কাস দেখতে যাওয়া।

প্রতিমাসে একবার চাইনিজ খেতে নিয়ে যেতেন। আম্মু বলত, সংসার খরচে কম পড়বে। আব্বু অভয় দিতেন, একদিন ভাল খেলে কিছু হয় না। বাচ্চাদের মন বড় থাকে।

আব্বুকে নিয়ে গল্প শেষ হবে না, করতে চাইও না। আব্বু আমার আব্বুর চেয়ে বন্ধু ছিলেন ঢের। আমার সব সিদ্ধান্তে তার পাহাড়সম ভরসা। কত ছোট ছোট দৃশ্য ভাসে, তার হাসিমুখ সব ছাপিয়ে যায়... সেদিনও হাসিমুখেই বাসা থেকে বেরিয়েছেন। রিটারমেন্টের পর যেখানে কাজ করতেন, সেখানে গেছেন, সবার সাথে নাকি হাসিমুখে কথা বলেছেন। আশুলিয়ার অফিসে নিজেই যাচ্ছিলেন বাইক চালিয়ে। বাইক দাঁড় করিয়ে নিজেই এক গ্লাস পানি খেলেন। তার চলে যাওয়ার দৃশ্য আমাদের চোখের আড়ালেই সারলেন। আহারে আমার আব্বু... শেষ বেলায়ও আমাদের কথাই ভাবলেন!

অনেকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছেন, `স্যালুট টু পুলিশ` আমি কেন করি। আমার যে সৎ, সাহসী পুলিশ আব্বুকে আমি দেখেছি, যে পরম মমত্ববোধ সম্পন্ন একজন মানুষকে আমি নিজের আব্বু হিসেবে পেয়েছি, তাকে দেখে পুলিশকে কী করে ঘৃণা করি? তার মত মানুষ যে পুলিশই ছিলেন! তিনিই আমার সকল কাজের অনুপ্রেরণা যে!

আড়ং-এর বিছানার চাদর ছাড়া তার চলত না। আমি দেশের বাইরে গেলেই আবদার থাকত ব্র্যান্ড সুগন্ধির। আব্বু ঘুমিয়ে আছেন, আমার দাদা আর বড় বোনের সাথে। বিছানার চাদর, সুগন্ধি, লেপ, বালিশ নিয়ে শৌখিন মানুষটা আজ কিছু ছাড়াই আছেন, কী করে আমি বুঝি না...।

আব্বু, আব্বু, আব্বু বলে ডাকলেও কেউ বলছে না, হ্যাঁ, আব্বু বল...।
আব্বু...।

লেখক : সাংবাদিক