ঢাকা, শুক্রবার ০৫, ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:১১:৫৭ পিএম

First woman affairs online newspaper of Bangladesh : Since 2012

Equality for all
Amin Jewellers Ltd. Gold & Diamond
শিরোনাম
আজ আসছে না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা পেছাল খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে জুবাইদা রহমান ‘শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতের ইতিবাচক সাড়া নেই’ বেশির ভাগ সবজিই ৬০-৮০ টাকার ওপরে বন্যায় সহায়তা: বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী

নারী অধিকার রক্ষায় ‘গুলাবি গ্যাং’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | উইমেননিউজ২৪

প্রকাশিত : ০৭:৫৬ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০২২ শুক্রবার

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

একটি প্রত্যন্ত গ্রাম, একটি সংগঠন। নাম ‘গুলাবি গ্যাং’। ২০০৫-০৬ সালের দিকে সাম্পাত পাল দেবী নামের এক গৃহবধূ নারী অধিকার রক্ষায় ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের প্রত্যন্ত ওই গ্রামে সংগঠনটি শুরু করেন।

গ্রামে যারা স্ত্রীদের মারধর করতো, নারীদের উত্যক্ত করতো, বলাৎকার করতো, তাদের বিরুদ্ধে বা এলাকার দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ‘গুলাবি গ্যাং’। তাদের সদস্যরা রীতিমত লাঠি-সোটা নিয়ে মারপিট করতো।

বর্তমানে এ সংগঠন দেশের বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, যাদের সদস্যরা মূলত গৃহবধূ, পরনে থাকে গোলাপি রংয়ের শাড়ি, হাতে লাঠি। তাদের নিয়ে বলিউডে একটি চলচ্চিত্র পর্যন্ত নির্মাণ হয়েছে।

‘গুলাবি গ্যাং’এর প্রতিষ্ঠাতা সাম্পাত পাল দেবীর জন্ম ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের প্রত্যন্ত বুন্দেলখান্ডে। এই অঞ্চলে নারীদের মর্যাদা ছিলো খুবই কম। স্বামী বা তাদের স্বজনদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার, মারধর তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। সেই সঙ্গে রয়েছে নারীদের উত্যক্ত আর ধর্ষণের জন্য তৎপর চক্র।

মাত্র ১২ বছর বয়সে সাম্পাত দেবীকে স্কুল ছাড়িয়ে বিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু লেখাপড়া শেখার স্পৃহা তার যায়নি। গ্রামের ছেলেদের কাছ থেকে সে পড়াশোনা শিখতো। তারপর ১৬ বছর বয়সে সে প্রথম অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলো। গ্রামের এক পুরুষ প্রায় নিয়মিত তার বউকে পেটাতো। তাকে ঠেকানোর জন্য তিনি পরিবারের কাছে অনেক অনুরোধ করেন, কিন্তু কেউই কোনো পাত্তা দিলো না।নিজেই এগিয়ে গেলেন। মানুষটিকে মুখের ওপর জিজ্ঞেস করলেন, কেন সে প্রতিদিন তার বউকে পেটায়। রেগে গিয়ে মানুষটি তাকে গালাগাল শুরু করলো। গ্রামের অন্য কয়েকজন নারীর সাহায্যে মাঠের মধ্যে সেদিন লোকটিকে পিটিয়েছিলেন সাম্পাত দেবী। সেই থেকেই শুরু।

এরপর তিনি গ্রামের আরো কয়েকজন নারীকে নিয়ে একটি দল গঠন করলেন, তারা বউকে মারধর করার ঘটনার ওপর নজরদারি শুরু করলো। তাদের হাতে থাকতো বাঁশের লাঠি। তিনি জানতেন জোটবদ্ধ হলে বাইরের কারও কোনো সাহায্য লাগবে না। যখন একজন নারী একা কিছু করতে পারবে না, হাজার নারী তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে এমনটায় বিশ্বাস করেন সাম্পাত।

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজেই গান বাধতেন সাম্পাত। গানের ভাষা ছিল এরকম - ‘অনেক দিন হয়ে গেছে। ভারতের নারীরা তোমরা এখন জাগো, উঠে দাঁড়াও। আমরা ঘরে কখনই শান্তিতে থাকতে পারিনি। সুতরাং একজোট হয়ে রুখে দাঁড়াও’ সাম্পাত দেবী চাইলেন এই সংগঠনের নারীদের যেন মানুষজন আলাদাভাবে চিনতে পারে। এরপর পোশাকের জন্য একটি রং বাছলেন তারা।

মেয়েদের কাছ থেকে এক রুপি করে চাঁদা নিয়ে কানপুর থেকে শাড়ি অর্ডার করলেন। তাদের বললেন, চলো সবাই একরঙা শাড়ি পরি, যাতে মনে হয় আমরা ইউনিফর্ম পরছি। এরপর দেখলেন একমাত্র গোলাপি রং কোনো রাজনৈতিক দল এখনো ব্যবহার করছে না। প্রথমেই পাঁচশো গোলাপি রংয়ের শাড়ি অর্ডার করলেন। তখন থেকেই এই সংগঠনকে বলা শুরু হয় ‘গুলাবি গ্যাং’।

২০০৬ সাল নাগাদ এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক হাজার। সেই বছরই পুলিশের দুর্নীতি এবং বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ করতে গুলাবি গ্যাং স্থানীয় পুলিশ স্টেশন ঘেরাও করে। পুলিশ একজন নিরপরাধ মানুষকে ১১ দিন ধরে আটকে রেখেছিল। কারণ তার স্ত্রী গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্য ছিল। মহিষ চুরির মিথ্যা অভিযোগে পুলিশ লোকটিকে আটকে রেখেছিল। এরপর সাম্পাত দেবী থানায় গিয়ে জানতে চাইলেন কেন এটা করা হচ্ছে? কিন্তু থানার ইন-চার্জ তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। তিনি ফিরে যান, কিন্তু গুলাবি গ্যাংয়ের ৩০০ সদস্যকে আশপাশের রাস্তার কুকুর সঙ্গে করে থানাযর কাছে জড় হতে বলেন। সাম্পাত পুলিশকে দেখাতে চেয়েছিলেন, তাদের চাইতে রাস্তার কুকুরের ওপর বেশি বিশ্বাস করা যায়, আস্থা রাখা যায়।

একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি,ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায় গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্যদের। পুলিশ সাম্পাত দেবীকে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি তাদের চড় মারেন। তারপর এই গ্যাংয়ের নারীরা থানার ইন-চার্জকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেন।

গুলাবি গ্যাং সেদিন এতো হৈ-চৈ করেছিলো যে ভারতের কেন্দ্রীয় পুলিশের বড় একটি দলকে ঐ গ্রামে পাঠাতে হয়েছিল। সিবিআই এর লোকজন সাম্পাতকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কুকুর কেন নিয়ে আসলে? তিনি তাদের উত্তর দিয়েছিলেন পুলিশ যখন বড় কোনো অপরাধ তদন্ত করে তারাও তো তখন কুকুর সঙ্গে রাখে। পুলিশ যদিপারে, আমরা কেন পারবো না?

পুলিশ শেষ পর্যস্ত ঐ নিরপরাধ ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয়। গুলাবি গ্যাংয়ের সেই বিজয়ের ঘটনা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছাপা হয় সেই খবর। ছড়িয়ে পড়তে থাকে গুলাবি গ্যাংয়ের কথা।

গুলাবি গ্যাংয়ের আন্দোলনের ফলে অপরাধী এবং প্রভাবশালী একজন স্থানীয় রাজনীতিকের বিচার হয় এবং তার ১০ বছর কারাদণ্ড হয়। শুধু ঘরে সহিংসতাই নয়, গুলাবি গ্যাং সমাজের অন্যান্য অনাচার যেমন বাল্য বিবাহ এবং সতীদাহের মত অনাচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদে তৎপর হয়। সাম্পাত তার এলাকার নারীদের বলেছিলেন, অন্ধ বিশ্বাস এবং কুসংস্কার বন্ধ করতে হবে এবং অধিকারের জন্য লড়াইয়ে নামতে হবে। আরো অনেক নতুন নতুন নারী গোলাবি গ্যাংয়ের সঙ্গে একমত হলো। ফলে তাদের সংগঠন বড় হতে থাকে।

২০১০ সালে আবারো গুলাবি গ্যাং খবরে আসলো। স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজনীতিক অল্প বয়সী একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে এবং তারপর তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনে। প্রতিবাদে গুলাবি গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় জেলখানার সামনে টানা ১১ দিন ধরে অবস্থান নেয়। তাদের দাবি ছিল মেয়েটিকে মুক্তি দিয়ে আসল অপরাধী পুরুষোত্তম দিবেদিকে ধরে বিচার করতে হবে। পরে ঐ রাজনীতিকের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়।

ওই কয়েকদিনে ১০ হাজার মানুষ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। তখন শীতের সময় ছিল। ট্রেনে চড়ে দলে দলে নারীরা আসতো প্রতিবাদে অংশ নিতে। পালাক্রমে একদল আসতো, একদল বাড়ি যেত। গুলাবি গ্যাংয়ের কার্যক্রম এখন ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তাদের প্রধান তৎপরতা ভারতের উত্তর প্রদেশে।

সূত্র: ডয়চে ভেলে